সেই সময় অনেকেরই ধারণা ছিল কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই খুব হাল্কা চালের মানুষ ছিলেন। সবার সঙ্গে সবসময় বুঝি ঠাট্টা-ইয়ার্কি নিয়েই থাকেন। এমন আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, উনি বাড়িতে কেমন? কিন্তু এটা সত্যি, বাস্তবে উনি খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন। বাড়ির সবাই শুধু নয়, পাড়ার সবাই তাঁকে খুব সমীহ করে চলত। আবার তেমনি বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। ওঁর নেশা ছিল বিড়ি খাওয়া, কিন্তু কখনোই বড়দের সামনে নেশা করতেন না।
ওঁর স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। যে কোনও বিষয়ের সাল, তারিখ যেমন গড়গড় করে বলে দিতে পারতেন, তেমনই কোনও জিনিস না জেনে কখনও তা নিয়ে কারোর সঙ্গে তর্ক করতেন না। স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলা, কথা দিয়ে কথা রাখা, কোনও কাজের দায়িত্ব নিলে তা নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করা ছিল ওঁর বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই সব আদর্শের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমরা হিমশিম খেতাম।
বিয়ের পর থেকে দেখেছি কারও বিপদ শুনলে, সে শত্রু বা মিত্র যে-ই হোক না কেন, ছুটে যেতেন সেখানে। কোথাও বেড়াতে যাবার কথা থাকলে সে সময় যাওয়ার কথা, তার এক ঘণ্টা আগেই আমাদের তাড়া শুরু করতেন। তাতে বেড়াবার আনন্দটাই মাটি হয়ে যেত। কারণ নিজেও যেমন সাজগোজ করতেন না, আমাদেরও সে অবকাশ দিতেন না। এমনকী কোনও গানের জলসা, রেকর্ডিং-এর সময়ও এক ঘণ্টা আগে গিয়ে বসে থাকতেন।

আমার শাশুড়ি বলতেন, “মিনমিনে পুরুষ আর মিনমিনে গলা মোটেই পছন্দ করি না।”
তবে তাঁর ছেলের গলা সম্বন্ধে আর নতুন করে কিছু বলবার নেই। তবু দু-একটা কথাতে আরও স্পষ্ট করে বোঝা যাবে ব্যাপারটা।
একদিন উনি কারও সঙ্গে ফোনে খুব জোরে জোরে কথা বলছেন, এমন সময় আমার মেয়ে বাসৰী জিজ্ঞাসা করল, “বাবা, তুমি যাঁর সঙ্গে কথা বলছ, তিনি কোথায় থাকেন?”
তার বাবা উত্তর দিলেন, “রাসবিহারীতে। কেন?”
বাসবী বলল, “তাহলে তুমি এমনি কথা বললেই তিনি শুনতে পেতেন। ফোনে কথা বলার দরকার ছিলনা। কাজেই বুঝতে পারছেন কেমন ছিল ওঁর গলা।
ওর সঙ্গে বিবাহের আগে আমি তখন গান শেখার জন্য সিদ্ধেশ্বর মুখার্জি(মধুদা)র কাছে যেতাম। তাঁর বাড়িতে আমরা শিক্ষার্থীরা ছাড়াও মধুদার দু‘চার জন বন্ধু-বান্ধবকে উপস্থিত থাকতে দেখতাম। সেখানে আমি ওঁকে বিয়ের আগে দু–একদিন দেখেছি।
অবশ্য বিয়ের পর অনেকের মুখেই শুনেছি আমরা নাকি নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছি। কিন্তু কথাটা একেবারেই সত্যি নয়। কারণ গান শেখার জন্য সময় ওইসব কিছুর অবকাশ ছিল না। যদিও আমার গান শেখার ক্ষমতা ছিল খুব বেশি। কিন্তু আমি খুবই লাজুক এবং স্বল্পভাষী ছিলাম। তাছাড়া অত লোকের ভিড়ের ওঁর ওই ২৮ ইঞ্চি বুকের ছাতির উপস্থিতি খুব একটা চোখে পড়ার মতো ছিল না…(হা হা হা)।