আমার গাল টিপে (অবশ্যই টোপলা ) নেড়ি (কঙ্কনা ) বলেছিলো– তোর গালটা একদম পাঁউরুটির মত নরম । অখাদ্য দুধ -পাঁউরুটির রোজকার খদ্দের আমি। তাতে খুব পুলকিত হয়েছিলাম বলতে পারি না ।
আর কিছুদিন পরে ‘দাদা গো দাদা, এই দুনিয়ার সবই ভালো’ — মুখস্থ করতে গিয়ে শেষ দু’ লাইনে পৌঁছে চমৎকৃত ;কিন্তু সবার চাইতে ভালো, ‘পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড় !’ ব্যস, আমার পাঁউরুটি প্রেমের সেই শুরু l (পরে অবশ্য খেয়ে দেখেছি… তেমন কিছু সরেস নয় )I আমার বাড়ির আশপাশে কিছু বেকারির দৌলতে পাঁউরুটি তৈরির ইস্ট, মাখন ময়দার মাখামাখি গন্ধে ম ম করে প্রতিটি বিকেল l ওটা আমার সূর্যাস্তের গন্ধ ।
সবচেয়ে পুরোনো রান্না করা খাবারের দলে পাঁউরুটি বেশ বনেদি। ত্রিশ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে পাঁউরুটির পূর্বপুরুষদের তৈরি করতেন, তাতে ফার্ন বা অন্যান্য কন্দ থেঁতো করার সেই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে । সেই পাঁউরুটি নিশ্চয় গৃহবিবাদেও ব্যবহৃত হত । (এটা আমার এবং একান্তই আমার নিজস্ব ধারণা । কেউ নিজের পারিবারিক মিল পেলে তা কাকতালীয় )। হাজার তিনেক বছর আগে কিন্তু মিশরে ছাইয়ের বদলে ইস্ট বা সোডা দিয়ে পাঁউরুটি তৈরি শুরু হয়ে যায়। আর আজও মিশরের পাঁউরুটি অতি উচ্চমার্গের l রোমানরা পাঁউরুটির লোভে মিশর জবরদখল করেছিল নাকি ক্লিওপেট্রার জন্যে– বলা মুশকিল । চোদ্দ হাজার বছর আগেই জর্ডনে অবশ্য আটা ময়দা ইত্যাদি দিয়ে পাঁউরুটি বানানো হত। গল বা অন্য অনেকে বিয়ার বা ওয়াইনের ফেনা ব্যবহার করত ময়দাকে গ্যাঁজানোর জন্য।
উচ্চশিক্ষিত গেঁজে যাওয়া লোক অর্থাৎ আঁতেলরা যেমন সুধীসমাজ আলো করে থাকেন, ময়দা ঠিকমতো গেঁজে না গেলে পাঁউরুটির দুনিয়াও অন্ধকারময় l কেউ কেউ ময়দা মাখার সময় ছাতা ধরা পুরোনো রুটি মিশিয়ে দিতো (দইতে দম্বলের মতো)। আবার কেউ বাতাসে বয়ে চলা ইস্টের রেণু ব্যবহার করার জন্য মাখা ময়দা সারারাত বাড়ির চালে ফেলে রাখতো । 1963 সালের পর থেকে জলদি গ্যাঁজানোর যে পদ্ধতি শুরু হয়, আজও তেমনি চলছে। তবে চার পাঁচ ঘন্টার কম সময়ে ফার্মেন্টেশনে ‘ফোডম্যাপ’ নামের একরকম কার্বোহাইড্রেড তৈরি হয়, তাতে বদহজম, পেট ফাঁপার মতো সমস্যা দেখা যায় । ঘরোয়া পদ্ধতিতে কিন্তু এসব কিছু অসুবিধে হয় না ।
পাঁউরুটির মাথার পোড়া অংশটাকে ছোটবেলায় নাম দিয়েছিলাম কেকপিস। কারণটা সহজবোধ্য। সেদিন জানলাম ওটাকে আক্রিলামাইড বলে। 120 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা আরো বেশি তাপে ওরকম হয়ে যায় পাঁউরুটি l ওটা নার্ভের পক্ষে ক্ষতিকর, যৌনক্ষমতা কমিয়ে দেয় পুরুষের আবার নাকি ক্যান্সারও হতে পারে l যত ত্রুটি পাঁউরুটি !!
…… আমার দাদু বরাবর পাঁউরুটি বিদ্বেষী ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, ময়দায় জল ঢেলে এক বিশেষ ধর্মের মানুষ দু’পায়ে ডালডা মেখে ওই ময়দার তালকে ঘর্মাক্ত কলেবরে (এবং চুঁইয়ে পড়া ঘাম সহযোগে )পদদলিত করতে থাকে । তাই এই পা রুটি থেকে পাঁউরুটি l যতই বোঝাই, রোটি কাপড়া মকান ভারতবর্ষ থেকে বলশেভিকদের রুটি জমি শান্তি– কিংবা রুটি মানেই প্রগতি, স্বাচ্ছল্য, দাদু কোনোদিন মানতেই চায়নি ।
ঔরঙ্গাবাদ আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে মিষ্টি পাঁউরুটির এক শহর, যেখানে রাস্তার দু’পাশে ভ্যান বোঝাই বিভিন্ন ধরনের পাঁউরুটি মেলে। এখনও
বাপুজি, অভয়া, কোহিনূর, মডার্ন বেকারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুগন্ধে চোখ বুজে আসে ।
বাবার অফিস তখন লিন্ডসে স্ট্রিটে। তখন সন্ধের সময় কখনও কখনও অফিস ব্যাগ থেকে বেরতো গ্রেট ইস্টার্নের পাঁউরুটি l কী স্বর্গীয় তার স্বাদ, গন্ধ । ফ্লুরিজের রুটির নাম শুনেছি অনেক। পেয়েছি বড়বেলায়। ইস্তাম্বুলে টার্কিস ব্রেড বা মিশরে সাদা তিল মাখন ময়দার অতুলনীয় কনসার্ট, তিব্বতি ফাঁপা গোল মধু মাখা রুটি সমৃদ্ধ করেছে সভ্যতা l প্রায় ছ ‘ফুট ইরানিয়ান ফ্ল্যাট ব্রেড দেখে অবাক অবাক কচিবেলার এক কাহিনি মনে পড়ে গেল।
তখন আমি পাঁচ কি ছয় l রামুকাকুর চায়ের দোকানে কালিদাদু এককাপ চা নিত আর তাতে একটা গোল নেড়ো ফেলে দিতো l ম্যাজিক ম্যাজিক l চা খেয়ে নেড়ো ফুলে-ফেঁপে উঠত– আর দাদু তাকে চামচ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে নিতl সে বিস্ময় আমার এখনো কাটেনি l এখন নেড়োগুঁড়ো ব্রেডক্রাম্ব হয়ে চপ কাটলেটে লেগে থাকে l কালিদাদুরা কি খায় এখন ?
আমার মা পাঁউরুটি খেলেই পেট ব্যথায় কষ্ট পায় । গ্লুটেন এলার্জি। ময়দায় সবচেয়ে বেশি থাকে । রাই, বাৰ্লি, ভুট্টা, মিলেট থেকেও পাঁউরুটি বানানো হয় । আসলে পাঁউরুটির এই ফাঁপা চেহারাটা গ্লুটেন, গ্লুটেনিন আর গ্লিয়াদিন এই তিন প্রোটিনের শৃঙ্খলিত হয়ে ওঠার খেলা। ভুট্টা, কাসাভা, চাল থেকে পাঁউরুটি করতে গেলে (গ্লুটেন বাদ দিয়ে ) তাহলে তার মধ্যে এই শৃঙ্খলের অভাব মেটাতে গুয়ার গাম, ডিম এইসব মেশাতে হবে । আমার তো মনে হয় তার চাইতে সরুচাকলি খেলেই হয়। হয় কি ?
ভারত, চিন, জাপান মানে পূর্বের এই ক’টা দেশ বাদ দিলে ব্রিটিশ আর স্পেন ফ্রান্স যেখানে যেখানে সাম্রাজ্য বিছিয়েছে, আমেরিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, পাঁউরুটির জয় জয়কার l আর লাস্ট সাপার ?যিশুখ্রিস্ট পাঁউরুটি আর ওয়াইন ভাগ করে নিচ্ছেন শিষ্যদের সঙ্গে !কখনও ভোলা যাবে ?
অল্প আলো সারা ঘরে। কাঠের চেয়ার টেবিল পাঁচ সাত । কাউবয় টুপির নিচে শক্ত চোয়াল, ঠোঁটে মেক্সিকান চুরুট । ফায়ারপ্লেসের পাশেই লম্বা টেবিলে ময়দার ডো আর পেনেলোপ ক্রুজ । এই ডো ময়দা আর জলের মিশে যাওয়া মুহূর্তের মত ইস্টের একটু ছোঁয়া। একটু একটু মাখনের আদর। সময় দাও । প্রেম পাকতে সময় লাগে । চোখের আড়ালে রাখো এই প্রেম আখ্যান । চাপা দাও ভিজে তোয়ালে। চার পাঁচ ছয় ঘন্টা। কখনও সাত আট নয়। সংসারের ধিকিধিকি আঁচে ওকে পরখ করো। সোনালি, বাদামী হয়ে উঠবে যদি সব ঠিকঠাক । পাঁউরুটি এক প্রেমকাহিনী ।
পুনশ্চ….. সকালটা মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার সময় বেকারির গাড়ি থেকে রোজ একটা নন স্লাইসড সিকি পাউন্ড । পাঁউরুটি ভাগ করে খাওয়া অবশ্য সভ্যতা !! ঠিক আছে, আমি অসভ্য !!!!
ধাবা স্টাইল কিমা।

পাঁউরুটি যদি মেইন কোর্সে থাকে? কিছু তো একটা চাই সঙ্গতে। ডিমের আপাদমস্তক তো অনেকেই জানেন কিন্তু ভালো কিমা দিয়ে পাঁউরুটি দেবভোগ্য। আর ধাবার থেকে ভালো কিমা কারী আমি সেভেন স্টার হোটেলেও পাইনি। ধাবা মানেই তাজা খাবার, আড্ডার মেজাজ, প্রাণখোলা হাসি গল্প, আন্তরিক পরিবেশন। ধাবাতে খেয়ে কারো পেটের গণ্ডগোল হয়েছে বলে শুনিনি।
তা পাঁচশো গ্রাম মোটা কিমা। রেওয়াজি অবশ্যই। হাড়ের পিস গুলোও নিয়ে নেবেন। কাজের জিনিস। এক কাপ চমৎকার ফেটানো দই, এক চামচ ফ্রেশ আদা রসুন বাটা, এক চামচ লঙ্কাগুড়ো, এক চামচ পুদিনা পাতা, এক চামচ ধনে পাতা। আধ চামচ ধনে গুঁড়া, একটু হলুদ। উন্নত জাতের দেশী গাওয়া ঘি বড় এক চামচ। আধ চামচ নুন। ভালো করে মিশিয়ে ঘণ্টা তিন চার।
একটা প্রেসার কুকার। দু চামচ সরষে তেল। ছোট্ট তেজপাতা। এক চিমটে গরম মশলা। নেড়ে চেড়ে কিমা। সামান্য জল। ঢাকনা লাগিয়ে পাঁচটা সিটি। বাকিটুকু দমে রাখুন।
তিনটে মাঝারি পেঁয়াজ, তিনটে অল্প ঝাল কাঁচালঙ্কা কুঁচিয়ে নিন। ধনে পাতার ডান্ডাগুলো ফেলে দেন নি তো? ওগুলোকেও ঝিরি ঝিরি করে কুঁচিয়ে নিতে হবে । এবার ফ্ল্যাট কড়াইতে সরষে তেল। বড় দু চামচ। তেলে ধোঁয়া বের হলে ওভেন থেকে সরিয়ে নিয়ে একটা বড় এলাচ, তিনটে শুকনো লঙ্কা, এক ইঞ্চি দারচিনি। দুটো লবঙ্গ দিয়েই দিন। মনের ওপর চাপ নেবেন না। রান্না দিনের শেষে জিভে আর মনে লেগে থাকা কিছুটা সময়। কোনও রন্ধনশৈলী কখনও কি পারবে শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় বৃষ্টিভেজা ছাঙ্গু লেকের পাড়ে ম্যাগীর স্বাদ অতিক্রম করতে? টাইম প্লেস আর পার্সন এই ত্রিকোণ তৈরি করে ম্যাজিক। রান্নাও তো ম্যাজিক। জীবনের উদযাপন।
গল্প করতে গিয়ে রান্না থমকে গেছে। করুণ চোখে তাকিয়ে আছে কড়া। ওকে পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে দিন। পেঁয়াজ মখমলি হয়ে এলে লঙ্কা কুঁচি। এক চামচ আদা রসুন বাটা, এক চামচ ধনে গুঁড়া। তেল ছাড়তে শুরু করলে এক কাপ ফ্রেশ টম্যাটো পিউরি। শীতকাল হলে টাটকা মেথি কুচনো অবশ্যই। পরিমাপ বুঝে নুন। এবার সেদ্ধ করা কিমা। ওহহহ কী সুগন্ধ। ধনেপাতার কুচোনো ডান্ডাগুলো মিশিয়ে নিন। টাটকা মেথি না দেওয়া হলে এক চিমটে কসুরি মেথি হাতে পিষে ছড়িয়ে দিন ওপর থেকে।মিনিট পাঁচেক কষিয়ে নিলেই সমাপ্তি। চার ফালি করে নেওয়া হাঁসের ডিম সেদ্ধ আর ধনেপাতা দিয়ে গার্নিসিং। এবার আর সভ্যতার দরকার নেই। ছুরি কাঁটা চামচ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দু হাতে মোলায়েম পাউরুটির সহযোগে কিমা কারি। বানিয়ে খাবেন। অবশ্যই। আমাকে ধন্যবাদ বলবেন। মনে মনে। প্লিজ।