Fragrance Shop

ছায়ানট -এর গবেষণায় খুশবুপ্রেমিক নজরুল

সম্প্রতি ছায়ানট (কলকাতা) – এর পক্ষ থেকে হাজি খুদা বখ্‌শ নবী বখ্‌শ – এর দোকানের বর্তমান সত্ত্বাধিকারী নিয়াজউদ্দীন আল্লাহ্ বখ্‌শ – এর হাতে স্মারক প্রদান করেন ছায়ানটের সভাপতি সোমঋতা মল্লিক। খুশবুপ্রেমিক নজরুল সম্পর্কে নজরুলপ্রেমীদের অবগত করার উদ্দ্যেশ্যেই ছায়ানটের এই উদ্যোগ।
ছায়ানট (কলকাতা) -এর পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিচিত্রা ঘোষ, গোপা দাস মজুমদার, গৌরী ধর, চম্পা মিত্র এবং মৃত্যুঞ্জয় মিত্র।

ছায়ানটের গবেষণায় উঠে এল নজরুলের জীবনের অজানা কথা। কলুটোলা রোডে অবস্থিত হাজি খুদা বখ্‌শ নবী বখ্‌শ – এর দোকান থেকে আতর সংগ্রহ করতেন গন্ধবিলাসী নজরুল। বর্তমান ঠিকানা- ৮৭, মাওলানা শওকত আলী স্ট্রিট (কলুটোলা), কলকাতা-৭০০০৭৩।  দোকানের বর্তমান মালিক জানালেন,
২০১ বছর ধরে কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই সুগন্ধীর দোকান আমাদের ঐতিহ্য। ১৮০০ সাল নাগাদ লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় আসেন শেখ জান মোহাম্মদ, তাঁর পুত্র হাজি খুদা বখ্‌শ এবং পৌত্র হাজি নবী বখ্‌শ। কলকাতার বেলেঘাটায় আতর তৈরীর কারখানা স্থাপন করেন। শিয়ালদহ অঞ্চলের বৈঠকখানায় তৈরি করেন বসবাসের জন্য বাড়ি। এখনও সেই বাড়ি বিদ্যমান। ১৮২৪ সালে কলুটোলা রোডে এই দোকানের পথচলা শুরু হয়। এই দোকানের বর্তমান সত্ত্বাধিকারী নিয়াজউদ্দীন আল্লাহ্ বখ্‌শ – এর কাছ থেকে জানা যায়, সুগন্ধপ্রেমী নজরুল বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আতর সংগ্রহ করার জন্য এই দোকানে আসতেন। স্বাভাবিকভাবেই কবিকে একটিবার দেখার জন্য লোকসমাগম হত, কবিও তাতে বিব্রতবোধ করতেন কিন্তু আতরের প্রতি ভালোবাসা এতোটাই প্রবল ছিল যে নিজে না দেখে আতর কিনতে তিনি পছন্দ করতেন না।

নজরুলের পছন্দের আতরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – রজনীগন্ধা, রুহ্ গুলাব, রুহ্ খস্ (গ্রীষ্মকালীন সময়ে ব্যবহার করতেন) এবং শমামা (শীতকালীন সময়ে ব্যবহার করতেন)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মতিলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নজরুলও এই দোকানে নিয়মিত হাজির হতেন সুগন্ধীর টানে। পুষ্পপ্রেমী নজরুলের রজনীগন্ধার প্রতি বিশেষ আকর্ষন ছিল। এ এফ এম হায়াতুল্লাহ্ ‘অন্যরকম নজরুল’ প্রবন্ধে লিখেছেন – “তিনি ফুল অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ফুল নিয়ে তাঁর কতরকম গান-কবিতাই না আছে। ফুলের বন্দনাকারী এই অনন্যসাধারণ কবির বিশেষ ফুল ছিল রজনীগন্ধা।” রজনীগন্ধাকে নিয়ে একটি গানও রচনা করেন নজরুল ‘ওরে শুভ্র-বসনা রজনীগন্ধা’। গানটির সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। ১৯৩৯ সালে শিল্পী পদ্মরাণী চ্যাটার্জী এই গান রেকর্ড করেন। রজনীগন্ধার গন্ধে মাতাল কবি লিখলেন –

করুণ শুভ্র ভালোবাসা তোর
সুরভি ছড়ায় সারা নিশি ভোর,
প্রভাত বেলায় লুটাস ধূলায় যেন-কারে নাহি পেয়ে।।

ছায়ানট – এর পক্ষ থেকে হাজি খুদা বখ্‌শ নবী বখ্‌শ – এর দোকানের বর্তমান সত্ত্বাধিকারী নিয়াজউদ্দীন আল্লাহ্ বখ্‌শ – এর হাতে স্মারক প্রদান করেন ছায়ানটের সভাপতি সোমঋতা মল্লিক

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক বাঁধন সেনগুপ্ত তাঁর ‘সমগ্র নজরুল জীবন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন –  “প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তিনের দশকে পেশাগত জীবনে কবি যখন প্রতিষ্ঠিত তখন পোশাক- পরিচ্ছদ, সাজগোজ ও বিলাসিতার প্রতিও ক্রমশ তাঁর আকর্ষণ নজরে পড়ে। সাজগোজের ব্যাপারে তিনি তখন সত্যি বেশ সচেতন। তাঁর প্রিয় সাবান ছিল তখন Lux Toilet Soap। প্রিয় খবরের কাগজ ছিল The Statesman। জুতো কিনতেন কলেজ স্ট্রিটের Radu-র দোকান থেকে। পরতেন প্রধানত গরদের পাঞ্জাবি, ধুতি, মাথায় গেরুয়া গান্ধি-টুপি এবং চোখে গোল-চশমা। প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে বেরোবার আগে সাজগোজে নজরুলের সময় লাগত প্রায় মিনিট পনেরো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাট পাট করে কবি চুল আঁচড়াতেন, দামি সেন্ট ছিটোতেন পরনের পাঞ্জাবির গায়ে। পান খাওয়া ছিল কবির প্রধান বিলাসিতা। একসঙ্গে নিয়মিত গোটা চার-পাঁচ খিলি পান মুখে পুরে নিয়ে সঙ্গে খেতেন শৌখিন দামি জর্দা। বাথরুমে ঢোকাকালে কবির হাতে থাকত প্রভাতি দৈনিক পত্রিকা যা শেষ করে তিনি বেরিয়ে আসতেন প্রতিদিন স্নানের ঘর থেকে।”

নজরুল তাঁর প্রতিদিনের জীবনে যে সমস্ত প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করতেন তার বিবরণ পাওয়া যায় নজরুল গবেষক আসাদুল হকের লেখা ‘অন্তরঙ্গ আলোকে নজরুল ও প্রমীলা’ গ্রন্থে – “কবি-পত্নীর সঙ্গে আলোচনাকালে জেনেছিলাম কবি খবরের কাগজ পুরোটাই পড়তেন এমন কি বিজ্ঞাপন গুলো পর্যন্ত। হাসতে হাসতে বলেছিলেন মুখস্থ ধরলে পাতার পর পাতা বলে দিতে পারতেন। টয়লেট থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যেতেন গোসল খানায়। ঠান্ডা পানিতে গোসল করে একটি বড় রকমের টার্কিস টাওয়েল গায়ে জড়িয়ে চলে যেতেন শোবার ঘরে। প্রথমে সারা গায়ে ভালো করে বডি পাউডার লাগাতেন এবং বড় হাতাওয়ালা গোল গলা সাদা গেঞ্জি পরতেন। ইস্ত্রি করা কাপড় পরে তিনি দাড়ি কামাতেন। দাড়ি কামাতেন হয় ক্ষুর দিয়ে কিম্বা জিলেট রেজার ও ব্লেড দিয়ে। দাড়ি কাটার পর সুন্দর করে মাথায় তেল লাগাতেন ও পরিপাটি করে চুল আঁচড়াতেন। মুখে স্নো লাগাবার পর পাঞ্জাবি গায়ে দিতেন। এসব থেকে বোঝা যায়, কবির শৌখিনতার কথা। কারণ যে সব প্রসাধন সামগ্রী কবি ব্যবহার করতেন সেগুলো তৎকালে শ্রেষ্ঠ সামগ্রী ছিল।

কবির স্ত্রীর সঙ্গে আমি আলোচনাকালে এই প্রসাধন সামগ্রীর নামগুলো কিছু কিছু উদ্ধার করেছিলাম। কবি ফোরহ্যান্স টুথপেস্ট, ল্যাভেন্ডার কিম্বা পিয়ার্স গ্লিসারিন গায়ে মাখা সাবান, ওটীন ক্রীম কিম্বা হেজলীন স্নো, ক্যালিফোর্নিয়া পপি কিম্বা জবাকুসুম মাথার তেল ব্যবহার করতেন। ইভিনিং ইন প্যারিস সেন্ট, কিউটি কিউরা বডি পাউডার, পন্ডস্ ফেস পাউডার এসব সামগ্রী বেশি ব্যবহার করতেন। রাত্রে শোবার সময় মুখে মারকুলাইসড ওয়াক্স ব্যবহার করতেন। শীত, গ্রীষ্ম সবসময় সুগন্ধীযুক্ত রুমাল ব্যবহার করতেন।”

বিশিষ্ট গবেষকদের লেখায় এভাবেই উঠে এসেছেন শৌখিন নজরুল। আশৈশব সংগ্রামের মাঝেও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবন বেঁচেছেন নিজের শর্তে। চরম অর্থকষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েও তিনি জীবনযাপনে যথেষ্ট রুচির পরিচয় দিতেন। নজরুল চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি সকলের সামনে তুলে ধরতেই ছায়ানটের এই বিশেষ উদ্যোগ। ২০০ বছর অতিক্রম করে নজরুলের প্রিয় আতর ‘রজনীগন্ধা’ আজও সুবাস ছড়াচ্ছে কলকাতার বুকে – এই তথ্যই উঠে এসেছে ছায়ানটের গবেষণায়।