এক একজনের স্বভাব বড় বিচ্ছিরি৷ বকুনি পেলে আর কিছুই চায় না তারা৷ হীরুর স্বভাব ছিল এই রকম৷ যেখানেই যেত, তার বকুনির ঠেলায় সবাই অস্থির৷ সেবার পূজার ছুটিতে হীরু বেড়াতে এলো তার পিসির বাড়ি বকুলপুর গ্রামে৷ জীবনে এই তার প্রথম গ্রাম দেখা৷ এইখানে হীরু দেখল একটি মেয়েকে৷ নাম তার কুমী৷ কুমী বকুনিতে তার চেয়েও অনেক গুণ ওস্তাদ৷ প্রথম পরিচয়েই দু’জনেই দু’জনার বাক্ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে একেবারে পুলকিত হয়ে উঠল৷ কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, দু’জনের মধ্যে অদ্ভুত বন্ধুত্ব হয়ে গেছে৷ কুমী’র সংসারের অবস্থা খুব খারাপ৷ বিধবা মা’কে নিয়ে বলতে গেলে সে একরকম গলগ্রহই হয়ে আছে তার জ্যাঠামশাইয়ের সংসারে৷ জ্যাঠামশাইয়ের পোষা ছাগলগুলো চরিয়ে এবং সেই দুধ বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে যেটুকু সময় সে পায়, তার সবটুকুই যায় বকবকানিতে৷ অবশ্য কেউ তাকে বিশেষ আমল দেয় না৷ অত সময়ই বা কার আছে? তাই হীরুকে হাতের কাছে পেয়ে কুমী একেবারে বর্তে যায়৷ হীরু আবার কুমীকে শহরের গল্প বলে৷ বোঝায়, জীবন কী দ্রুতবেগে এগিয়ে চলেছে, সভ্যতার কী সাংঘাতিক অগ্রগতি হচ্ছে চারপাশে৷ কুমী তর্কে এঁটে উঠতে না পেরে হীরুকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখায় গ্রাম, নদী, গাছ-পালা, মাঠ-ঘাট, রংবেরঙের পাখি— আরও কত কি! দেখতে দেখতে হঠাৎ হীরু মুগ্ধ হয়ে যায়, তার শহর ঘেঁষা মন প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে স্বীকার করে, তার অনেক জানার অহঙ্কারের আড়ালে অনেক কিছুই এতদিন অজানা থেকে গিয়েছে৷ পৃথিবীর সত্যকিারের রং-রূপের জানালাগুলো একটা একটা করে কুমী যেন তার চোখের সামনে খুলে দিতে থাকে৷ আর সেই চোখ দিয়ে হীরু নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করে জীবনকে৷ কিন্তু জীবন তো মুষ্টিমেয় কোনও জিনিস নয়৷ যে বিশাল ব্যাপ্তি, বিপুলতার পরিধি, অতল তার গভীরতা, প্রথম যৌবনের স্বপ্নময় চোখে কি তার সবটুকুর হদিশ পাওয়া যায়? হাত ধরে যারা চলতে শুরু করেছিল, চলার শেষে কি আছে তখন কি তারা জানে?
এমন এক গল্পের নাম ‘অরন্ধনে নিমন্ত্রণ’৷ কাহিনিকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সেই কাহিনিতে বড় পর্দায় তুলে ধরলেন স্বনামখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদার৷ ছবির নাম দিলেন ‘নিমন্ত্রণ’৷ এখানে কুমী চরিত্রের শিল্পী সন্ধ্যা রায়৷ হীরুর ভূমিকায় অনুপকুমার৷ অন্যান্য ভূমিকার শিল্পীরা হলেন সন্ধ্যারানী, পাহাড়ি সান্যাল, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, নন্দিনী মালিয়া, হরিধন মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক অনবদ্য রবীন্দ্রসংগীত এ ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন (দূরে কোথায় দূরে দূরে)৷ গায়িকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ লোকসংগীত সৃষ্টি করেছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী৷ ‘নিমন্ত্রণ’ মুক্তি পেল ১৯৭১ সালে৷

‘নিমন্ত্রণ’ ছবি দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের চিত্ররূপের শুরু নয়৷ তারও বেশ কয়েক বছর আগে বিভূতিভূষণ তার উপন্যাস লেখার সূত্রপাত করেছিলেন যে বালকের জীবন নিয়ে, সেই বালকের নাম অপু৷ অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার অদম্য কৌতূহলে ও উৎসাহ নিয়ে যে বালকের আবির্ভাাব, যার নিত্যসঙ্গী তার দিদি দুর্গা; তাদের নিয়ে বিভূতিভূষণ লিখলেন প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’৷ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন৷ সেই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়িত করতে এলেন যিনি, তিনি বিশ্ববন্দিত পরিচালক সত্যজিৎ রায়৷ ‘পথের পাঁচালী’ তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি৷ মুক্তি পেল ১৯৫৫ সালে৷ অপুর চরিত্রে সুবীর বন্দ্যোপাদ্যায়, দুর্গার চরিত্রে উমা দাশগুপ্ত৷ দু’জনেই নতুন৷ অন্যান্য চরিত্রের শিল্পীরা তেমন নামজাদা না হলেও সত্যজিৎ রায় তােঁদর নিয়েছিলেন চরিত্রগুলির সঙ্গে মানানসই হবে বলে৷ সে তালিকায় আছেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবু বন্দ্যোপাধ্যায়, অপর্ণা দেবী, চুনীবালা দেবী, নিভাননী দেবী প্রমুখ শিল্পী৷ প্রথম ছবিতেই সত্যজিৎ রায়ের ভাগ্যে জুটল প্রচুর পুরস্কার৷ রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক (১৯৫৫), কান ফিল্ম, ফেস্টিভ্যালে পেল ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ (১৯৫৬), এডিনবার্গে পেল ‘ডিপ্লোমা অফ মেরিট’ (১৯৫৬), রোমে পেল ‘ভ্যাটিক্যান অ্যাওয়ার্ড’ (১৯৫৬), সানফ্রান্সিসকোতে পেল ‘বেস্ট ফিল্ম অ্যান্ড ডিরেকশন’ (১৯৫৭), বার্লিনে পেল ‘সেনজনিক গোল্ডেন লওরেল অ্যাওয়ার্ড’ (১৯৫৭), নিউ ইয়র্কে ‘বেস্ট ফরেন ফিল্ম’ (১৯৫৯)৷ এই পুরস্কার প্রাপ্তির ধারাবাহিকতা সত্যজিৎ রায় জীবনভর পেয়েছিলেন৷
সত্যজিৎ রায় বিভূতিভূষণের অপু’কে আরও দু’টি ছবিতে ধরে রাখলেন৷ ছবি দু’টি হল ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) এবং ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)৷ ‘অপরাজিত’তে অপু একটু বড় হয়েছে৷ দু’টি ধাপে৷ প্রথম ধাপে স্মরণ ঘোষাল৷ দ্বিতীয় ধাপে পিনাকী সেনগুপ্ত৷ বাবা-মা যথারীতি কানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ‘পথের পাঁচালী’র মতো এ ছবিতেও সত্যজিৎ রায় সঙ্গে নিয়েছিলেন রবিশংকর (সংগীত পরিচালক), সুব্রত মিত্র (চিত্রগ্রাহক), বংশীচন্দ্র গুপ্ত (শিল্প নির্দেশক), দুলাল দত্ত (সম্পাদক)-কে৷ ‘অপুর সংসার’ নানা দিক দিয়ে স্মরণীয়৷ কারণ এখানে যুবক অপু হিসাবে ছবির জগতে প্রথম পা রাখলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ অপর্ণার চরিত্রের জন্য ছবিতে প্রথম এলেন শর্মিলা ঠকুর৷ দু’জনেই পরবর্তীকালে স্বনামদন্য শিল্পী হয়ে উঠলেন৷ যথারীতি ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসারে’র ভাগ্যেও জুটল দেশ-বিদেশের বহু বহু পুরস্কার৷

সত্যজিৎ রায় এর বেশ কিছুদিন বাদে বিভূতিভূষণের আরেকটি উপন্যাসের চিত্ররূপ দিলেন উপন্যাসের নাম ‘অশনি সংকেত’৷ ইতিপূর্বে বিভূতিভূষমের তিনটি কাহিনির চিত্ররূপ সত্যজিৎ রায় দিয়েছিলেন সাদা-কালোতে৷ ‘অশনি সংকেত’ কিন্তু রঙিন৷ কলাকুশলীরও বদল হয়েছে৷ সেই সময়ে সত্যজিৎ রায় নিজের ছবির নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন৷ চিত্রগ্রাহক হয়ে এলেন সৌমেন্দু রায়৷ বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা এ ছবির নায়িকা৷ নায়ক যথারীতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ এই একটি মাত্র ছবিতে সন্ধ্যা রায় কাজ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে৷ অসাধারণ মেকআপের কাজটি করেছিলেন অনন্ত দাস৷ ১৯৭৩ সালে মুক্তি পেল এ ছবি৷
তরুণ মজুমদার ‘নিমন্ত্রণ’ ছাড়াও বিভূতিভূষণের গল্প নিয়ে বেশ কয়েকটি ছবি তৈরি করেছিলেন৷ প্রথমটি ‘নিমন্ত্রণ’৷ পরের ছবি ‘ফুলেশ্বরী’ (১৯৭৪)৷ গানে গানে ভরা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছবি হয়েছিল ‘ফুলেশ্বরী’৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরকার৷ গানগুলি হল— ‘ফুলেশ্বরী ফুলেশ্বরী ফুলের মত নাম’, ‘যেও না দাঁড়াও বন্ধু’, ‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে’ প্রভৃতি৷ ছেনো গুণ্ডার চরিত্রে অভিনয় করে যে শমিত ভঞ্জ তপন সিংহের ‘আপনজন’ ছবিতে প্রতিষ্ঠা পেলেন, সেই শমিত ভঞ্জ এখানে শান্ত স্থির সুরস্রষ্টা এক প্রেমিক৷ নাম ভূমিকায় সন্ধ্যা রায়৷ সঙ্গে ছিলেন অনুপকুমার, উৎপল দত্ত, মলিনা দেবী, রবি ঘোষ, সুলতা চৌধুরী, শমিতা বিশ্বাস, লিলি চক্রবর্তী, তরুণ কুমা, চিন্ময় রায়, গীতা দে, হরিধন মুখোপাধ্যায়৷ হরিধনের স্বকণ্ঠে গান ‘আমি তোমায় বড় ভালবাসি’ শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিল৷ ২০০৩ সালে তরুণ মজুমদার
বিভূতিভূষণের ‘কিন্নরদল’ গল্পটি নিয়ে ছবি করলেন৷ নাম দিলেন ‘আলো’৷ দীর্ঘ বিরতির পর তরুণবাবুর এই ছবির প্রতি দর্শকদের আগ্রহ ছিল তুমুল৷ তিনি দর্শকদের হতাশ করেননি৷ এ ছবির মুখ্য চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অসাধারণ অভিনয় করলেন৷ তরুণবাবুর ছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার একটা আলাদা তাৎপর্য এনে দেয়৷ পরিচিত রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি এমন এক-একটি রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করেন যেটি অচিরেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়৷ ‘আলো’ ছবিতে তেমন গানটি হল— ‘শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে৷’
‘আলো’ ছবিটি যেমন দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল, ঠিক তেমনই দর্শক বিরক্ত হয়েছিলেন বিভূতিভূষণের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত তরুণবাবুর ‘ভালোবাসার অনেক নাম’ ছবি দেখে৷ সেই গ্রাম্য পরিবেশ, বনজ্যোৎস্না, পূর্ণিমা চাঁদ, রেলগাড়ি— এসব তরুণবাবুর অপরিহার্য উপাদানগুলি এ ছবিতে মজুত৷ তবু ভরিল না চিত্ত৷ এ ছবির নায়ক-নায়িকা হিসাবে নির্বাচিত হলেন উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাতনি মেঘা মুখোপাধ্যায়৷ তাঁরা হতাশ করলেন৷ পাশে অনেক নামজাদা শিল্পীর ভিড়৷ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাতেও লাভ হল না৷ উত্তম-হেমন্তের বংশধরেরা যেহেতু মুখ্য চরিত্রে, অতি নিন্দুকেরা বললেন, এ ছবির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘দাদুর কীর্তি’৷

বিভূতিভূষনের আরেকটি ছোটগল্প অবলম্বনে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় বানালেন ‘নিশিপদ্ম ‘৷ পরিচালকের কৃতিত্ব এই যে ছবিতে একটি চরিত্র (যাঁর নাম অনঙ্গ দত্ত)-কে আমদানি করলেন, যিনি মূল গল্পে নেই৷ নিষিদ্ধপল্লীর প্রেক্ষাপটে পুষ্প’র ঘরে যাতায়াতকারী এই অনঙ্গ দত্ত চরিত্রে এলেন উত্তমকুমার৷ জমিয়ে দিলেন আসর৷ নচিকেতা ঘোষের সুরে সব কালজয়ী গান এ ছবিতে৷ ‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবো না৪, ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’ ‘রাজার পঙ্খী উইড়্যা গেলে রাজা নতুন পঙ্খী’, ‘ওরে সকল সোনা মলিন হল কালো সোনার চেয়ে’ প্রভৃতি গানগুলি৷ মান্না দে ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এ ছবিতে গান গেয়ে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেলেন৷ পদ্ম’র চরিত্রে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অনবদ্য৷ সঙ্গে ছিলেন অনুপকুমার, জহর রায়, গঙ্গাপদ বসু, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, প্রেমাংশু বসু প্রমুখ শিল্পী৷
‘নিশিপদ্মে’র (১৯৭০) আগেও অরবিন্দবাবু বিভূতিভূষণের ‘আহ্বান’ গল্পের চিত্ররূপ দিয়েছিলেন (১৯৬১)৷ হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক মধুর ছবি ‘আহ্বান’৷ হেমাফিনী দেব সেই মুসলিম চরিত্রে, তিনি পুত্রবৎ ভালবাসেন নায়ককে (অনিল চট্টোপাধ্যায়), যে নায়ক হিন্দু৷ এ ছবির অন্যান্য শিল্পীরা হলেন সন্ধ্যা রায়, লিলি চক্রবর্তী, শোভা সেন, গঙ্গাপদ বসু, শিপ্রা মিত্র প্রমুখ৷ সংগীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিক৷
বিভূতিভূষণের বহুপঠিত উপন্যাস ‘আরণ্যক’ নির্মাণ কার্যের দুর্বলতার জন্য মুখ থুবৱে পড়ল মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে (১৯৭৩)৷ সত্যচরণের চরিত্রে শমিত ভঞ্জ, ভানুমতীর চরিত্রে সোনিয়া সাহানী একটু দাগ কাটতে পারলেন না৷ অথচ পরিচালক ছিলেন অজিত লাহিড়ী৷ চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সমরেশ বসু৷ ওই ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নিশিকন্যা’ ছবি সম্বন্ধেও একই কথা। বিভূতিভূষণের ‘অথৈ জল’ অবলম্বনে আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালনা করলেন ‘নিশিকন্যা’ ছবি৷ জমল না ছবি৷ অথচ অনেক নামীদামী শিল্পীর ভিড় সেখানে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মিঠু মুখার্জি, ভানু ব্যানার্জি, তরুণ কুমার, সুব্রতা, দিলীপ রায়, রুমা গুহঠাকুরতা)৷
বরং তুলনায় তপন সিংহের একদা সহকারী বলাই সেন যে ছবি পরিচালনা করলেন সেই ‘কেদার রাজা’ দর্শক সমালোচক ধন্য হয়েছিল৷ নাম ভূমিকায় পাহাড়ি সান্যাল নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন৷ চিত্রনাট্যকার তপন সিংহ৷ কেদার রাজার বিধবা কন্যার চরিত্রে লিলি চক্রবর্তী মানানসই৷ অন্যান্য ভূমিকার শিল্পীরা হলেন অসিতবরণ, ছায়া দেবী, দিলীপ রায়, মমতাজ আহমেদ, প্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ৷ এ ছবি মুক্তি পেল ১৯৬৭ সালে৷ ‘কীর্তিগড়’ (১৯৫৬) বিভূতিভূষণের আরেকটি কাহিনির চিত্ররূপ৷ পরিচালক সৌমেন মুখার্জি৷ সুরকার অনুপম ঘটক৷ মুখ্য ভূমিকা লিপিতে ছিলেন সন্ধ্যারানী, নির্মলকুমার, ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, অনুভা গুপ্তা, বিকাশ রায়, উৎপল দত্ত৷ এ ছবির চিত্রনাট্যকার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র৷

দু’টি জমজমাট হাসির ছবি পেলাম বিভূতিভূষণের গল্প থেকে৷ একটি ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসের চিত্ররূপ (১৯৫৭)৷ পরিচালক অর্ধেন্দু সেন৷ হাজারি ঠাকুরের চরিত্রে ধীরাজ ভট্টাচার্য একাই একশ৷ সঙ্গে পেলেন ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, তুলসী চক্রবর্তী, সন্ধ্যারানী, জহর রায়, অনুপ কুমার, সবিত বসু, শ্যাম লাহা, পদ্ম দেবী, নৃপতি চ্যাটার্জি প্রমুখ ডাকসাইটে শিল্পীদের৷ অপরটি হল বাক্সবদল’ ছোটগল্পের চিত্ররূপ (১৯৬৫)৷ সত্যজিৎ রায়ের সহকারী নিত্যানন্দ দত্ত এ ছবির পলিচালক৷ ‘তিনকন্যা’ ছবির পর সৌমিত্র-অপর্ণা আবার এ ছবিতে নায়ক-নায়িকা৷ ট্রেনের কামরা থেকে বেরিয়ে নায়ক-নায়িকার বাক্স দুটি বদল হয়ে যায়৷ যেহেতু বাক্স দুটির একই রকম চেহারা৷ তাই এ বিভ্রাট৷ তা নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড৷ সঙ্গে ছিলেন সতীন্দ্র ভট্টাচার্য,চারুপ্রকাশ ঘোষ, প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গীতালি রায়, যমুনা সিংহ, অপর্ণা দেবী৷
দীর্ঘদিন বাদে বিভূতিভূষণের বহু পাঠিত উপন্যাস ‘চাঁদের পহাড়’-এর চিত্ররূপ পাওয়া গেল (২০১৩)৷ এক সময়ে তরুণ মজুমদারের এ উপন্যাসের চিত্ররূপ দেবার ইচ্ছা ছিল৷ এবারে চিত্ররূপ দিলেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়৷ তিনিই চিত্রনাট্যকার৷ মূল চরিত্র শঙ্কর৷ যার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে গল্পের বিস্তার৷ সেই চরিত্রের শিল্পী দেব৷ এ ছবি বাচ্চাদের টানলো, স্বভাবতই বাচ্চাদের অভিভাবকরাও গেলেন এ ছবি দেখতে৷ ফলে বাণিজ্য দারুণ করল এ ছবি৷ একটা সময়কে ধরার চেষ্টা পরিচালকের কাজের মধ্যে ছিল৷ ‘চাঁদের পাহাড়’ গল্পের সিক্যুয়েন্স কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বানালেন৷ নাম দিলেন ‘অ্যামাজান অভিযান’ (২০১৭)৷ শঙ্করের চরিত্রে সেই যথারীতি দেব৷ এ ছবি অবশ্য তেমন সাফল্য পায়নি, যদিও পরিচালকের কাজের মধ্যে আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি ছিল না৷ এ ছবি নির্মাতায় উৎসর্গ করেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে৷
২০১৬ সালে বিভূতিভূষণের
‘তালনবমী’ গল্পের চিত্ররূপ দিলেন নবাগত পরিচালক মানসমুকুল পাল৷ ছবির নাম দিলেন ‘সহজ পাঠের গপ্পো’৷ দুটি নতুন শিশু শিল্পীকে (নূর ইসলাম, সামিউল অলম) পরিচালক আবিষ্কার করলেন৷ তারা অভিনয়ও করলেন সুন্দর৷ এ ছবি দর্শক ও সমালাচকের প্রসংসা করলেন অকুণ্ঠ চিত্তে৷ আপাতত এই হল বিভূতিভূষমের কাহিনির চিত্ররূপ প্রসঙ্গ৷ আরও অনেক উপন্যাস(কোন, দৃষ্টিপ্রদীপ, ইছামতী প্রভৃতি) পড়ে আছে, সহৃদয় পরিচালক প্রযোজকের দৃষ্টি।

