প্রথম পর্বের পরে
(প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন )
(৬)
দীর্ঘদিন অপেক্ষায় রইলেন ডা. তাকাহাসি৷ সরকারি নানারকম ফাইল চালাচালির পর ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে পরিবেশ দপ্তরের অনুমোদন পাওয়া গেল৷
ডা. তাকাহাসির সঙ্গে মি. ইউতাকার যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হলেও পুরনো রিপোর্ট থেকে বিশেষ কিছু জানা গেল না৷
যথেষ্ট হতাশ হলেন ডা. তাকাহাসি৷ তাও শেষ চেষ্টা হিসেবে জানতে চাইলেন, ‘মি. ইউতাকা, এমন কোনও নমুনা পাননি, যা আর একবার পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে?’
মি. ইউতাকা মাথা নাড়েন, ‘না, স্যার, আমি ওদের বাড়ির প্রতিটা অংশ খুঁজে দেখেছি৷ – আমার বিশ্বাস, ওরা একটা অন্যায় কাজ নিশ্চয়ই করেছে৷ কিন্তু সব প্রমাণ লোপাট করে দিতে পেরেছিল৷’
ডা. তাকাহাসি বিষণ্ণ গলায় বলেন, ‘সেদিন যদি আমরা ওদের ধরতে পারতাম তবে ৯৫ সালের ভয়ঙ্কর বিপদ আটকানো যেত৷’
হঠাৎ মি. ইউতাকা চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ান, ‘স্যার, একটু বসুন৷— আমার মনে পড়েছে৷ একটা নমুনা হয়তো পাওয়া যেতে পারে৷’
‘তাই নাকি!ডা. তাকাহাসি নড়েচড়ে বসেন৷’
‘হ্যাঁ স্যার, ওই বাড়ির কুলিং টাওয়ার থেকে একরকম আঠালো তরল রাস্তায় জমা হয়েছিল৷ সেই কালচে তরল আমি টেস্ট টিউবে নিয়েছিলাম৷’
‘পরীক্ষা হয়েছিল?’
‘যতদূর মনে পড়ছে ওটা নিয়ে কোনও পরীক্ষা হয়নি৷’
‘তাহলে আমায় দিয়ে দিন৷’ ডা.তাকাহাসি যথেষ্ট উত্তেজিত৷
‘স্যার, ওটা খুঁজতে আমায় কয়েকটা দিন দিতে হবে৷ এতদিন আগের কথা৷’
‘বেশ তো, তাই হবে৷ আজ উঠি৷— আশা করি আপনি আমায় ভালো খবর শোনাবেন৷’ ডা.তাকাহাসি হাত মেলান৷
দিন সাতেক পরে ডা. তাকাহাসির ফোন বেজে ওঠে, ‘স্যার, আমি ইউতাকা বলছি, ক্যামিডো থেকে–’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন৷’
‘স্যার, খুঁজে পেয়েছি৷ খুব সামান্য পরিমাণ৷’
‘ওতেই হবে৷ আজই আমার সহকর্মী কিয়োসু তানিগুটিকে পাঠাচ্ছি৷ ওঁর হাতে দিয়ে দিন৷’
পুরো বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে এ বিষয়ে সামিল করা হল জাপানের স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ মন্ত্রককে৷
মন্ত্রী জানালেন, ‘ডা. তাকাহাসি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিপদের কথা মাথায় রেখে, আমরা চাইছি এ ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে৷’
ডা. তাকাহাসি বললেন, ‘স্যার, সরকারের কীরকম বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা আমি জানি না, তবে একথা জোরের সঙ্গে বলতে পারি, আমাদের এখানে এই পরীক্ষা চালানোর মতো যথেষ্ট দক্ষ বিজ্ঞানী রয়েছে৷’
‘আপনি ভুল বুঝবেন না,ডা. তাকাহাসি৷ আমাদের বিজ্ঞানীদের সম্মানে আঘাত লাগে এমন কিছু আমরা করতে চাই না৷ আসলে সন্ত্রাসবাদ দমনে, জাপানের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের যে চুক্তি রয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে হচ্ছে৷ ও দেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ্-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে৷ পুরো ব্যাপারটা আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল ননপ্রলিফারেশন প্রোগ্রামের ডিরেক্টর দেখছেন৷ কয়েকদিনের মধ্যে ওরা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে৷ তবে যাই হোক না কেন, আপনি ও আপনার সহকর্মীদের বাদ দিয়ে কোনও কাজ হবে না৷’
পরবর্তী পর্যায়ের কাজ এই জীবাণুকে গবেষণাগারের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি ঘটানো৷ যাকে পরিভাষায় বলা হয় ‘কালচার’ করা৷ জীবাণু কালচার করা হয় বিশেষ ধরনের কাঁচের প্লেটে অথবা কাঁচের টেস্ট টিউবে৷ কোনও কোনও জীবাণুর জন্য বিশেষ বিশেষ খাবার দিয়ে মিডিয়া প্রস্তুত করতে হয়৷ ব্যাসিলাস প্রজাতির জীবাণু সাধারণ মিডিয়ায় যেমন বাড়তে পারে তেমনি ভেড়ার রক্তের সঙ্গে আরও কিচু জিনিস মিশিয়ে জমাট বাঁধানো হয়৷
ডা. তাকাহাসি খানিকটা বিরক্ত হলেও আমলাতন্ত্রকে বেশি না ঘাঁটাবার সিদ্ধান্তই নিলেন৷
কয়েকদিনের মধ্যে ডা. তাকাহাসিকে জানানো হল, ক্যামিডোর নমুনা নিয়ে জীবাণু সংক্রান্ত পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে নর্দান অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির মাইক্রো বায়োলজি ডিপার্টমেন্টকে৷
‘কারা রয়েছেন এই কাজের দায়িত্বে?’ ডা.তাকাহাসি জানতে চান৷
‘অ্যারিজোনার ফ্ল্যাগস্টাফের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে— পল কিম, ক্রিস্টিন কেম ও কিমোথি স্মিথ৷ এদের সঙ্গে যোগ দেবেন জর্জিয়ার স্টোন মাউন্টেনের আর্নল্ড কফম্যান৷’
ডা. তাকাহাসি আমেরিকায় গিয়ে রিসার্চ টিমের সঙ্গে কথা বলে এলেন৷
মাত্র ২.৬ মিলিমিটার কালো ঘোলাটো নমুনা নিয়ে শুরু হল জীবাণু বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা৷
এরই মধ্যে জাপানে বসে ডা. তাকাহাসি এক বিশেষ সমীক্ষা করলেন৷ ১ জুলাই, ১৯৯৩ সালে মোট যে ১১৮ জন দুর্গন্ধের কথা জানিয়েছিলেন তাদের ঠিকানা জোগাড় করে ক্যামিডো এলাকার বিশেষ ম্যাপ তৈরি করা হল৷ পাওয়া গেল মোট ০.৩৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা৷ এই অঞ্চলের মধ্যে বাড়ির সংখ্যা ৩৪০০ আর বাসিন্দা ৭০০০৷ এবার ডা. তাকাহাসি ওই এলাকার ৩৯ জন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন৷ জানতে চাওয়া হল, ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে তারা কোনও জটিল জীবাণু সংক্রমণে আক্রান্ত রুগি পেয়েছিলেন কিনা৷ যেমন, শ্বাসনালি বা ফুসফুসের জীবাণুঘটিত রোগ বা মেনিনজাইটিস৷ প্রত্যেকেই জানালেন এমন কোনও রুগি তাঁরা পাননি৷
ফলে ডা. তাকাহাসির অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় রইল না৷ আমেরিকা থেকে কী খবর আসে তার জন্য বসে থাকতে হল ওঁকে৷ নর্দান অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন তুমুল ব্যস্ততা৷
পল কিম টিম লিডার৷ তিনি বললেন, ‘ক্রিস্টিন আমাদের প্রথম কাজ হবে এই তরল থেকে সামান্য পরিমাণ গ্লাস স্লাইডে নিয়ে তা রঙ করে দেখা৷’
‘গ্রাম স্টেইন করব স্যার?’
‘হ্যাঁ, তবে ক্রিস্টাল ভায়োলেটের বদলে ব্যবহার করবে ম্যালাকাই গ্রিন ও সাফ্রানিন৷’
রঙ হয়ে যাবার পর তা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে খুঁটিয়ে দেখা হল৷ মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়েছিলেন ক্রিস্টিন৷
‘কী দেখতে পাচ্ছ?’ পল কিম জানতে চান৷
‘স্যার, স্লাইডের বেশির ভাগ অংশে ময়লা, আজেবাজে জিনিস৷’
‘তা তো হবেই৷ নমুনা সংগ্রহ হয়েছিল রাস্তা থেকে৷ তারপর এত বছর কেটে গেছে৷— কোনও জীবাণু কি দেখা যাচ্ছে?’
‘হ্যাঁ স্যার৷ কালচে সবুজ রঙের৷ লম্বা, মোটা জীবাণু৷ মাথার দিক ভোঁতা৷ বেশ কিছু জীবাণুর ভেতর গোল গোল ফাঁকা অংশ যেখানে কোনও রঙ ধরেনি৷’
‘ভেরি গুড!তার মানে এমন এক জীবাণু পাওয়া গেল যার স্পোর বা গুটি রয়েছে৷এগুলো অবশ্যই এন্ডোস্পোর৷— আমাদের সবচেয়ে পরিচিত কোন্ কোন্ জীবাণুর এন্ডোস্পোর রয়েছে৷’
‘ব্যাসিলাস ও ক্লসট্রিডিয়াম প্রজাতির জীবাণু৷’
‘এদের তো আমরা এন্ডোস্পোরের ধরন দেখে আলাদা করতে পারি,তাই তো?’
‘ইয়েস স্যার৷ এখানে এন্ডোস্পোরগুলো ব্যাকটিরিয়ার শরীরের মাপের সমান৷ বড় নয়৷ তার মানে এরা ব্যাসিলাস প্রজাতির৷’
‘বুঝতেই পারছ, আমরা বায়োটেররিজমের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছি৷ ক্রিস্টিন, কিমোথি— তোমরা মনে রেখো কাজ করতে হবে খুবই সাবধানে৷ পুরো কাজ এখন থেকে গ্রেড থ্রি বায়োসেফটি ক্যাবিনেটের মধ্যে হবে৷’
ওঁরা দু’জনেই মাথা নাড়েন৷
পরবর্তী পর্যায়ের কাজ এই জীবাণুকে গবেষণাগারের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি ঘটানো৷ যাকে পরিভাষায় বলা হয় ‘কালচার’ করা৷ জীবাণু কালচার করা হয় বিশেষ ধরনের কাঁচের প্লেটে অথবা কাঁচের টেস্ট টিউবে৷ কোনও কোনও জীবাণুর জন্য বিশেষ বিশেষ খাবার দিয়ে মিডিয়া প্রস্তুত করতে হয়৷ ব্যাসিলাস প্রজাতির জীবাণু সাধারণ মিডিয়ায় যেমন বাড়তে পারে তেমনি ভেড়ার রক্তের সঙ্গে আরও কিচু জিনিস মিশিয়ে জমাট বাঁধানো হয়৷ তবে এই নমুনায় যেহেতু নানা ধরনের অন্য স্পোরযুক্ত ব্যাকটিরিয়া থাকতে পারে তাই তার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল বিশেষ মিডিয়াম, ‘প্লেট মিডিয়াম’৷
কীভাবে তৈরি হয় এই প্লেট মিডিয়াম?
হার্ট ইনফিউশন আগর মিডিয়ামে মেশানো হয় পলিমিক্সিন, লাইসোজাইম, ইউটিএ ও থ্যালাস অ্যাসিটেট৷
প্লেটের মধ্যে এইসব মিডিয়ায় শক্ত জমিতে সন্তর্পণে ঘষে দেওয়া হল সেই তরল৷ ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ইনকিউবেটরের মধ্যে রাখা হল প্লেট৷
৪৮ ঘণ্টা পর মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের এক বিশেষ ঘরে সব জীবাণুবিদ জড়ো হলেন৷ বায়োসেফটি ক্যাবিনেটের ভেতর পরপর সাজানো রয়েছে প্লেটগুলো৷ আলো ধরতেই দেখা গেল ব্লাড আগর প্লেটের গোটা অংশ জুড়ে বেড়ে উঠেছে জীবাণু৷ ছোট ছোট গোল অংশে৷ এদের বলা হয় জীবাণুর ‘কলোনি’৷ কোনওটা সাদা, কোনওটা ধূসর, কোনওটা স্বচ্ছ৷ কোনওটা আবার অস্বচ্ছ৷ কিছু কলোনি চকচক করছে৷ কিছু কলোনি ম্যাটম্যাটে৷ কিছু কলোনির চারপাশে ভেড়ার লাল রক্তকোষ ভেঙে যাওয়ার ফলে সেই অংশ স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে৷ বিজ্ঞানের পরিভাষায় এরা ‘হিমোলাইটিক কলোনি’৷ অবশ্য প্লেট মিডিয়ামে জীবাণুর সংখ্যা অনেক কম৷ আর এত ধরনের কলোনিও সেখানে দেখা দেয়নি৷
জীবাণু বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনও তরল জীবাণুযুদ্ধের অস্ত্রে কমপক্ষে ১০০০ মিলিয়ন জীবাণু থাকা দরকার৷ শুধু তাই নয়৷ এই জীবাণু এমনভাবে তরলে মিশিয়ে ছড়াতে হবে যাতে খুব সূক্ষ্ম কণায় সেই তরল বাতাসে ভেসে থাকতে পারে৷
‘কী মনে হচ্ছে তোমাদের?’ পল কিম হ্যান্ড-লেন্স দিয়ে কলোনিগুলো খুঁটিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করলেন৷
‘স্যার মিক্সডক কলোনি রয়েছে৷ অনেক রকম জীবাণু৷’ কিমোথি জানান৷
‘তাই তো স্বাভাবিক—কিন্তু আমাদের কাছে সন্দেহজনক কোনও জীবাণু রয়েছে কি?’
‘হ্যাঁ স্যার, কয়েকটা কলোনি মনে হচ্ছে ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস জীবাণুর৷’ কিমোথি বলে৷
‘ক্রিস্টিন, তোমারও কি একমত?’
‘হ্যাঁ স্যার৷ এই প্রায় অস্বচ্ছ ধূসর রঙের বড় গোল কলোনিগুলো মনে হচ্ছে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু, এদের চারপাশে লাল রক্তকোষগুলো ভাঙেনি৷’
‘একেবারে ঠিক!—এবার তোমাদের কাজ হচ্ছে এই সন্দেহজনক জীবাণুকে অন্য সব থেকে আলাদা করা৷ এরাই আমাদের রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি৷— এ সংক্রান্ত পরীক্ষায় তোমাদের সাহায্য করবেন আর্নল্ড কফম্যান৷’
কয়েকদিনের মধ্যে অন্যান্য পরীক্ষা করে জানা গেল, জীবাণুবিদদের সন্দেহ সঠিক৷ মোট ৪৮ খানা সন্দেহজনক কলোনি নিয়ে পরীক্ষা হয়েছে৷ প্রতিটি কলোনিতে পাওয়া গেল ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস৷ এরপর জিন সংক্রান্ত কিছু বিশেষ পরীক্ষাও হল৷ যেমন এম.এল.ভি.এ. আর পি.সি.আর৷
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল নমুনায় পাওয়া জীবাণুর সঙ্গে মূল প্রজাতির ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস-এর একটা গুরুতর অমিল রয়েছে৷ এদের ডি.এন.এ. অণুতে জীবাণুর ঘোরাটোপ বা ক্যাপসুল তৈরি করার যে জিন থাকা উচিত তা নেই৷
এ খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হলো ডা. তাকাহাসি ও জাপান সরকারকে৷ খবর পাওয়ার পর কিছুমাত্র দেরি না করে ডা. তাকাহাসি জাপানের যত ধরনের ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস জীবাণু পাওয়া যায় তাদের জেনেটিক ম্যাপ সংগ্রহ করলেন৷ এবার তুলনা করা হল ক্যামিডোর নতুন জীবাণুর ডি.এন.এ. গঠনের সঙ্গে৷ জানা গেল, এই জীবাণুর সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে স্টার্নি ৩৪ এফ২ প্রজাতির৷ এই প্রজাতির জীবাণুরও কোনও ক্যাপসুল নেই৷ জাপানে এই প্রজাতির সাহায্যে গবাদি পশুর অ্যানথ্রাক্স রোগ প্রতিষেধক টিকা বানানো হয়৷
গোটা দেশ থেকে অভিনন্দন বার্তা আসতে লাগল৷ জাপান সরকার জীবাণুবিদের পুরো দলকে সংবর্ধনা জানালেন৷ দীর্ঘ ছ’বছর পর কিনা হল এমন এক রহস্যের, যা একরকম ভুলে যাওয়া হয়েছিল৷
কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া তখনও বাকি ছিল৷ যে জীবাণু যুদ্ধের মহড়া হিসেবে ক্যামিডোতে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ছড়ানো হয়েছিল, তা কিন্তু বাস্তবে ঘটেনি৷ অথচ ২০০১ সালে আমরা জানি আমেরিকার নানা জায়গায় খামে ভরে অ্যানথ্রাক্স-স্পোরের গুঁড়ো পাঠিয়ে রোগ ঘটানো হয়েছে৷
কী কী কারণে ১৯৯৩ সালে আউম সিনরিকিও-এর সেই ভয়ঙ্কর চেষ্টা সফল হয়নি?
এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য ডা. হিরোশি তাকাহাসিকে আরেকবার ডেকে পাঠানো হল জাপানের সদর দপ্তরে৷ গোপন আলোচনায় বসলেন সকলে৷
প্রশ্ন করা হল, ডা. তাকাহাসি, ‘কেন এই রোগজীবাণু রোগ ঘটাতে পারল না?’
উত্তরে ডা. তাকাহাসি জানালেন, ‘স্যার অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু অত্যন্ত শক্তিশালী৷ জীবাণুযুদ্ধের আদর্শ জীবাণু৷ কিন্তু এই জীবাণুর ভয়ানক ক্ষমতার উৎস দুটো প্লাজমিড৷’
‘প্লাজমিড?’
‘হ্যাঁ৷ এ ব্যাপারে একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন৷ আমরা জানি সব ধরনের কোষে রয়েছে ডি.এন.এ দিয়ে তৈরি ক্রোমোজোম৷ এই ক্রোমোজমের জিনের মধ্যে থাকে বিশেষ সংকেত যা কোষের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে৷ ব্যাকটিরিযাও তার ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু কিছু কিছু ব্যাকটিরিয়ায় ক্রোমোজম ছাড়াও আলাদা ডি.এন.এ. থাকে৷ তাকেই প্লাজমিড বলে৷ অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর দুটো প্লাজমিড রয়েছে৷ একটা প্লাজমিড তৈরি করে ক্যাপসুল৷ অন্যটা বানায় বিষাক্ত রাসায়নিক বা টক্সিন৷ ১৯৩৭ সালে স্টার্নি প্রজাতির যে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু পাওয়া গেল তাদের মধ্যে ক্যাপসুল তৈরি করার প্রাজমিড নেই৷’ কথাগুলো একটানা বলে একটু থামলেন ডা. তাকাহাসি৷
‘তার মানে,ক্যাপসুল না থাকার জন্য এদের রোগ ঘটাবার ক্ষমতা কমে গিয়েছে?’
‘ঠিক তাই৷ – আমরা জানি যেসব রোগ-জীবাণুর ক্যাপসুল থাকে তারা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সহজে ফাঁকি দিতে পারে৷ ভক্ষক কোষ তাদের গিলে নিয়ে ধ্বংস করতে পারে না৷’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য যে, এরা ভুল প্রজাতির জীবাণু বেছেছিল৷ – আচ্ছা, ডা. তাকাহাসি, ধরুন যদি এই জীবাণু সত্যিই মূল শক্তিশালী প্রজাতির হত, তাহলেও কি রোগ ছড়াতে পারত?’
‘সেখানেও আউমের লোকের অভিজ্ঞতা কাজ করেছে৷ আমাদের আমেরিকান বন্ধুরা জানিয়েছেন, আমরা যে তরল পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি, তাতে জীবাণুর পরিমাণ ছিল বেশ কম৷ প্রতি মিলিলিটার তরলে ১০,০০০ জীবাণুর স্পোর পাওয়া গিয়েছে৷’
‘কতটা থাকলে রোগ ছড়াতে পারত?’ বিদেশমন্ত্রী প্রশ্ন করেন৷
‘জীবাণু বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনও তরল জীবাণুযুদ্ধের অস্ত্রে কমপক্ষে ১০০০ মিলিয়ন জীবাণু থাকা দরকার৷ শুধু তাই নয়৷ এই জীবাণু এমনভাবে তরলে মিশিয়ে ছড়াতে হবে যাতে খুব সূক্ষ্ম কণায় সেই তরল বাতাসে ভেসে থাকতে পারে৷ অথচ যে তরল আমরা পেয়িছিলাম তা ঘন আর আঠালো৷ এই তরল থেকে অত ছোট কণা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়৷’
‘আচ্ছা, আউম সিনারিকিও-এর স্প্রে মেশিনে নাকি গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল?’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন৷
গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান ফাইল টেনে নিয়ে চোখ বুলিয়ে জানান, ‘হাঁ স্যার, ওদের সদস্যদের জেরার সময় আমরা জানতে পেরেছি, নীচু থেকে আটতলার ছাদে স্প্রে করা জীবাণু ছড়ানোর সময় মাঝে মাঝে বেশিন বসে যাচ্ছিল৷ তরলটা ঘন হওয়ার জন্য স্প্রে মেশিনের মুখ বারে বারে আটকে গেছে৷ এছাড়া ওদের টিউবও লিক করেছিল৷’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এত কিছু ব্যাপার একসঙ্গে কাজ করেছে!’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাঁফ ছেড়ে বলেন৷
ডা. তাকাহাসি জানান, ‘আরও কিছু কারণ ছিল জীবাণু ঠিকমতো না ছড়িয়ে পড়ার পিছনে৷ অ্যানথ্রাক্স রোগজীবাণুর স্পোর বা গুটি নানারকম প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকতে পারলেও সূর্যের আলোয় বেশিক্ষণ বাঁচে না৷ ওই কটা দিন মেঘলা থাকলেও সূর্যের বিকিরণ ছিল যথেষ্ট৷ এই বিকিরণের জন্য স্পোরের জীবনীশক্তি আরও কমে গিয়েছিল৷’
বিদেশমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, ওরকম দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল কেন? যদি কাজটা গোপনে করতে হয়, তবে ওই দুর্গন্ধ থেকে মানুষ তো এমনিতেই সতর্ক হয়ে যাবে৷’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্গন্ধের কারণ অনুমান করতে পারেন, ডা. তাকাহাসি?’
‘স্যার, সঠিক কারণ বলতে পারব না৷ তবে দুটো সম্ভাব্য যুক্তি আমরা রাখতে পারি৷ এমন হতে পারে, ওরা স্প্রে করার আগে এই তরল গরম করেছিল৷ বেশি গরম হয়ে যাওয়ার ফলে তরলে থাকা জৈবপ্রোটিন পুড়ে গন্ধ বেরিয়েছে৷ নয়তো যে তরল মাধ্যমে জীবাণু কালচার করা হয়েছিল, তা ওরা ভালমতো ধুয়ে ফেলতে পারেনি৷’
আলোচনা শেষ হয়৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. তাকাহাসির হাত ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে৷ – আমেরিকান বিজ্ঞানী ও অপনার টিমের জন্য নিপ্পন সরকার বিশেষ পুরস্কার দিতে চেয়েছে৷ আগামীকালই সরকারি ঘোষণা হবে৷’
‘স্যার,ক্যামিডোর পরিবেশ দপ্তরের মি. ইউতাকার কথা ভুলে যাবেন না৷ উনি নিজের কাজ সম্বন্ধে এত নিখুঁত না হলে আজ আমরা এই সাফল্য কোনওমতেই পেতাম না৷’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাথা নাড়েন, ‘ও নিশ্চয়ই৷’
ডা. হিরোশি তাকাহাসি ওঁর ফাইলগুলো নিয়ে বাইরে অপেক্ষায় থাকা গাড়িতে ওঠেন৷ গাড়ি ওঁকে নিয়ে রওনা হল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইনফেকশাস ডিজিজ-এর অফিসের দিকে৷ আকাশ থেকে অন্ধকার নামছে৷ অন্ধকার নামছে বোধ হয় পৃথিবীর ভবিষ্যতের ওপরেও৷
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২১
সমাপ্ত