‘তারিফ করু ক্যা উসকি/জিসনে তুমে বানায়া’–একদম ঠিক ধরেছেন। নীল আকাশ, তুষারধবল পর্বতমালা, পাইন-ফার-উইলো-পপলারের সবুজ বন, মখমলের গালিচার মতো ময়দান, সবজে-নীল লিডার নদী, আঁকাবাঁকা ঝিলম নদী, মাঝেমধ্যে তুষারপাত। এর মধ্যে গেলেই মনে পড়ে যায়, আমির খসরুর সেই পংক্তি—আগর ফিরদৌস বার রু-ইয়ে জমিনস্ত/ ওয়াহামিনস্ত, ওয়াহামিনস্ত, ওয়াহামিনস্ত। বাংলায অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই এখানেই এখানেই।
সেই স্বর্গ দেখতে পীর পঞ্জলের কোলে প্রথম যাওয়া ১৯৮২ । ক্লাস সেভেন। এমন সুন্দর মানুষ হতে পারে? চশমাসাহি, নিশাত বাগ, শালিমার বাগ, ডাল লেক….. যেন স্বপ্ন সফর। তখন অমনই ছিল। বা হয়তো আমার কিশোর মনের বিভ্রম। চোখে ঘোর তখনই। বোরোলিন মেখে জীবনের ওঠাপড়া সামলাতে গিয়ে সব ভুলের ওপারে। কাশ্মীর আমার কাছে চিরকালীন রোমান্টিসিজমের আরেক নাম। যতই আজ সেখানে আতঙ্কের ছায়া এখানে ওখানে। প্রায়শঃই। তবুও মন কেমন করে আজও। আজ একটু ফিরে দেখার দু চার কথা।
অনেকগুলো বছর পেরিয়ে হিমগিরি এক্সপ্রেস থেকে নামা। জম্মু স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়ি। চরইবেতি। মনে হয় ২০০৬ সাল। এপ্রিল-মে। আমি আর শ্রীমতি, সঙ্গে পিঙ্কু আর ঝুলন ভূস্বর্গে সপ্তম স্বর্গে। গুলমার্গে প্রবল ঠান্ডা আর অসময়ে তুষারপাত। সেই পাটনিটপ থেকে শুরু হয়েছে। ফেরার পথে জম্মুর পন্ডিত ড্রাইভার ‘নাস্তে কে লিয়ে’ দাঁড় করাল এক সরাইখানাতে। আলুপরোটা শেষ করে কফির অর্ডার দেব। দেখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা লম্বা, ফর্সা, টিকালো নাকের কাশ্মীরি আবালবৃদ্ধ– সোনালী এক পানীয় হাতে। মাঝে মাঝে আয়েশ করে চুমুক আর মিষ্টি গরমমসলার আঘ্রাণে চারিদিক ম ম। আমারও চাইl ওটা কাওয়া।
সেকি! কাওয়া তো মধ্যপ্রাচ্যের এক আয়ুর্বেদিক পানীয়। পাথুরে নুনের আবশ্যিকতায় যা লবনাক্ত। যেমন তিব্বতী মাখন চাl আরে না না। এ হল কাশ্মীরি কাওয়া। দেবভোগ্য। খেলে গা গরম। ক্লান্তি হাওয়া। মাথা তরতাজা। প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। প্রায় বিশল্যকরণী। নীরোগ ত্বক। রক্তশুদ্ধি। সোনালী উষ্ণতায় এক চুমুক দিয়েই মনে হল, ঝিমঝিম মাথায় একটা তরঙ্গ। কাশ্মীরি কাওয়ার সঙ্গে সেই আমার প্রথম আলাপ।
আসলে শরীর গরম করার জন্যে এগুলো কাশ্মীরিদের নিজস্বতা। কাংড়া ক্যান্সার দেখেছিলাম ডা অরোরার সার্জারি আউটডোরে। জ্বলন্ত কাঠকয়লার পাত্র পেটের ওপর বেঁধে রেখে মৃতপ্রায় ইউনূসের অবাক চাউনি এখনও মনে পড়ে। তেমনই কাওয়াতে রদবদল করে এই উপভোগ্য জাফরানি রঙা কাশ্মীরি কাওয়া। নিছক চা ভেবে একে তাচ্ছিল্য করা যাবে না। পশমিনা, আখরোট, সোনালী আপেল, আদিগন্ত টিউলিপ, ডাল-নাগিনা লেক, জাফরান, সোফিয়া লোরেন দের দশগোল দিতে পারার মতো সুন্দরীরা চিনারের ঝরাপাতা নিয়ে ঝগড়া এমনকী মারামারি,….. এর মধ্যেই পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও …..এখানে…… এখানেই।

এক চামচ হালকা গরম জলে ভালোবাসার মতো একটু জাফরান। একটা পাত্র দুকাপ জল দিয়ে আগুনে। মৃদু আঁচ। চাইলে পাখতুন স্টাইলে তামা বা পিতলের ছোট ডেকচিও চলবে। আধ ইঞ্চিটাক দারচিনি, দুটো ঘা খাওয়া ছোট এলাচ, বড় এলাচের পাঁচ ছয়টা দানা, একটা সহৃদয় লবঙ্গ, কাবাবচিনি গোটা দুই, দুচামচ কাশ্মীরি গ্রীন টি। তিন চার মিনিট বুদ্বুদ । ওরা যেন মিলেমিশে যায়…… নাড়াচাড়া করতে থাকুন পুরো সময়টা। মিনিট তিনেক পর ছেঁকে নিন। ছোট হামানদিস্তে তিন চারটে আমন্ড বাদাম আর এক টুকরো আখরোট ভালো করে গুঁড়ো করে ওতে মিশিয়ে দিন আর দু চামচ মধু। ডাল লেকের পদ্মমধু কিন্তু বিখ্যাত। জাফরান ভেজানো জলটা আদর করে মিশিয়ে একটু নাড়লেই জাফরানি রংবাহার। আমার ম্যাজিক টাচ এক চিমটে সুক্ষভাবে কুঁচোনো আদা। প্রিয় মানুষকে এক কাপ আর নিজের এক কাপ। পরিবেশনের সময় দু তিনটে কেশর ভাসিয়ে দিন কাপে। অস্তরাগের ছোঁয়া গালে, একটু অবিন্যস্ত চুল, চোখে চোখ, আলতো চুমুক……. শিবকুমার শর্মার সন্তুরে পাহা়ড়ি ধুনে, পীরপঞ্জালের ছায়া।
জলখাবারের পর, মধ্যাহ্নভোজনের পর সাদা পোর্সিলিনের বড় কাপে কাওয়া এগিয়ে দিয়ে বাবলু আলমের বৌ শবনম বলেছিলো…… লাহাবী (যাহাবী) কাবাব আউর কাওয়া হামারি রিস্তে কি সাথ আয়শা জুড় যাতে হায় কি ক্যা বাতাউঁ। ইংল্যান্ড হলে বলতো রেজুভিনেটিং ড্রিংক। আমার কাছে শ্রীনগর, গুলমার্গ, পহেলগাওঁ, ববি…… বেতাব……কাশ্মীরি কাওয়া….. পঞ্চেন্দ্রিয়র কনসার্ট। আমি তো মাঝেমধ্যে গোলাপের শুকনো পাপড়ি দিয়ে দিই দু তিনটেl কাশ্মীরি গুলাবী চায়ে খেয়ে দেখেছি….. গোলাপের পাপড়ির সমাহার… ওরা বলে নুন চা। আমার তেমন ভালো লাগেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে কাওয়া মানে কফি। কাশ্মীরি কাওয়াতে কিন্তু ক্যাফিন নামমাত্র। ঘুমের বিন্দুমাত্র সমস্যা হবে না। নিশ্চিন্তে পান করুন। কাওয়া পান করুন… সুখে শান্তিতে থাকুন।
বাবলু আলমের বিয়ের অ্যালবাম দেখছিলাম। প্রকাণ্ড থালার চারপাশে পাঁচ/সাত জন। এমন প্রায় গোটা চল্লিশ থালায় একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলছে। বাবলু ভারি সুদর্শন। তার ওপর হাসলে বাম গালে টোল পড়ে। তাই মাঝে মধ্যে ও মৃদু হাসি উপহার দিয়ে থাকে। বললো…. ওয়াজয়ান। মানে? এক একটা ভেড়া জবাই করা হয় আর তার মাংসের বিভিন্ন অংশ দিয়ে হয় অন্তত দশ থেকে ছত্রিশ পদ একটা থালায় রাখা হয়। একসঙ্গে একাধিকজন সেই থালা থেকে খাওয়াদাওয়া করে। সেই থালায় থাকে হরেক রকমের কাবাব থেকে মেথি মাজ, রিস্তে, নাদির (পদ্মের নাল) থেকে তৈরি নিরামিষ, রোগন জোশ। সংগে ভাত, পোলাও আর রুটি নানান কিসিমের। আমার দাওয়াতে ছিলো পঁচিশ রকম। সবই কিছুটা করে ওই থালায় দেওয়া হয়। ওই পাত্রের নাম ট্রাম। তামার তৈরি। কী কান্ড। আমাদের চোখ ছানাবড়া। অত কিছু না হলেও বাবলুর সুন্দরী বিবি নাফিসা আমাদের মাটন রোগন জোশ বানিয়ে খাইয়েছিল। চলুন, বানিয়ে ফেলা যাক।

যারা মাংস ম্যারিনেট করা আর ঘি দিয়ে কষার গল্প বলে, তারা কাশ্মীরি রান্না জানেই না। গনগনে কিংবা ঢিমে আঁচে নিজস্ব ধাঁচে সেদ্ধ করে রান্না, কাশ্মীরি ট্র্যাডিশন। ওরা রতন জত ব্যবহার করে। এখানে কোথায় পাবো? তাই টকটকে লাল রোগনের জন্যে মোরগঝুঁটি ফুল। মাংস চাই তাজা। একটু বড় বড় টুকরো। একটা বড় ডেকচিতে খানিক সরষের তেল। লবঙ্গ, বড় এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচ আর তেজপাতা। একটু নাড়াচাড়া করে মাংস। গনগনে আঁচ। ওপাশের বার্নারে আরেকটা পাত্রে জল দিয়ে মোরগঝুঁটি ফুলক’টা ফুটতে দিন। চাপা দিয়ে। খানিকটা দই, জাফরান, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, অল্প সা মরিচ গুঁড়ো আর সামান্য হলুদ। ভালো করে ফেটিয়ে নিন। মাংস রঙ বদলেছে। ওতে মিশ্রণটা ভালো করে মিলিয়ে নিন। ভিজিয়ে রাখা মাথানিয়া মির্চ পেষ্ট করে রাখুন আর চামচ তিন বেরেস্তার পেষ্ট মানে ব্রাউন পেঁয়াজ ভাজার পেষ্ট। কাশ্মীরি রীতি অনুসারে ওরা প্রাণ (ওখানকার একরকম মুড়ি পেঁয়াজের ডাঁটা সমেত) এর পেষ্ট ব্যবহার করে। কিন্তু নেই মামার চেয়ে কানা মামা সবসময় ভালো। মোরগঝুঁটির জলটা ছেঁকে নিন কাপড়ের সাহায্যে (ফুলের দানা বা লোম মুখে পড়লে খাওয়াটাই বরবাদ)। মাংস থেকে মশলার গন্ধ ম ম করছে? এবার ওতে টকটকে লাল ফুলের ঝোলটা মিশিয়ে নিন। মিনিট পাঁচ পরে লঙ্কার পেষ্ট। আরো দশ মিনিট পর পেঁয়াজের পেষ্ট। মাঝে মধ্যে একটু হাতা দিয়ে ভালবাসা মিশিয়ে দিন রান্নায়। মাংস মোটামুটি সেদ্ধ হয়ে এলে আর ঝোলটা মাখামাখা হয়ে এলে আর নামিয়ে নিন। একদম কচি পাঁঠার ঝোলের মতো নরম মাংস নয়। আপনার দাঁত আছে, মাংস যেন ভুলে না যায়। আর কী? এবার খাওয়ায় মন দেওয়া যাক। আমার তো সাদা তিল ছড়ানো মখমলী নান দিয়েই বেশি ভালো লাগে। আপনার?
বাবলু আর নাফিসা ভালো থাকুক। উপত্যকা সেরে উঠুক তার কঠিন অসুখ থেকে। পশমিনা গায়ে দিয়ে শিকারা থেকে ফুল কিনুক উচ্ছ্বল পর্যটক। আর অরবিন্দ স্বামী মধুর দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠুক ‘ইয়ে হাসিন বাদিয়া/ ইয়ে খুলা আসমা/ আ গায়ে হাম কাঁহা……।