Smiling

থার্টি টু – অল আউট

না, এ কিন্তু ক্রিকেটের স্কোর নয়! এ হল ‘দন্তরুচি কৌমুদী’ – চলতি কথায় দাঁত ক্যালানো। কান এঁটো করা হাসি- প্রচন্ড আনন্দে যা বেরিয়ে আসে, একেবারে ফোটা পদ্মের মতো। হাসি এখন আর পাই কোথায়! সে এখন খুবই দুষ্প্রাপ্য, একেবারে বাঘের দুধের মতো। কারও কপালে দেখি চিন্তার ভাঁজ, কেউ গম্ভীর মুখে ল্যাপ্‌টপ্‌ বা ডেস্কটপের সামনে, কেউ বা ব্যস্ত গুরুগম্ভীর আলোচনায়, কেউ পৃথিবীর সব কিছু ভুলে চিন্তামগ্ন হয়ে মোবাইল ঘেঁটে যাচ্ছে, কেউ মাথা ঘামিয়ে মরছে কী করে অন্যকে বংশদণ্ডটি দেবে। কোথাও নেই এতটুকু হাসি। কিন্তু হাসির অস্তিত্ব রয়েছে সর্বত্র, সব যুগেই।

সেই কোন কালে ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছিলেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর –
‘‘ভূতনাথ ভূতসাথ দক্ষযজ্ঞ নাশিছে
যক্ষ রক্ষ লক্ষ লক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে।’’
ভূতপ্রেত, রাক্ষস অট্টহাসি হেসে দক্ষযজ্ঞ নাশ করেছিল কিনা ঠিক জানা নেই। তবে যাত্রাপালায় দেখেছি অট্টহাসির রম্‌রমা। যত অট্টহাসি, তত হাততালি।

আমাদের পাড়ার স্যাঙ্কোদা ওরফে সংকলন পাঁজা হলেন অট্টহাসির যথার্থ প্রতিনিধি। তার হাসি শুনে কুকুরের ডাক থেমে যায়, চুপ করে যায় কাকও। পাড়ায় তার চালু নাম স্যাঙ্কো হাহা। একদিন বগলাদার চায়ের দোকানে বসে একটা কথায় এমন হাসি দিলেন যে খদ্দেরদের কাপের চা পড়ল চল্‌কে। দোকানদার বলল – ‘‘দাদা হাসবেন, তবে টিনের শেড্‌টা ভেঙে ফেলবেন না।’’ চারতলা বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে যক্ষ রক্ষের মত ‘হা হা হা হা’ হাসি যদি হাসেন স্যাঙ্কোদা, তো পাশের ছাদ থেকে স্যাটেলাইট ডিশ পড়ে যায়। সেই হাহাকার হাসিতে মঞ্চ কাঁপে, বিয়েবাড়ী জমে। কিন্তু সমস্যা হল পাশে বসলে কানের পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়। হাসির যে কত প্রজাতির, তার নেই ঠিক।

smiling Oldman

মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখা পাশের বাড়ীর ঠাকুমার কথা। দন্তহীন বুড়ী ঠাকুমা বসে থাকতেন বাড়ীর সামনের সিঁড়িতে। মুখে সব সময় ঝুলত হাসি। যাতায়াতের পথে কেউ তাকালেই হেসে উঠতেন। সেই ফোকলা হাসির আহ্লাদ দেখে লোকজনও না হেসে পারত না। আমাদের পাড়ার দুর্গাপূজোর সেক্রেটারি, অনেক নেতার স্নেহধন্য টপকা মিত্তিরের ঠোঁটের কোণে সবসময় থাকে কেমন একটা বাঁকা হাসি। গুমোরের চোটে সে বাঁকা হাসি আর সোজা হয়না। কাউকে নিজের সমকক্ষ বলে মনে করে না। নিজের অদ্ভুত সব ‘জোক্‌স’-এ নিজেই হাসে একটা আত্মপ্রসাদী হাসি। অন্য কেউ না হাসলেও কিছু এসে যায় না তার। প্রেসিডেন্ট আবার হাসেন গর্বের হাসি। অবসরপ্রাপ্ত, প্রবীণ ভূতনাথ বাবুকে বসানো হয়েছে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে। তা সেই চেয়ারে বসে একে-তাকে অর্ডার করা, ভুরু কুঁচকে ভেবেচিন্তে মতামত দেওয়া গর্বের ব্যাপার বৈকি। বইমেলায় একটা প্যাভেলিয়নে চলছে জোর সাহিত্য আলেচনা। বক্তাদের মধ্যে রয়েছেন উঠতি বেশ বেশ কিছু ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ লেখক। দর্শকাসনে বসা এক ভদ্রলোক প্রতিটি বক্তব্যে হাসছেন। এক কবি বললেন – ‘‘নিঃসঙ্গতা আসলে নিজেরই ছায়া।’’ আবার হাসলেন দর্শক ভদ্রলোক – কী দার্শনিক ন্যারেশন! আরেক বক্তা কোন এক লেখকের লেখার বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন – ‘‘প্রতিটি শব্দ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে মনস্তত্বের ঢেউ।’ হাসলেন সেই ভদ্রলোক।

পাশে বসা স্ত্রী বললেন – ‘‘সব বুঝে হাসছ?’’

ভদ্রলোক গম্ভীর ভাবে বললেন – ‘‘না বুঝে হাসতে পারা এক ধরনের আধুনিকতা।’’

বিরক্ত স্ত্রীর মন্তব্য – ‘‘তুমি তো দেখছি আঁতেল হাসির মহারাজা।’’

Old man

আমাদের পাড়ার বিশে ওরফে বিশ্বনাথ ঘড়াই ফুটপাথে বসে কচুরি ভাজত, সঙ্গে করত আলুর তরকারি। তা এ ব্যবসায় ঢেলে দিলেন মা লক্ষী। দোকান করল বিশে। দেখতে দেখতে দোকান যত বড় হল ততই বাড়ল বিশের কান এঁটো করা হাসি। শুনেছি একটা ফ্ল্যাটও কিনে ফেলেছে। দোকানে রমরমা বিক্রি কচুরি, মিষ্টি, দই-বড়া, চপের। চারটে কর্মচারী দোকান সামলায় এখন। তার বর্তমান স্ট্যাটাস – পায়ের ওপর পা তুলে একটা গদি মোড়া চেয়ারে বসে থাকা। আর খদ্দের এলে মিষ্টি হাসি হেসে অভ্যর্থনা করা। ইউ টিউবে নিজের দোকানের ব্লগও দিয়েছে বিশে। ওর ক্লাস সেভেন অব্দি পড়া বিদ্যে নিয়ে কে আর এখন মাথা ঘামাচ্ছে! তা হিংসের চোটে কিছু লোকের চোখ তো টাটাবেই।

পাড়ার প্রবীণ উকিল সিংহপ্রসাদ ঘোষাল এলেন কচুরি আর চপ্‌ কিনতে। ওকালতির বহু বছর পার করেও সিংহবিক্রমে বুক ফুলিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারেননি। আসলে পসারটাই ঠিক জমেনি যে। তাকে দেখে এগিয়ে এল বিশে –

‘‘কেমন আছেন কাকু?’’

‘‘চলে যাচ্ছে কাজকর্ম নিয়ে। তুমি তো এখন খুবই ব্যস্ত মানুষ হয়ে উঠেছ দেখছি।’’

‘‘এই চলে যাচ্ছে আপনাদের আশীর্বাদে।’’

মুখে একটা অদ্ভুত হাসি নিয়ে মার্জিতভাবে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলেন সিংহপ্রসাদ –‘‘আরে তুমি তো গুণী লোক হে। কচুরি, তেলেভাজা, চপ ভেজেই গাড়ী-বাড়ী, ইউ টিউবে ইন্টারভিউ, ফেস্‌বুকে ফেমাস্‌। এখন কারোর আর পড়াশোনার দরকার হয়না। হেঃ, হেঃ, হেঃ, হেঃ …।’’

ব্যঙ্গ হাসির পেছনে বিদ্রূপের ছুরিটা বুঝেই এতক্ষণ মুখে একটা চাপা হাসি ধরে রেখেছিল বিশে। এবার একটা শান্ত হাসি দিয়ে বলল –”ঐ, সবই আপনার আশীর্বাদ কাকু।’’

কাষ্ঠহাসি হেসে বিদায় নিলেন সিংহবাবু। এই বিশেই আবার প্রেমে পড়ল সিংহ উকিলের ছোট মেয়ে প্রহেলিকার। বিশের দোকানের খাবার তার খুব পছন্দ। সেদিনের পর থেকে সিংহবাবুকে আর বীরদর্পে ঢুকতে দেখা যায়নি দোকানে।

প্রহেলিকাই আসে আর প্রেমের স্বপ্নে ভাসে বিশে। লাজুক হাসি দিয়ে আড়চোখে প্রহেলিকা তাকায় বিশ্বনাথের দিকে। আর বোকা বোকা হাসি হেসে বিশে কর্মচারীদের বলে তাড়াতাড়ি প্রহেলিকার খাবারগুলো প্যাক করে দিতে।

মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায় প্রহেলিকা। সে হাসির মানে বুঝতেই পারে না বিশে। প্রেমের প্রথম পাঠে কিন্তু দারুণ ভূমিকা রহস্যের ঘেরাটোপেভরা এই মুচকি হাসির। এ না মুখর, না নীরব – খুবই কূটনৈতিক। কিছু না বলেও অনেক কিছু বলার একটা আর্ট। বোঝা মুশ্‌কিল যে, সে হাসি খুশির না কাউকে কাঁটা মারার। সে যাই হোক – আমার চিন্তা বিশের প্রেমটা তার প্রেমিকার নামমাহাত্ম্যে প্রহেলিকা হয়েই না রয়ে যায়।

smiling women

কিছুদিন ধরেই দেখছি, আমার ভাইঝি কথায় কথায় খিলখিল করে হেসে উঠছে। শুধোলুম –

‘‘কি রে, হল কী তোর! প্রেম করছিস নাকি?’’

আবার সেই খিলখিল হাসি। উৎসাহ পেয়ে এগোলুম একটু– “আমাকে বলতে পারিস, কেউ জানবে না।’’

হো হো করে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল তুতান।

‘‘না গো পিসিমণি, আমি একটা লাফিং ক্লাবের মেম্বার হয়েছি। সেখানে বলে – বুক ভরে, প্রাণ খুলে হাসতে হবে। এতে পেটেরও ব্যায়াম হয় আর হাঁ মুখ দিয়ে মাথায় বাতাস ঢোকে। যত বেশি হাসি, তত কম ঝামেলা। হাসি যে লাইফের ব্রেক ডাউন সারানোর মেকানিক। তুমিও প্রাণভরে হাসো, হোল লাইফ নট – আউট থাকবে।’’

ওর কথা শুনে মুখ হাঁ করেই হেসে ফেললুম। সে হাসি নির্মল আনন্দের।