রাতে কী স্বপ্ন দেখবে দিনের বেলায় বলে দিতে পারত কণিকা। আর অবাক কান্ড, রাতে গভীর ঘুমের মধ্যে ঠিক সেই স্বপ্নটাই ও দেখত। স্বপ্ন দেখার কারণটা খুব পরিষ্কার ছিল ওর কাছে। বলত, যা আমার ভালো লাগে তাই নিয়ে ভাবি—ভাবতেই থাকি। বোধহয় অত ভাবি বলে সব কিছু আমার স্বপ্নের মধ্যে চলে আসে। এই স্বপ্ন আর ভাবাভাবির মধ্যে দিনের অনেকটা সময় দিব্যি মজে থাকত কণিকা।
এইভাবে কিছুকাল চলার পরে ওর স্বপ্নের এলাকা আরও খানিকটা বেড়ে গিয়েছিল। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা হলে সেই জায়গাটার কথা ও ভাবতে শুরু করে দিত। পাঁচজনের মুখে শোনা কথা নিয়ে ভাবনা নয়, পুরো ব্যাপারটা একেবারে নিজের মতো করে ভাবা।
পাহাড়ি এলাকা হলে সেই পাহাড়টা ও দেখতে পেত। পায়ে চলা সরু পথ কীভাবে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে গিয়েছে, গাছপালা কেমন—সবই দেখতে পেত পরিষ্কার। বেড়াবার জায়গা সমতল হলেও ক্ষতি নেই, ও সেখানকার ছবিও স্পষ্ট দেখতে পেত। ছবির মতো দেখা। কালো রাস্তার ঠিক পাশেই লাল টালি-ছাওয়া বাংলো, বাংলোর পেছন দিকে বাগান, কাছেই ঘাটবাঁধানো পুকুর,পুকুরের পাশেই একটা ঝাঁকড়া আমগাছ। রাতে স্বপ্নের মধ্যেও এই সব ছবি দেখতে পেত ও।
তারপর সত্যি সত্যি ওই সব জায়গায় বেড়াতে গেলে প্রথমেই মিলিয়ে দেখার ব্যাপারটা নিয়ে মেতে উঠত কণিকা। আর অবাক কান্ড! মিলেও যেত। সামান্য একটু এদিক-ওদিক হত, তবে সেটা বড় কিছু নয়। এই যেমন পুকুরের ধারের গাছটা আমের নয়, জামরুলের। বাংলোর বাগানটা পেছনে নয়,সামনে। তবে যেমন বাগানের ছবি ও এখানে আসার আগেই দেখে ফেলেছিল, এই বাগানটা হুবহু সেই রকমই।
সম্বন্ধ করেই বিয়ে হয়েছে কণিকার,তবে সম্বন্ধ হওয়ার কিছুদিন আগেই হবু বরের চেহারাটা ও দেখে ফেলেছিল স্বপ্নে। স্বপ্ন দেখার আগে ওই ছবিটাই ও কল্পনা করেছিল। শ্যামলা রঙ, মাথা ঠাসা কালো কোঁকড়ানো চুলে, চিবুকে একটা আঁচিল আর উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। এই ছবিটার কথা কাউকে বলা যায় না, বলেওনি কণিকা। তবে চেহারাটা যখন-তখন ওর চোখের সামনে ভেসে উঠত। বেশ কয়েকবার এই ছবিটাই স্বপ্নে দেখেছে ও।
স্বপ্ন দেখার কিছুদিন পরে সম্বন্ধ, তারপর বিয়ে। সৌমিত্রকে দেখেই ও চমকে উঠেছিল। অবিকল সেইরকম চেহারা, তবে ওর চিবুকে কোনও আঁচিল নেই।
বিয়ে হওয়ার দিন-সাতেকের মাথায় কণিকা ওর বরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার হাইট কত?’
‘পাঁচফুট ন ইঞ্চি।’
‘ইশ!এক ইঞ্চির জন্যে মেলেনি।’
‘মানে?’
কণিকা তখন ওর স্বপ্ন দেখার বৃত্তান্ত শুনিয়েছিল সৌমিত্রকে। সব শোনার পরে সৌমিত্র চোখ বড় বড় করে বলেছিল, ‘আশ্চর্য!’
‘আশ্চর্য’ শব্দটা সৌমিত্রর খুব প্রিয়। প্রায়ই বলে থাকে। শুধু বলাই নয়, চোখেমুখে ওর আশ্চর্য হওয়ার ভাবও ফুটে ওঠে নিঁখুত ভাবে। ওই কথা ও ভঙ্গি দেখে খুব উৎসাহিত হয় কণিকা। তারপরেই ও পরের স্বপ্নের কথা ভাবতে শুরু করে দেয়।
এখন কণিকা দু-রকমের স্বপ্ন দেখে। একটা স্বপ্ন জেগে জেগে, আর একটা স্বপ্ন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। দুই ধরনের স্বপ্নের মধ্যে দারুণ মিল, কেউ কোনোটাকে ছাপিয়ে যায় না। দিনের স্বপ্ন রাতে দেখার পরে মনে বেশ জোর পায় কণিকা। স্বপ্নটা যে সত্যি হবে,তা নিয়ে ওর আর কোনও সংশয় থাকে না।
তিন কামরার ফ্ল্যাট ওদের। শোবার ঘরের খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবল নতুন এবং হাল ফ্যাশনের। কিন্তু বসার ঘরের ফার্নিচারগুলো একেবারেই পছন্দ নয় কণিকার। পুরনো বেঢপ চেহারার আসবাবপত্র। সাজিয়েগুছিয়েও ভদ্রস্থ করা যায় না। আজকাল খবরের কাগজে শৌখিন আসবাবপত্রের ঢালাও বিজ্ঞাপন থাকে। কিছু কিছু ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না। ওই সব নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল কণিকা। প্রথমে অবশ্য জেগে জেগেই।
বসার ঘরে ঠিক কী ধরণের সোফাসেটি মানাবে? কী ধরনের সেন্টার-টেবল,কী ধরনের শো-কেস,কী ধরনের কাবার্ড, শ্যু-র্যাকটাই বা কেমন হবে—চোখের সামনে ছবি তৈরি হতে শুরু করেছিল কণিকার।
শুধু পছন্দসই আসবাবপত্র আনলেই তো হবে না, রং ফেরাতে হবে দেয়ালের। ভালো পেন্ট চাই। চার দেয়ালের জন্যে দু-রকমের মানানসই রং। স্বপ্ন ওখানেই থামল না, দেয়ালে ঝোলাবার জন্যে ভালো ছবি চাই। সিলিং থেকে ঝুলবে এমন একটা ঝাড়বাতি থাকলেই বা কেমন হয়!
দিনের স্বপ্ন একটু পাকা হওয়ার পরে রাতে ঘুমের মধ্যেও ওই স্বপ্নটাই দেখল কণিকা। সকালে ঘুম ভাঙার পরে কেমন যেন একটা বিভ্রম তৈরি হয়েছিল ওর। মনে হচ্ছিল, অমন একটা বসার ঘরেই আছে ও!
বসার ঘরটা ঢেলে সাজাবার জন্যে সৌমিত্রকে বলেছিল কণিকা। গৃহকর্তার হাতে সেই সময় হঠাৎ কিছু এরিয়ারের টাকা এসে গিয়েছিল, সুতরাং গৃহকর্ত্রীর সাধ মেটাতে কোনও অসুবিধে হল না ওর। সব কিছু সাজাতেগোছাতে মাস-দেড়েক সময় লেগে গিয়েছিল।আর অবাক কান্ড, তারপরেই স্বপ্নের ওই ছবিটার সঙ্গে ঘরের আশ্চর্য মিল দেখতে পেয়েছিল কণিকা।
সে কথা বলতেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সৌমিত্র বলে উঠেছিল ‘আশ্চর্য!’ অন্যান্যবারের মতো এবারও আশ্চর্য হওয়ার সব চিহ্ন ওর চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল। একটু বাদে হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি যে এমন একটা স্বপ্ন দেখেছ, বলোনি তো কখনও! বললে আমার কাজের কত সুবিধে হত, বেকার মাথা খাটাতে যেতাম না।’
রহস্যময় একটা হাসি ফুটে উঠেছিল কণিকার মুখে। ‘আজকাল আগ বাড়িয়ে আর বলতে ইচ্ছে করে না। অনেকদিন ধরে তো দেখছি তো–আমার স্বপ্ন সব সময় সত্যি হয়ে ওঠে।’
অবিকল আগের ভঙ্গিতে সৌমিত্র আবার বলেছিল, ‘আশ্চর্য!’
বসার ঘরের আরামপ্রদ সোফায় বসে কণিকা ফের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। কত রকম স্বপ্ন! একতলায় গেটের পাশে লাগানো বোগেনভেলিয়ার ঝাড়টা বেশ খানিকটা লম্বা হয়েছে, আর একটু লম্বা হলেই বারান্দার গ্রিলে জড়িয়ে যাবে। থোকা-থোকা লাল ফুল ফুটবে। ঘরের মধ্যে ফুলদানিতে রজনীগন্ধা,মিউজিক সিস্টেমে একটু নিচু পর্দায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। এবার আরও একটা স্বপ্ন দেখে,বড় আবেশে ভরা সেই স্বপ্ন!
এতদিন ধরে একটার পর একটা সব স্বপ্ন মিলে যাওয়ার জন্যে কণিকা বোধহয় ওর বিশ্বাসবোধের শেষ ধাপে পৌঁছে গিয়েছিল। এখন চলতে ফিরতে ও সব সময় স্বপ্ন দেখে। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি অনেকক্ষণ আটকে গেলেও ওর স্বপ্নের সুতো ছেঁড়ে না। নতুন নতুন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল কণিকা।
এই ভাবে চলার পথে একদিন বিচ্ছিরি একটা রদবদল হয়ে গেল। সেদিন শুকনো মুখে সৌমিত্র অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল কণিকা। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে তোমার?’
বছরখানেক বাদে কণিকা দেখল, স্বপ্ন এক্কেবারে মিলে গেছে। ঠিক সেইরকম মুঠো-করা তুলতুলে দুটো ছোট্ট হাত। একমাথা কুচকুচে কালো চুল। দুটো টানাটানা ঘুমন্ত চোখ।
লাজুক মুখে স্বপ্ন মিলে যাওয়ার কথা বলতেই সৌমিত্র অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘আশ্চর্য!’ আশ্চর্য হওয়ার চিহ্ন ওর চোখেমুখেও।
আবার নতুন উদ্যমে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল কণিকা। ছেলে খুব দুরন্ত হবে। অল্প কিছুদিন হামাগুড়ি দেওয়ার পরেই টলমল করে উঠে দাঁড়াবে। হাঁটার পর্ব তাড়াতাড়ি শেষ করার পরেই ছুটতে শুরু করবে। তিন-চাকা সাইকেল চালাতে খুব ভালোবাসবে। ‘ক’,ল’ আর ‘চ’-এর উচ্চারণ ঠিক ভাবে করতে পারবে না।
এক এক করে সব স্বপ্নই ওর মিলে গিয়েছিল। মিলে যাওয়ার পরে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছিল কণিকা। দেখল ছেলে নামকরা একটা মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুলে পৌঁছে দেয় বাবা, নিয়ে আসে মা। কিন্তু বাসে যাতায়াত করা ক্রমশই কষ্টের হয়ে উঠছে। লোকসংখ্যা বেড়েছে,তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বোধ হয় বাসের সংখ্যাও কমেছে। একটা গাড়ি থাকলে বেশ হত! এখন মাসে মাসে অল্প টাকার কিস্তি দিলেই তো গাড়ি কেনা যায়।
সাদা রঙের ছোট একটা গাড়ি হবে। তবে শুধু গাড়ি থাকলেই তো হবে না, একজন ড্রাইভারও চাই। কেমন ড্রাইভার? কালো, লম্বা, সাদা পোশাক পরা। নীচের দিকে তাকিয়ে খুব কম কথা বলে। ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়, অথচ বন্ধ করে আস্তে। মোটামুটি স্পিডে রাস্তার গর্ত বাঁচিয়ে সাবধানে গাড়ি চালায়। সাদা গাড়ি আর এমন একজন ড্রাইভার চাই।
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে কণিকা, তারপর সেই সব স্বপ্ন ওর ঘুমের মধ্যে ফিরে আসে। এবারও দেখল, একই স্বপ্ন বেশ কয়েক দিন ধরে। তারপর আবারও সেই ঘটনা। ও যা-যা ভেবেছিল, ঠিক তাই তাই ঘটে গিয়েছে। গাড়িটা ছোট, সাদা রঙের। ড্রাইভারও রাখা হল। অবাক কান্ড! ড্রাইভারের চেহারাও ঠিক সেই রকম।
সব শুনে আরও একবার ঠিক আগের মতোই অবাক হয়ে গিয়েছিল সৌমিত্র। অবাক হওয়ার চিহ্নগুলো ওর মুখে ছড়িয়েও ছিল অনেকক্ষণ।
এতদিন ধরে একটার পর একটা সব স্বপ্ন মিলে যাওয়ার জন্যে কণিকা বোধহয় ওর বিশ্বাসবোধের শেষ ধাপে পৌঁছে গিয়েছিল। এখন চলতে ফিরতে ও সব সময় স্বপ্ন দেখে। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি অনেকক্ষণ আটকে গেলেও ওর স্বপ্নের সুতো ছেঁড়ে না। নতুন নতুন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল কণিকা।
এই ভাবে চলার পথে একদিন বিচ্ছিরি একটা রদবদল হয়ে গেল। সেদিন শুকনো মুখে সৌমিত্র অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল কণিকা। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে তোমার?’
উত্তর এড়িয়ে যেতে চাইছিল সৌমিত্র, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল না। মুখ কালো করে যা বলল, তাতো ভয়ংকর। শুনতে শুনতে হাত-পা প্রায় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল কণিকার।
টুকরো-টুকরো অনেক কথায় সৌমিত্র জানাল—নতুন প্রজেক্টে ওদের কোম্পানি বিরাট একটা লোকসানের মধ্যে পড়েছে। এই ব্যাপারে ওর বস ওকেই দায়ী করছে। বেসরকারি সংস্থা, এখানে মাইনেপত্তর, সুযোগসুবিধা অনেক; কিন্তু যা নেই, তা হল চাকরির স্থায়িত্ব। মালিকের পছন্দ-অপছন্দের ওপর ম্যানেজমেন্টের লোকদের ভাগ্য নির্ভর করছে। কাউকে চলে যেতে বললেই চলে যেতে হবে তাকে।
সব কিছু শোনার পরে কণিকা আবার স্বপ্ন দেখার চেষ্টা জুড়ে দিয়েছিল—মনোমতো স্বপ্ন। সৌমিত্র নির্দোষ—এটা বোঝার মতো কোনও একটা ঘটনা এক্ষুনি ঘটে যাক ওদের অফিসে। তবে ঘটনা ওখানেই থামবে না, সৌমিত্রর পরিকল্পনায় নতুন প্রজেক্টে হাত দেবে কোম্পানি, আর সেই প্রজেক্ট থেকে বিরাট একটা লাভ উঠে আসবে।
কণিকা যা ভাবে তাই নিয়েই স্বপ্ন দেখে, কিন্তু এবার আর তা হল না। এক রাত্তির, দু রাত্তির, তিন রাত্তির কেটে গেল, কিন্তু মনের মতো স্বপ্নের একটা টুকরোও ঘুমের মধ্যে দেখতে পেল না। এমন তো হয়নি কখনও! দুশ্চিন্তায় ওর ঘুম কমে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে ঘুমোতেই পারত না সারা রাত।
ওদিকে মুশকিল আসানের বদলে সৌমিত্রের অফিসের গোলমাল বেড়ে গিয়েছিল আরও। অফিস-কর্তৃপক্ষ ওর হাত থেকে কয়েকটা দায়িত্ব কেড়ে নিল। তার ধাক্কা লাগল মাস-মাইনেয়। স্যালারি-চেকের অঙ্ক বেশ খানিকটা কমে গিয়েছিল। এর চাপ পড়ল বাড়িতে। সংসারের নানা ব্যাপারে ছাঁটকাট শুরু হয়ে গিয়েছিল তার ফলে।
কিছুদিন বাদে অবস্থার আরও খানিকটা অবনতি হল। অফিসের কাজে সৌমিত্রর মস্ত বড় একটা ভুল ধরা পড়ল। এমন ভুল ওর কখনও হয়নি। আসলে ও আর চাপ সহ্য করতে পারছিল না। টের পাচ্ছিল, চারদিক থেকে বেয়াড়া একটা ষড়যন্ত্র চেপে ধরছে ওকে। ভুলের খেসারতও দিতে হল। বাড়িতে ওর কথাবার্তা কমে গিয়েছিল বেশ। এমনিতে ও কখনও মাথা গরম করত না, এখন কথায় কথায় চটে যায়। আগে অফিসের কথা বাড়িতে বলত না, এখন মাঝে মাঝে বলে ফেলে। সেদিন হঠাৎই বলল, ‘মালিক ওর পেয়ারের লোককে বসাতে চায় আমার জায়গায়। সেই জন্যেই আমার বিরুদ্ধে একটার পর একটা অভিযোগ খাড়া করছে। কাউকে তাড়াতে গেলে তো বদনাম দিতে হয় আগে, সেই কাজটাই চলছে এখন।’
এ সব কথার কী জবাব দেবে কণিকা! ও প্রাণপণে নানারকম দৈব ঘটনার কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল। ভাগ্য সহায় হলে কী না হয়! ডুবন্ত নৌকো ভাসতে ভাসতে তীরে এসে ঠেকে। মৃত্যুর মুখ থেকে কত বিমানযাত্রী একটুর জন্যে বেঁচে ফেরে, গায়ে আঁচড়টা পর্যন্ত লাগে না। এমন তো কতই হয়ে থাকে!
প্রাণপণে নানারকম দৈবসহায়ের কথা ভাববার চেষ্টা করতে লাগল কণিকা। কিন্তু কিছুই ও গুছিয়ে ভেবে উঠতে পারছিল না। স্বপ্ন দেখা তো অনেক দূরের ব্যাপার, তবে ও হাল ছাড়েনি।
সৌমিত্রর অফিসে কিন্তু উলটো ব্যাপারটাই ঘটে গিয়েছিল। একদিন ও অফিস থেকে ফিরে এসে মুখ কালো করে বলল, ‘চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।’
‘সে কি!’
‘অপমান আর সহ্য করা যাচ্ছিল না—।’
অনেকক্ষণ বাদে শুকনো গলায় কণিকা বলেছিল। ‘ঠিক করেছ।’
জমানো টাকা ফুরোতে শুরু করেছিল একটু একটু করে, ঘরে আড়াইজন প্রাণী, কিন্তু ছেলে স্কুলে চলে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বলার মতো কথা ধরতে গেলে থাকতই না। অত সুন্দর করে সাজানো ফ্ল্যাট এখন অগোছালো। বাহারি সোফার খাঁজে হালকা ধুলোর চাদর।
চাকরি ছাড়ার পরদিন থেকে নতুন চাকরি খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিল সৌমিত্র, কিন্তু মন্দার বাজার—চাকরি নেই কোথাও। বিভিন্ন এজেন্সির কাছে সিভি জমা আছে ওর, নিজেও সরাসরি কয়েকটা সংস্থার কাছে চাকরির আবেদন-পত্র পাঠিয়ে দিয়েছে; কিন্তু কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। দিন গড়াতে লাগল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জমানো টাকা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। এবার বোধ হয় ঘরের জিনিসপত্রে হাত পড়বে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথাবার্তার পরিমাণ আরও কমে গিয়েছে।
পরদিন থেকে সংসারে আরও ছাঁটকাট। লম্বা চেহারার বিনীত ড্রাইভারকে ছেড়ে দিতে হল। শেষে ধপধপে সাদা গাড়িটাও চলে গেল অন্যের গ্যারাজে।
জমানো টাকা ফুরোতে শুরু করেছিল একটু একটু করে, ঘরে আড়াইজন প্রাণী, কিন্তু ছেলে স্কুলে চলে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বলার মতো কথা ধরতে গেলে থাকতই না। অত সুন্দর করে সাজানো ফ্ল্যাট এখন অগোছালো। বাহারি সোফার খাঁজে হালকা ধুলোর চাদর।
চাকরি ছাড়ার পরদিন থেকে নতুন চাকরি খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিল সৌমিত্র, কিন্তু মন্দার বাজার—চাকরি নেই কোথাও। বিভিন্ন এজেন্সির কাছে সিভি জমা আছে ওর, নিজেও সরাসরি কয়েকটা সংস্থার কাছে চাকরির আবেদন-পত্র পাঠিয়ে দিয়েছে; কিন্তু কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। দিন গড়াতে লাগল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জমানো টাকা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। এবার বোধ হয় ঘরের জিনিসপত্রে হাত পড়বে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথাবার্তার পরিমাণ আরও কমে গিয়েছে। এমন সময় হঠাৎই একটা ইন্টারভিউয়ের চিঠি এলো। অনেকদিন আগে পাঠানো আবেদনপত্রের জবাব।
নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউ দিয়ে এলো সৌমিত্র ।
কণিকা অপেক্ষায় ছিল, ফিরতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন হল?’
হাসার চেষ্টা করল সৌমিত্র। ‘এর আর হওয়াহয়ির কী? ওদের যা রিকয়ারমেন্ট, আমার তো সবই আছে-। এখন ওরা যদি আমার চাইতে আরও ভালো কাউকে পেয়ে যায়-। কোনও ক্যান্ডিডেটের আবার ভালো কোনও রেফারেন্সও থাকতে পারে, তেমন হলে তো আর যোগ্যতার প্রশ্ন উঠছে না।’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পরে কণিকা বলল, ‘দেখো, চাকরিটা তোমার হয়ে যাবে।’
ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল সৌমিত্রর মুখে । ‘কী করে বুঝলে?’
‘আমার মন বলছে।’
পরদিন সকালে ঝলমল করছিল কণিকার চোখমুখ । একটু লাজুক-লাজুক গলায় বলল, ‘অনেক দিন বাদে কাল রাতে আবার আমি স্বপ্ন দেখেছি।’
‘কী স্বপ্ন?’
‘চাকরিটা তোমার হয়ে গেছে।’
‘তাই!’
‘অফিসে তোমার বসার জায়গাটা কেমন হবে—তাও দেখেছি।’
হাসার চেষ্টা করল সৌমিত্র ।
‘ম্যানেজিং ডাইরেক্টরকে কেমন দেখতে তাও দেখেছি । বয়েস ষাটের ওপর, বেশ হাসিখুশি মানুষ। মাথায় ধপধপে সাদা চুল।’
আরও একবার হাসার চেষ্টা করেছিল সৌমিত্র ।
দুদিন পরে ওই অফিস থেকে ফোন এলো সৌমিত্রর কাছে। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর চান, কাল থেকেই ও জয়েন করুক।
পরদিন অফিস থেকে ফিরে ঝকঝকে সৌমিত্র কণিকাকে বলল, ‘অবাক কান্ড! তুমি যা বলেছিলে আমার বসার জায়গাটা ঠিক সেইরকমই। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের চেহারাটাও মিলিয়ে দিয়েছ। একমাথা সাদা চুল। সব মিলিয়ে এই চাকরিটা আগের চাইতে অনেক ভালো বলেই তো মনে হচ্ছে।’
খুব খুশি হয়েছিল কণিকা। খুশি হওয়ারই কথা। ওর চোখমুখের ঝলমলে ভাবটা একবারের জন্যেও মিলিয়ে যায়নি।
পরদিন সকালে সৌমিত্র অফিসে চলে যাওয়ার পরে নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল কণিকা। একটা শিরশিরানি ভয় ছড়িয়ে পড়েছিল ওর সারা শরীরে। না-না, ও আর যখন তখন এ ভাবে স্বপ্ন দেখবে না। দিনেও না, রাতেও না।