বাংলার ফুটবল বলতেই আবেগ-ভালোবাসা, আন্তরিকতা আর বন্ধুত্ব নিয়ে গর্বের ইতিহাস রচনা হয়েছে৷ তারপরে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল মুখোমুখি হলে সেই উত্তেজনার পারদ যেন পাহাড়ের শিখরে ধাক্কা খায়৷ সমর্থকদের উন্মাদনা আছড়ে পড়ে সারা বাংলা জুড়ে৷ বাজারে অমিল হয়ে যায় চিংড়ি ও ইলিশ মাছ৷ দুই প্রধানের লড়াই বলতে ডার্বি ম্যাচের আস্ফালন চোখে পড়ে ফুটবল রণক্ষেত্রে৷ সারা গ্যালারি গমগম করে সমর্থকদের চিৎকারে৷ টানা নব্বইটা মিনিট বীর ফুটবল সৈনিকদের দাপাদাপিতে ডার্বি ম্যাচ টগবগ করে ফুটতে থাকে৷ আর এই ডার্বি খেলায় দুই প্রধানের হয়ে চ্যালেঞ্জ জানাতে সম্মুখ সমরে বাংলার দামাল ফুটবলাররা বাজি ধরেন৷ সেই মহারণ থেকে বাংলার ঘরের ছেলে মহানায়ক হয়ে শিরোনামে উঠে আসেন৷ এটাই তো ডার্বি ম্যাচের গরিমা৷ বাংলার ডার্বি তাই তো এশিয় মহাদেশে সেরা হিসেবে স্বাকৃতি পেয়েছে৷ এতো ফুটবলপ্রেমী অন্য কোথাও, কোনও ডার্বি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চোখে পড়ে না৷
‘সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবল’— সেই মান্না দে’র গানটা হারিয়ে গিয়েছে৷ বাংলার ফুটবলকে গ্রাস করেছে বিদেশি এবং ভিন রাজ্যের ফুটবলাররা৷ তাই তো ডার্বি ম্যাচে দূরবীণ নিয়ে ঘরের ছেলেদের খুঁজতে হয় মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের প্লেয়ার লিস্টে৷ হায় রে! বাংলার ফুটবলারদের এই দৈন্যদশা দেখে অবাক হতে হয়৷ গর্বের ডার্বির প্রাসঙ্গিকতা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে৷ এ কোন ডার্বি৷ আসলে দুই প্রধানের নিজস্বতা বলতে যা বোঝায়, তা মরচে পড়ে গেছে৷ তারপরে দলের সাইনবোর্ডটাই তো বদলে গিয়েছে৷ ঐতিহ্য এবং গৌরব এখন মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল শিবিরে কথা বলে না৷ সেই সব অলংকার শো-কেসে বন্দি হয়ে রয়েছে৷
হয়তো এখনও আবেগের টানে কিছু সমর্থক মাঠে ছুটে যান৷ প্রিয় দল হারলেও তাঁদের মনের গভীরে আঘাত লাগে না৷ কেউই ম্যাচ নিয়ে ঝড় তোলেন না৷ আসলে প্রাণের পরশটা ছুটি নিয়েছে সমর্থকদের কাছ থেকে৷ যে ডার্বি ম্যাচে বাংলার নিজের ছেলেদের দেখতে পাওয়া যায় না– সেই খেলায় কোনও আবেগ কথা বলতে পারে না৷ কিন্তু একটা সময় ডার্বির পরিচয় ছিল বাংলার ঘরের ফুটবলারদের সাহসী লড়াই৷ সেই লড়াই এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ ডার্বির অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে৷ ডার্বির মেজাজ তলানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে৷
এই তো ডুরান্ড কাপ ফুটবলের ডার্বি ম্যাচে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল খেলল৷ ওই ম্যাচে উত্তেজনা ছিল কৃত্রিম৷ যাকে বলে তৈরি করা৷ দুই প্রথম একাদশে বাংলার ছেলে কোথায়? অনেক কষ্টে মোহনবাগান দলে দেখতে পাওয়া গেল পাশা দোরজি নামে উত্তরবঙ্গের এক ফুটবলারকে৷ এই নামটা শুনে অনেকেই বলতেই পারেন, সত্যি কি তিনি একেবারে বাংলার ঘরের ছেলে! তবুও সান্ত্বনাবাক্য ছুঁড়ে দিয়ে ডুরান্ড ডার্বি শুরু হয়৷ খেলার ফলাফলে ইস্টবেঙ্গল মাজিমাত করলেও, সেই দলে বাংলার ছেলে কোথায়? তবে দ্বিতীয় পর্বে আশি মিনিটের মাথায় সৌভিক চক্রবর্তীকে পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামিয়ে দোষমুক্ত হতে চেয়েছে লাল-হলুদ ব্রিগেড৷ আর একটা সময়ে দেখা গিয়েছে ডার্বি লড়াইয়ে টানা পঁচিশ মিনিট ঘরের ছেলে দেখা নাই রে৷ তাহলে স্পষ্ট হয়ে গেছে বাংলা নিজের ছেলেদের ঠাঁই নেই দুই প্রধান দলে৷

আবেগ সবসময় খেলা করে না৷ যেখানে নিজস্বতা থাকে না৷ লড়াই করবার মানসিকতা বড় করে দেখা দেয় না৷ আন্তরিকতা জায়গা পায় না৷ ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা থাকে না৷ সেই ক্লাবে ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে ম্যাচ জেতায় কোনও গর্ব হয় না৷ তেমনই আবার হেরে গেলেও তাঁদের চোখে জল আসে না৷ তবুও ক্লাব সমর্থকরা দলের জয় দেখতে মাঠে যান৷ এই পাওয়াটা তাঁদের প্রাপ্য বলে মনে করেন৷ আর এই জয় সমর্থকদের উল্লাসে মৌলিকতা দেখতে পাওয়া যায় না৷ অনেকটা, নেই মামা চেয়ে কানা মামা ভালো। এমনিতেই কলকাতা ফুটবল বলতে যা বোঝায় তা ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে৷ সেদিকে আইএফএ নামে সংস্থার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই৷ তা না হলে কলকাতা ফুটবল লিগের ডার্বি ম্যাচে দর্শকদের জন্য দশ হাজার আসন বরাদ্দ করা হয়! ওই ম্যাচ দেখবার জন্য সেই অর্থে কোনও আগ্রহ ছিল না সমর্থকদের৷ হয়তো দ্বিতীয় সারির ফুটবলারদের নিয়ে দুই প্রধান কল্যাণীর মাঠে নেমেছে।
তবু তো ডার্বি ম্যাচ৷ কলকাতা লিগ তো জেলার লিগে পরিণত হয়েছে৷ পাশাপাশি বলতে হয় রিজার্ভ দল নিয়ে দুই প্রধান খেলল, তাঁদের মধ্যে এমন কোনও ঘরের ছেলেকে খুঁজে পাওয়া গেল না, যিনি মূল দলে জায়গা পাওয়ার মতো খেলেছেন। তাহলে কি সন্তোষ ট্রফি জয়ী বাংলার ফুটবলারদের কোনও যোগ্যতা নেই দুই প্রধানের মূল দলে খেলবার মতো? একটা সময় সারা ভারত জুড়ে বাংলার ফুটবলারদের কদর ছিল৷ বাংলার ছেলে ছাড়া ভারতীয় দল গঠন হত না৷ সেই বাংলাকে দেখতে দোকানে গিয়ে দূরবীন কিনে আনতে হচ্ছে৷ হায়রে বাংলার ফুটবল! কোনদিন হয়তো ময়দানে বড় বড় হোর্ডিং দেখতে হবে—‘বাংলার ফুটবলাররা নিরুদ্দেশ’৷