রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ বাস্তব প্রেম রহস্যের এক অনুপম কাব্যোপন্যাস। আদ্যন্ত কাব্যের সুরে গ্রথিত ও অপূর্ব বাগবৈদগ্ধ্যের অসাধারণ দীপ্তিতে উজ্জ্বল এটি একটি সার্থক জীবনকাব্য, বাস্তবতার স্পর্শে সজীব ও প্রাণোচ্ছ্বল। বাংলা সাহিত্যে বইটির আবির্ভাবে, রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলা যায়, যেন ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত’। লঘুছন্দ নির্ঝরিণীর মতো অব্যাহত স্রোতে সুললিত প্রেমকাহিনিটি পরিণতির অভিমুখে সহজ ধারায় প্রবাহিত। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন একটি অনন্য ‘লিরিক উপন্যাস’ নিঃসন্দেহে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এহেন উপন্যাস পূর্বেও রচিত হয়নি, এবং পরেও রচিত হবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু অপূর্ব এই কাব্য সুষমামণ্ডিত উপাখ্যানের পাত্রপাত্রীরা শিলং পাহাড়ের উচ্চাবচ মাটির পরে চরণ ফেলে ফেলেই পাঠকচিত্তে অনাস্বাদিতপূর্ব দোলা দেয়।
পরিণত বয়সের এই রচনায় কবি জীবন ও কাব্যকে অত্যন্ত সার্থকভাবে, চরিত্র চিত্রণের বিশ্বাসযোগ্যতায় একই সূত্রে গেঁথেছেন বলেই সেটি হয়ে উঠেছে অপরূপ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জীবনের পটে ফুটে ওঠা প্রেমের রামধনুবিলাস সম্বন্ধে কবির প্রজ্ঞাঋদ্ধ জীবনদর্শন। এই জীবনবীক্ষা মিলনে মধুর নয়, বিচ্ছেদে বিধুরও নয়, কিন্তু ভরা অশেষের ধনে। সেই কথা কবির জীবনে যেমন বারবার সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে, তেমনি তাঁর সাহিত্যেও।
ঢাকা প্রবাসে আমার ধানমন্ডির আবাসে গৌরদার (গৌরকিশোর ঘোষ) আগমনে জমে ওঠা এক সান্ধ্য আড্ডায় খৈয়ামি খেয়ালে উচ্ছল পানপত্রে বেশ তুফান উঠেছিল। এপার বাংলা আর ওপার বাংলার সাহিত্য আলোচনায় হঠাৎ সেই চিরপুরাতন রবীন্দ্রনাথের কথা উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনাদের টিভি সিরিয়ালে কেন দেখি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে রবীন্দ্রনাথের ছবি, জাতীয় কবি নজরুলের বদলে। কবি বেলালভাই(চৌধুরী) ঠাট্টা করে বললেন, কেন রবীন্দ্রনাথ কি আপনাদের একলার নাকি। পুববাংলায় না এলে কি কবি নোবেল পুরস্কার পেতেন! কথায় কথায় একজন নবীন কথাসাহিত্যিক বললেন, রবীন্দ্রনাথ কবি বা গল্পকাররূপে যত বড়, ঔপন্যাসিক হিসেবে কিন্তু তত বড় নন। আমি বলে উঠলুম, সে কি কথা! রবীন্দ্রনাথ বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং নবযুগের স্রষ্টা। ‘চোখের বালি’তে মনস্তাত্ত্বিক বিচারে মানবচরিত্রের উদ্ঘাটনে যে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, ‘গোরা’তে আত্মপরিচয় আবিষ্কারে ভারতসন্ধান, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মতাদর্শ ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব অবলম্বনে ‘ঘরে বাইরে’, ‘যোগাযোগ’-এ পরিশীলিত বৈদগ্ধ্য ও ঐশ্বর্যের ইতরতার অসবর্ণ বিবাহের সংঘাত, এবং ‘শেষের কবিতা’ ও ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে প্রেমের বিচিত্ররূপ, রচনার উৎকর্ষে বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ।
রবীন্দ্র উপন্যাসের আরও একটি বিশেষত্ব হল, যে মূল সমস্যার উত্থাপনে উপন্যাসের শুরু, সেই সমস্যাটির উদ্ঘাটন ও পরিণতিতেই উপন্যাস শেষ; কাহিনিকে অযথা আদিপর্ব থেকে অন্তিমপর্ব পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রয়াস নেই। সেইজন্যে উপন্যাসটি যেখানে এসে থামে তাকে অসম্পূর্ণ বা হঠাৎ মনে হতে পারে কিন্তু তার আর পর নেই। যেমন ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস আরম্ভ হয় অমিত ও লাবণ্যর প্রথম পরিচয় পথের বাঁকে মুখোমুখি গাড়ির সংঘাতে এবং শেষও ঘনিয়ে ওঠে আর এক সংঘাতপূর্ণ ঘটনার পর।
রবীন্দ্রনাথের সফল উপন্যাসগুলি আলোচনা করলে দেখা যায়, ঘটনার অবস্থান ও প্রতিপাদ্যের বিভিন্নতা সত্ত্বেও চরিত্রচিত্রণের একটি মূল সূত্র বিদ্যমান। তা হল প্রতিটিতেই আছে দুটি পুরুষ ও একটি নারী। এবং আরও একটি ছায়া নারী চরিত্র। যেমন, ‘চোখের বালি’তে মহেন্দ্র, বিহারী ও বিনোদিনী এবং আশালতা; ‘গোরা’তে গোরা, বিনয় ও সুচরিতা এবং ললিতা; ‘ঘরে বাইরে’তে নিখিলেশ সন্দীপ ও বিমলা এবং ‘মেজরানি’; যোগাযোগ-এ, মধুসূদন, দাদা ও কুমু এবং শ্যামা; ‘শেষের কবিতা’ অমিত, লাবণ্য, শোভনলাল এবং কেটি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটে, মূল পুরুষ ও নারী চরিত্রের পরিস্ফুটনে একটি সহায়ক পুরুষ ও নারী চরিত্রের সংযোজনে ঘনিয়ে তোলা ঘটনার আবর্তনে পরিণতির অনিবার্যতায় একটি জীবনসত্যের প্রকাশ। তার প্রতিপাদনে থাকে প্রায় প্রতিটি উপন্যাসেই রবীন্দ্রনাথের চিরপরিচিত জীবনঋদ্ধ এক মুক্তবুদ্ধির চরিত্র। শেষের কবিতায় অবশ্য তার স্থান অধিকার করেছেন, মাসিমা ‘যোগমায়া’।
তবে রবীন্দ্র উপন্যাসের আরও একটি বিশেষত্ব হল, যে মূল সমস্যার উত্থাপনে উপন্যাসের শুরু, সেই সমস্যাটির উদ্ঘাটন ও পরিণতিতেই উপন্যাস শেষ; কাহিনিকে অযথা আদিপর্ব থেকে অন্তিমপর্ব পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রয়াস নেই। সেইজন্যে উপন্যাসটি যেখানে এসে থামে তাকে অসম্পূর্ণ বা হঠাৎ মনে হতে পারে কিন্তু তার আর পর নেই। যেমন ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস আরম্ভ হয় অমিত ও লাবণ্যর প্রথম পরিচয় পথের বাঁকে মুখোমুখি গাড়ির সংঘাতে এবং শেষও ঘনিয়ে ওঠে আর এক সংঘাতপূর্ণ ঘটনার পর। এই দুই সংঘাতের মাঝে অমিত ও লাবণ্যর প্রেমোপাখ্যান অবলম্বন করেই রচিত হয় এই খণ্ডকাব্য।
উপন্যাসটির শুরু হয় ‘অমিতচরিত’-এর প্রকাশ, তার বাগবৈদগ্ধপূর্ণ ফুলঝুরির দীপ্তিতে তথা কাব্যানুরাগের আভাসে। কলকাতার উচ্চকোটি মহলের আকর্ষণ, অমিতের ছিল ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের আপাত উজ্জ্বল কিন্তু ফ্যাসনদুরস্ত অন্তঃসারশূন্যতার প্রতি শাণিত ব্যঙ্গে উচ্চকিত এক প্রবল অনীহা। সেইজন্য তৎকালীন উচ্চসমাজে অপাংক্তেয় ধুতি-পাঞ্জাবির অদ্ভুত বেশবাস যেন ছিল তার সমাজের প্রচলিত ইংরেজি ধারার প্রতি এক উচ্চহাসি। কিন্তু এই বহিরঙ্গের অন্তরালে ছিল অমিতের একটি কাব্যানুরাগী কবিহৃদয়। প্রারম্ভে তার পরিচয় দিয়েই লেখক অমিতের সঙ্গে লাবণ্যর বৌদ্ধিক সম্পর্কের পটভূমি রচনা করেন। তাই অমিত সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে লাবণ্যর মধ্যে তার সমমনের কাব্য অনুরাগী চিত্তের সন্ধান পেয়ে। তাদের রাগানুরাগের সুরটি ছিল বৌদ্ধিক জগতের উচ্চতারে বাঁধা কাব্যিক আলাপে। সেটি শেষে ধাক্কা খায় বাস্তবের সংস্পর্শে এসে। তাদের বিচ্ছেদও ঘটে সংঘাতপর্বের পরবর্তী ‘শেষের কবিতায়’। সেই শেষের কবিতাটি শেষ হয় কঠিন বাস্তবের সম্বিতে।
অমিত যে কবি, তা হঠাৎ প্রকাশ পায় এক রবীন্দ্রক্ত সাহিত্যসভায়, যেখানে কবি রবীন্দ্রনাথকে নস্যাৎ করতে নতুন যুগের কবিতার নমুনা দিতে অমিতের পকেট থেকে ফস করে বেরিয়ে পড়ে অজানা আধুনিক কবি নিবারণ চক্রবর্তী। এই নিবারণ চক্রবর্তী কিন্তু আর কেউ নন, স্বয়ং বক্তা অমিত। ঠিক একইভাবে আমরা লক্ষ করব, এই অমিট রায় কিন্তু অন্য কেউ নন, মনে হয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের alter ego। বিচ্ছুরিত বাকচাতুর্যে দীপ্তিতে ও প্রসন্ন কৌতুকের অন্তঃশীল স্রোতে, কবি তাঁর উপলব্ধ মানব-মানবী প্রেমের বিচিত্র প্রকাশকে, অনিন্দ্য প্রবাহে গ্রথিত করেছেন। ফলে উপন্যাসের আধারে একটি প্রেমমধুর ও বিচ্ছেদবিধুর কাহিনি কাব্যরসের ছন্দে এক অপূর্ব রূপ পরিগ্রহ করে।
কাহিনির আখ্যানভাগ কিন্তু সেই চিরন্তনী ধারাতে বিধৃত। দুজনের দেখা হলো, সম্পর্ক নিবিড় হল, প্রেমে উদ্দীপ্ত হল, কিন্তু মিলনে অন্ত হল না, বিচ্ছেদে অনন্ত হল। এই ঘটনা নতুন কিছু নয়, নিত্যকাল ধরে চলছে সেই ‘দুটিরে মিলন নিয়ে খেলা।’ মিলনের উল্লাস পাখা মেলে কিংবা বিচ্ছেদের অকূল দরিয়ায় ভেসে, কত আকুল মন কত কথা, কত গান, কত নাট্যের সৃষ্টি করেছে। সেই মহাভারতের কচ ও দেবযানীর উপাখ্যান থেকে আরম্ভ করে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’, তা নানান রূপে মানুষকে উতলা করেছে। কচের ক্ষেত্রে দেবযানীর সঙ্গে মিলনে বাধা হয় কর্তব্যের আহ্বান, দেবদাসের ক্ষেত্রে তা ছিল বংশমর্যাদার কৃত্রিম নিগড়। কিন্তু অমিত-লাবণ্যর ক্ষেত্রে সেসবের কোনও বালাই ছিল না বটে, কিন্তু বাধা এল তাদের নিজেদের জটিল মনের টানাপোড়েনের আধুনিক দ্বন্দ্বে। দুটি মন যারা কাছাকাছি এসেছিল, এক আকস্মিক কারণে সরে যেতে বাধ্য হল বাস্তব বৈষম্যের কঠিন উপলব্ধিতে। এখানেই রচনাকার রবীন্দ্রনাথের জীবনানুগ চিন্তার বৈশিষ্ট্য, এক অমোঘ জীবনসত্যে প্রতিফলিত।
অমিত ও লাবণ্যর বিচ্ছেদ নিয়ে মননশীল পণ্ডিতদের মধ্যে আছে তুমুল বিতর্ক। কবি-প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু বিচ্ছেদের জন্য দায়ী করেছেন, অমিতের ভীরু পলায়ন-তৎপরতাকে, যে অমিত কথার ফুলঝুরির আড়ালে, সত্যকে স্বীকার করতে পারেনি। কবি অমিয় চক্রবর্তী আবার বলেন, আসলে অমিত আর্টিস্ট, সে চেয়েছে কেতকীকে তার সঙ্গিনীরূপে নবনির্মাণ করতে। আবার কবির একদাসচিব কাননবিহারী মুখোপাধ্যায় অগ্রাধিকার দিয়েছেন বিচ্ছেদের মূলে নর-নারীর প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতাকে।
‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে, রবীন্দ্রনাথ অমিতকে সজীব প্রাণোচ্ছ্বল, বাকচাতুর্যে উজ্জ্বল এক রসগ্রাহী মনের জীবন্ত পুরুষরূপে এঁকেছেন, কিন্তু কবি অমিয় চক্রবর্তীর মতানুযায়ী আর্টিস্টিক প্রেরণায় নবরূপে মানবী নির্মাণে অমিতের কোনও অভিলাষ বা দক্ষতার পরিচয় দেননি। এটি মনে হয়, নেহাতই অমিয় চক্রবর্তীর কবি কল্পনা-জাত। আর বুদ্ধদেব বসু যে অমিতের চারিত্রিক দুর্বলতাকে বিচ্ছেদের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন, তাতে সংশয়ের অবকাশ আছে। তার কারণ কবিরা যে পরিমাণে কাব্যরচনায় কল্পবিহারে দক্ষ, মানবমনের জটিলতা ভরা বাস্তবের পটে জীবনকে বুঝতে ততটা পারদর্শী নন। তাঁরা কাব্যকলার মাধ্যমে জীবনকে দেখতে অভ্যস্থ বলেই এই বিভ্রম। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের থেকেও জীবনবীক্ষণে অধিকতর ক্রান্তদর্শী বলেই তাঁর রচনা এত জীবনানুগ।
রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’ রচনা করেছেন, জীবনের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পূর্ণ পরিণত সপ্ততিতম বর্ষের প্রাক্কালে। তার ঠিক আগে আগেই এসেছিল তাঁর দুটি প্রেমের পর্ব। একজন স্বদেশি ও অন্যজন বিদেশি। দু’জনই অসামান্য সুন্দরী, ও মননশীলতার ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল। এবং দু’জনেই উত্তরপর্বে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথমজন উদ্ভিন্নযেৌবনা রাণু অধিকারী (পরে লেডি রাণু মুখার্জি) তার প্রথম প্রেমের উদ্দামস্রোতে কবিকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তা থেকে কবি নিজেকে মুক্ত করে বিদেশে পাড়ি দিলেন। সেখানে মিলল পরিণতবুদ্ধি বহু ভাষাবিদ বিদূষী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর, যিনি কবিকে সঙ্গ, সেবা ও ভক্তিতে গুরুর প্রতি শিষ্যার মতো, সবদিক দিয়ে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ যদিও এই বিচ্ছেদের প্রসঙ্গে অমিতের মুখে পরবর্তী পর্যায়ে অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু সেটি তাঁর প্রেমদর্শনের এক বিশ্লেষণ মাত্র। মূল ভাবটি কিন্তু লাবণ্যর শেষের কবিতায় খুব সুন্দরভাবে ধরা পড়ে। সেই উপন্যাসের সত্য কিন্তু বারবার জীবনের পটে ধরা পড়ে; কারণ মানুষের সব চাওয়া সব পাওয়া এক বিন্দুতে মেলা প্রায় দুর্লভ। তাই একের কারণে আর এককে ছাড়তে হয়। সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য দক্ষ তালবাদ্য শিল্পীর একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু তার বাইরে শিল্পীর যে জীবন তার সঙ্গে তার কোনও যোগ নাও থাকতে পারে। দুই-এ মিলে এক হলে সোনায় সোহাগা। কিন্তু প্রায়শই তার দেখা মেলা কোটিতে গোটিকের মতো।
রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’ রচনা করেছেন, জীবনের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পূর্ণ পরিণত সপ্ততিতম বর্ষের প্রাক্কালে। তার ঠিক আগে আগেই এসেছিল তাঁর দুটি প্রেমের পর্ব। একজন স্বদেশি ও অন্যজন বিদেশি। দু’জনই অসামান্য সুন্দরী, ও মননশীলতার ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল। এবং দু’জনেই উত্তরপর্বে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথমজন উদ্ভিন্নযেৌবনা রাণু অধিকারী (পরে লেডি রাণু মুখার্জি) তার প্রথম প্রেমের উদ্দামস্রোতে কবিকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তা থেকে কবি নিজেকে মুক্ত করে বিদেশে পাড়ি দিলেন। সেখানে মিলল পরিণতবুদ্ধি বহু ভাষাবিদ বিদূষী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর, যিনি কবিকে সঙ্গ, সেবা ও ভক্তিতে গুরুর প্রতি শিষ্যার মতো, সবদিক দিয়ে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কবি সেখান থেকেও মুক্তপক্ষ হয়ে নীড়ের দিকে যাত্রা করেছেন। অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী, সরস ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব এবং সুকণ্ঠ কবির জীবনে অনেক পরিশীলিত বিশিষ্ট অনুরাগিণীর আগমন ঘটেছে, সেই বোম্বাই প্রদেশের ইংরেজি শিক্ষিত সুন্দরী আন্না তড়খড়ে থেকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো অবধি। কিন্তু কোথাও কবিচিত্ত নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেননি। তবে সে সবকে স্বীকার করে কবি বলেছেন, জীবনে অনেক প্রেম এসেছে, কিন্তু কোনও প্রেমকে আমি কখনও অসম্মান করিনি। সেই জন্যেই বোধ হয় তিনি একটি কবিতায় লিখতে পেরেছিলেন, ‘এমনি একান্ত করে কাছে পাওয়া এও সত্য যত, এমনি একান্ত ছেড়ে যাওয়া এও সত্য তত।’
নারীর সৌন্দর্য ও মাধুর্যমণ্ডিত অপরূপ রূপে মুগ্ধ কবির জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই মানব-মানবী প্রেম সম্বন্ধে একটি গভীর বোধ গড়ে ওঠে, যার একটি পরিণত ছবি আমরা পাই ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে। বিচিত্রগামী মনে প্রেম শুধুমাত্র একটিমাত্র ধারার প্রকাশে সীমাবদ্ধ না থেকে বহু বিচিত্র ধারায় প্রবাহিতা। সেখানে যদি একের সঙ্গে আর একের মিলন হয় খুবই ভালো। কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে সেটি ভিন্ন ধারায় বাঁক নিতে বাধ্য। কবির ক্ষেত্রে এই প্রেমের বিশেষত্ব হল, তিনি বার বার পক্ষবিস্তার করে মধুরের পারে পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু শেষে মুক্তপক্ষ হয়ে আবার ফিরে এসেছেন আপন কুলায়। কথিত আছে একবার ঠাকুরবাড়ি থেকেই রবীন্দ্রনাথের পুনর্বিবাহের প্রস্তাব আসে। তখন উদ্বিগ্ন কবি, দীনেশচন্দ্র সেনকে তাঁর ভবিষ্যৎ ভাবনায় কোষ্ঠী বিচারের ভার অর্পণ করেন। দীনেশচন্দ্র অভিজ্ঞ জ্যোতিষীর পরামর্শে অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে, তাঁর জীবন মুক্তপুরুষের, সেখানে পুনর্বার বিবাহবন্ধনের কোনও স্থান নেই।
চেনা ছকের বাইরে ফ্যাসনের মোড়কযুক্ত সহজসুন্দর লাবণ্যর অভাবিত অকর্ষণ অচিরেই সমমনস্কের বুদ্ধিদীপ্ত সখ্যে পরিণত হয়। এই বিষয়ে কবি অমিতর মনের ভাব প্রকাশ করে বলেন, “অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে, তাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমারাত্রির মতো উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন; লাবণ্যর সৌন্দর্য সকালবেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত।”
রবীন্দ্রনাথ ঋষিকল্প জীবনমুখী পিতার অদর্শে, বৈরাগ্যের সাধনা করেননি, ‘যা কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে’— এই প্রতীতীতে একান্ত বিশ্বাসী। কিন্তু আচরণের ক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করতেন, ‘ভোগেরে বেঁধেছো তুমি সংযমের সাথে’। সেই জন্যেই তাঁর পিতার অদর্শে, ঈশোপনিষদের ‘তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জিথাঃ’, তাঁর জীবনেরও মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছে। ফলে প্রেম বার বার তাঁর জীবন ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভে ভরিয়ে দিয়েছে অলোকসুন্দর অনুভবে। সেখানে কিন্তু মত্ত মধুপের লুব্ধ সঞ্চয়ের কোনও স্থান নেই। তাই তাঁর ষাটোর্ধ্ব পরিণত বয়সে রাণু কিংবা ভিক্টোরিয়ার মতো অনিন্দ্যসুন্দর নারীরাও তাঁকে প্রেমের জাদুতে আবদ্ধ করতে পারেনি। কিন্তু নেপথ্যে থেকে প্রেরণাস্বরূপ হয়েছে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যসের সৃষ্টিতে।
অলোচ্য উপন্যাসে অমিত-লাবণ্য ও তাদের অনুষঙ্গে শোভনলাল ও কেতকীর যে চতুষ্কোণ প্রেমের দ্বন্দ্বু গড়ে ওঠে, তার পরিণতির বাস্তবতা সম্বন্ধে বিদগ্ধজনেরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেমন ‘শেষের কবিতা’ নিয়ে বুদ্ধদেব বসু ও অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে এক তুমুল তর্কবিতর্কের সৃষ্টি হয়। বুদ্ধদেব বলেন, “…‘শেষের কবিতা’ যে কারণে অপরাধী তার নাম অমিত রায়। বইটি সে আগাগোড়া জুড়ে আছে, এবং আগাগোড়া সে আর কিছুই করে না, শুধু কথা বলে।… তার বাগ্মিতার ফাঁকা আওয়াজ, তার নাবালকচরিত্র— যার আভাস পেয়ে বোন সিসি তাকে বিম্ববিলাসী বলেছিল। আর যোগমায়া আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ব্যাপারটা না বাল্যবিবাহে দাঁড়ায়। সত্যি বলতে, এই বইতে লেখক যাদের পক্ষপাতী তারা চরিত্র হিসেবে নিস্তেজ; যারা বিদ্রূপের বিষয় তাদেরই আমরা ভুলতে পারি না; লাবণ্যর চেয়ে কেটি অনেক জীবন্ত, শোভনলালের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল নরেন মিটার।…।”
এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, কবি অমিয় চক্রবর্তী বলেন, “আমি তো বলি রবীন্দ্রনাথ লাবণ্যের প্রতি অবিচার করেননি।… লাবণ্য অতি উজ্জ্বল সম্পূর্ণ প্রকাশ পেয়েছে আমাদের কাছে— আমরা তার লাবণ্যময়ী স্থির মননশীল গম্ভীর প্রকৃতির পরিচয় পেলাম, সব মিলিয়ে তার চরিত্রের মধ্যে একটি নিগূঢ় সংগহতিই যেন আগাগোড়া লক্ষ করেছি।” অমিত সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে অমিত চক্রবর্তী বলেন, ‘কেটিকে বিবাহ করে অমিত দুই দিক থেকে আপন চরিত্রকে বেঁধে তোলবার সুবিধা পেল– প্রথমত মানুষ গড়বার সুখ আর্টিস্ট মাত্রেরই যেটা অন্যতম সুখ, কেটিকে নিয়ে তার চর্চা অমিত করতে পারবে। লাবণ্যকে নিয়ে সেই চর্চা হতে পারত না, কেননা লাবণ্য যে গড়া-মানুষ, পূর্ণস্বভাবা সুলক্ষণা মেয়ে– তাকে নিয়ে গড়বার সাধ্য নয় অমিতের, বিধাতা তাকে আগে পূর্ণ করে গড়ে তুলেছেন। মিস কেটিকে শ্রীমতী কেতকী দেবী করে তোলবার কাজে অমিত আপন সৃষ্টিশীলতার আনন্দ পাবে।”
তার প্রত্যুত্তরে বুদ্ধদেব বলেন, ‘অমিয়বাবু এই কথার উপরেই জোর দিয়েছেন যে অমিত রায় আর্টিস্ট— বোহেমিয়ান আর্টিস্ট— আর লাবণ্যও আর্টিস্ট না হলেও তার সমকক্ষ, তাই এ দুজনের দাম্পত্যবন্ধনে মঙ্গল হতো না। এ প্রসঙ্গে অনেক কথাই এসে পড়ে, কিন্তু সে সব তর্কের প্রয়োজন নেই কেননা অমিত রায়কে আমার একবারও শিল্পী বলে মনে হয়নি, বোহেমিয়ান তো কিছুতেই নয়।… সৌন্দর্যের আধার হয়েও এই গ্রন্থ যে তৃপ্তিকর হলো না, তার কারণ, — আমি জোর করেই বলবো— অমিত রায়ের অযোগ্যতা তারই পৌরুষের অভাবে লাবণ্য মলিন হয়ে গেলো, এবং বিপন্ন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজস্ব কবিসত্তায় রঙ্গমঞ্চে পা দিতে হলো।’
অভিজ্ঞতা ও সঠিক বোধের অভাবে যে শেষের কবিতার পরিসমাপ্তি, বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে সেকথা ভেবেই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ, অমিত ও যতিশংকরের কথোপকথনের মাধ্যমে একটি ব্যাখ্যা যোগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নতুবা বিচ্ছেদের সম্পূর্ণ ভাবটি লাবণ্যের শেষ কবিতায় সুপরিস্ফুট। এই ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কথা প্রসঙ্গে তাঁর একদা সাহিত্যসচিব কাননবিহারী মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্নের উত্তরে বিষয়টিকে প্রাঞ্জল করেন। কবি বলেন, “আমরা অনেক সময় কয়েকটা মনগড়া ধারণা নিয়ে সাহিত্যের মধ্যে তত্ত্ব আলোচনা করতে চাই, তাই সব পণ্ড হয়। কোন ভালোবাসা বড়, কোন ভালোবাসা ছোট— সে বিচার লেখকের নয়। উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্ব নিয়ে আর নিছক তত্ত্ব আলোচনা করে যারা মরে, তারা জীবনকে চায় না, জীবনকে বুঝতে পারে না।”
শেষের কবিতা নাকি খুব হালকাভাবে লেখা, কাননবিহারীর এই প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “যারা একথা বলে ‘শেষের কবিতা’র কিছুই বোঝেনি তারা। অমিত গভীর কথা হালকাভাবে বলত। সে নিজে হালকা মানুষ ছিল না। বইখানা একেবারই হালকা ভাবে লেখা নয়।”
অমিত শেষে কেতকীকে বিয়ে করলো কেন?— কাননের এই প্রশ্নের উত্তরে কবি বললেন, অমিত শেষ পর্যন্ত দেখলে লাবণ্যকে সে কিছুতেই পাবে না। অথচ কেতকীকে সে একদিন সত্যিই ভালোবেসেছিল। তারপর ঘটনাচক্রে তাতে ছেদ পড়ে। কেতকী কিন্তু অমিতকে ভোলেনি। সে দীর্ঘদিন বহন করে এসেছে প্রেমের বেদনা। সেই বেদনার কথা অমিত যখন জানতে পারলো, তখন তার মনে পুরাতন প্রেম আবার নতুন আকর্ষণ নিয়ে জেগে উঠল। অমিত, লাবণ্য ও কেতকী দু’জনকেই ভালোবাসত। কিন্তু দু’জনের কাছে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের প্রতিদান আশা করত। কেতকীর কাছ থেকে সে চাইত সেবা, শুশ্রূষা— সাধারণত সংসার জীবনে পুরুষ মেয়েদের কাছ থেকে যা চায়। কিন্তু লাবণ্যর কাছ থেকে তার মন প্রত্যাশা করেছিল সঙ্গ। অমিতের পক্ষে তার দুই ভালোবাসাই সত্যি।”
শেষের কবিতা নাকি খুব হালকাভাবে লেখা, কাননবিহারীর এই প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “যারা একথা বলে ‘শেষের কবিতা’র কিছুই বোঝেনি তারা। অমিত গভীর কথা হালকাভাবে বলত। সে নিজে হালকা মানুষ ছিল না। বইখানা একেবারই হালকা ভাবে লেখা নয়।” কবির কথার সূত্র ধরে আমরা অনায়াসেই বলতে পারি, অমিতের মতো Witty বা quick repartee-এর লোক জগতে বিরল নয়। অস্কার ওয়াইল্ড বা বার্নাড’শ হাতের কাছই রয়েছেন, তাঁদের ব্যক্তিত্বের ও রচনার ঔজ্জ্বল্যে। তাছাড়া আমাদের বাংলা সাহিত্যেও তা বিরল নয়, দাদাঠাকুর বা শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের wit ছিল যেমন মজার তেমনি সারগর্ভ। আর রবীন্দ্রনাথ তো এ বিষয়ে অতুলনীয়। তাছাড়া হালকা চালে গভীর কথা বলার নিদর্শন তো Shakespeare-এর fool এবং দ্বিজেন্দ্রলালের বিদূষক চরিত্রের মধ্যে বর্তমান। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেও এমন উজ্জ্বল বাকচাতুর্যে ভরা আকর্ষণীয় চরিত্র বিরল নন, যাঁরা যে কোনও সমাবেশের মধ্যমণি হয়ে সর্বজনপ্রিয় তথা অনুরাগিণীদের আরাধ্যা। নারীর সৌন্দর্যের মতোই পুরুষের এই ব্যক্তিত্বের দ্যুতি তাঁদের চরিত্রের অন্যতম আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
অভ্যস্ত পরিচিতসঙ্গ ও পরিবেশের বাইরে যাওয়ার জন্যই অমিতের দার্জিলিং ছেড়ে শিলং গমন, এবং ঘটনাক্রমে গাড়ি সংঘর্ষের ফলে উচ্চ সমাজের কোলাহলের চেনা ছকের বাইরে দেখা যায় লাবণ্যকে স্বভাব সৌন্দর্যের উজ্জ্বল বিভায়। তার সম্বন্ধে বর্ণনায় আছে, “ড্রয়িংরুমে এ মেয়ে অন্য পাঁচজনের মাঝখানে পরিপূর্ণ আত্মস্বরূপে দেখা দিত না। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়। তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না।” তবে এই চেনা ছকের বাইরে ফ্যাসনের মোড়কযুক্ত সহজসুন্দর লাবণ্যর অভাবিত অকর্ষণ অচিরেই সমমনস্কের বুদ্ধিদীপ্ত সখ্যে পরিণত হয়। এই বিষয়ে কবি অমিতর মনের ভাব প্রকাশ করে বলেন, “অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে, তাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমারাত্রির মতো উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন; লাবণ্যর সৌন্দর্য সকালবেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত।”
এই বুদ্ধিদীপ্ত ও কাব্যামোদী সঙ্গের উৎকর্ষেই তাদের সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়। আকস্মিক সাক্ষাৎ, কাব্যচর্চায় ঘনিষ্ঠতা, নিবিড় বন্ধুতা, শেষে পরিণত হয় পারস্পরিক প্রেমে। অবশেষে পরিণয়ের প্রস্তাব প্রতিশ্রুতিতে এগিয়ে যায় অঙ্গুরীয়দান অবধি। কিন্তু তখনই শিলং-এর আকাশে দেখা গেল মেঘের ঘনঘটা ও সংকটের গুরু গুরু ধ্বনি। অমিতর বন্ধুবর্গের শিলং আগমন ও আকস্মিক অভিযান যোগমায়ার বাড়িতে। তার নেতৃত্বে অবশ্যই ছিল কেটি তথা কেতকী। কেননা সেই বোধ হয় অমিতর অভাব অনুভব করছিল সবচেয়ে বেশি। পরে অমিতর সন্ধানে এখানেই প্রেমমুখর কাব্যিক ছন্দের একটা নাটকীয় মোড় নেয়, যার ফলে ঘটনার ভূমিকম্পে নদীর স্রোত পরিবর্তনের মতোই সংশ্লিষ্ট সকলের জীবনে নেমে আসে অভাবনীয় পরিবর্তন।
কেতকী ও সিসির উগ্র সাজসজ্জা ও ইঙ্গ-বঙ্গ সুলভ ব্যবহার দেখেই লাবণ্যর চেতনায় ধরা পড়ে, যে অমিতকে সে এতদিন জেনে এসেছে, সামাজিক অবস্থানে সে কিন্তু অন্য বলয়ের। সেই সমাজের সঙ্গে লাবণ্যর মোটেই কোনও মিল নেই। তাই সে নারীসুলভ সহজ বুদ্ধিতে বুঝতে পারে তাদের অসম সামাজিক বিবাহ মোটেই সুখের হতে পারে না। কেননা, হয় তাকে অমিতর সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে নিজের চরিত্র বদলাতে হবে। অথবা অমিতকে তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে তার পুরনো সমাজকে ত্যাগ করতে হবে। নারীর সহজ বিচক্ষণতায় লাবণ্য এই প্রত্যক্ষ সত্যের মুখোমুখি হয়ে স্থির সিদ্ধান্তে অটল হয়, বিচ্ছেদে।
ইতিমধ্যে কিন্তু লাবণ্যের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। অমিতর সংস্পর্শে এসে তার মধ্যে প্রেমের স্পর্শে হয়েছে নারীত্বের নবোন্মেষ। এই বোধের একান্ত অভাবেই লাবণ্য পিতার পুনর্বিবাহে রুষ্ট হয়ে ঘর ছাড়ে এবং শোভনলালের নীরব প্রেমের গভীর অনুরাগকে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু অমিত তার মধ্যে যে প্রেমের ফল্গুধারার সঞ্চার করে, সেই জাগ্রত প্রেমের প্রভাবেই সে শোভনলালের নিরুচ্চার প্রেমকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। সেই প্রসঙ্গ পরিস্ফুট করতে কবি উল্লেখ করেছেন যোগমায়ার সঙ্গে লাবণ্যর কথাবার্তার। যোগমায়া যখন বললেন, “আজ আমার বোধ হচ্ছে, কোনোকালে তোমাদের দুজনের দেখা না হলেই ভালো হত।” লাবণ্য চকিতে উত্তর দেয়—“না না, তা বোলো না। যা হয়েছে এছাড়া আর কিছু যে হতে পারত এ আমি মনেও করতে পারিনে। এক সময়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আমি নিতান্তই শুকনো— কেবলবই পড়ব আর পাশ করব, এমনি করেই আমার জীবন কাটবে। আজ হঠাৎ দেখলুম, আমিও ভালোবাসতে পারি। আমার জীবনে এমন অসম্ভব যে সম্ভব হল এই আমার ঢের হয়েছে। মনে হয়, এতদিন ছায়া ছিলুম, এখন সত্য হয়েছি। এর চেয়ে আর কী চাই। আমাকে বিয়ে করতে বোলো না, কর্তামা।”
অমিতকে না পাওয়ার বেদনা থেকেই সে শোভনলালকে বলতে পারে, “যে আমারে দেখিবারে পায়, অসীম ক্ষমায় ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,… এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।” ব্যাপারটা খুবই সরল এবং সোজা সেখানে অযথা নারীপুরুষের তত্ত্ব আরোপ করা পণ্ডশ্রম মাত্র।
লাবণ্যর সঙ্গে বিবাহ না হওয়ায় পরিশীলিত ভাববিলাসী অমিতের মনে কোন গ্লানি ছিল না। কারণ ওর পাওয়ার মধ্যে কোন ফাঁক নেই। কেননা ও বুঝেছে, ওর মানসিক পক্ষবিস্তারের জন্য লাবণ্যের যে বন্ধুত্ব সে চেয়েছিল, তা ও নিঃশেষে পেয়েছে। তাই এই বিচ্ছেদে তার বিশেষ ক্ষতি হয়নি। লাবণ্যও তাই বলেছিল, “তোমার হয়নি কোনও ক্ষতি।” কিন্তু লাবণ্য তো অমিতের মধ্যে কেবল ভাবরসের সম্ভোগ খোঁজেনি, সে আরো বেশি বাস্তব কিছু চেয়েছিল। তাই এই বিচ্ছেদকে ও নির্বিকার চিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। বিচ্ছেদের পর ওর মনের গোপন কোণে লুকিয়েছিল বেশ একটু গ্লানি। তাই ওর শেষ কবিতার মধ্যে রয়েছে বেশ একটু বিষাদের সুর। ও ওর অজ্ঞাতেই বলছে, “যা মোর ধূলির ধন! যা মোর চক্ষের জলে ভিজে!”
লাবণ্যর ব্যাপারটা যতটা সহজে নিষ্পত্তি করা যায় অমিতর হঠাৎ পরিবর্তনটা কিন্তু অনেকের কাছেই সন্দেহের অবকাশ রাখে। অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আলোচনায় বলেন, “লাবণ্যর পরিবর্তন অপেক্ষা অমিতের পরিবর্তন আমাদের বিশ্বাসপ্রবণতার উপর অধিকতর ভার চাপায়। অমিতের ছিল কেটির প্রতি বিতৃষ্ণা; আর এই বিতৃষ্ণার কারণে প্রেমের ছলনার সহিত অতি পরিচয়। অপরিচয়ের উপেক্ষা পরিচয়ের আকর্ষণে রূপান্তরিত হওয়া সহজ; কিন্তু অতি পরিচয়ের বিতৃষ্ণার প্রতিষেধক এত সহজপ্রাপ্য নহে। এই অমিত ও কেটির ব্যাপারটাই উপন্যাসের কেন্দ্রস্থ দুর্বলতা, ইহার নিখুঁত সমন্বয় কৌশলের একমাত্র ত্রুটি। শেষের কবিতা নামক শেষ অধ্যায়ে ইহার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে তাহা কবিকল্পনাত্মক, মনস্তত্ত্বমূলক নহে।”
অধ্যাপক বন্দোপ্যধ্যায় বোধ হয় লক্ষ করেননি, উপন্যাসে বর্ণিত সাত বছর আগের ঘটনার কথা। “আজ সাত বৎসর হয়ে গেল, কেটির বয়স তখন আঠারো। সেদিন এই আংটি অমিত নিজের আঙুল থেকে খুলে ওকে পরিয়ে দিয়েছিল। তখন ওরা দুজনেই ছিল ইংলন্ডে। অক্সফোর্ডে একজন পাঞ্জাবি যুবক ছিল কেটির প্রণয়মুগ্ধ। সেদিন আপোষে অমিত সেই পাঞ্জাবির সঙ্গে নদীতে বাচ খেলেছিল। অমিতেরই হল জিত। জুন মাসের জ্যোৎস্নার সমস্ত আকাশ যেন কথা বলে উঠেছিল, মাঠে মাঠে ফুলের প্রচুর বৈচিত্র্যে ধরণী তার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। সেই ক্ষণে অমিত কেটির হাতে আংটি পরিয়ে দিলে। তার মধ্যে অনেক কথাই উহ্য ছিল, কিন্তু কোনো কথাই গোপন ছিল না। সেদিন কেটির মুখে প্রসাধনের প্রলেপ লাগেনি, তার হাসিটি সহজ ছিল, ভাবের আবেগে তার মুখ রক্তিম হতে বাধা পেত না। আংটি হাতে পরা হলে অমততার কানে কানে বলেছিল—
‘Tender is the night
And haply the queen moon is on her throne.’
কেটি তখন বেশি কথা বলতে শেখেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল যেন মনে মনে বলেছিল, “মন্ আমী”, ফরাসী ভাষায় যার মানে হচ্ছে- বঁধূ!” লাবণ্যকে না পাওয়ার বাস্তবতায় অমিতের মনে সেই সেদিনের Old flame নবভাবে উদ্দীপ্ত হয়।
উপন্যাসটির মধ্যে কোথাও কিন্তু লাবণ্য-শোভনের বাক্যালাপের কথা নেই। কিন্তু তার একটি পূর্ব প্রসঙ্গ আছে। শোভনলালের নীরব প্রেম, প্রকাশের অভাবে লাবণ্যর প্রতীক্ষা অবশেষে বিদ্বেষে পরিণত হয়ে তাকে রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু শোভনের চিঠি পেয়ে তার প্রতি অকারণ দুর্ব্যবহারের জন্যে লাবণ্যের নব-জাগ্রত মনে বিগলিত করুণার উদ্রেকে, অনুতপ্ত হৃদয়ে লাবণ্য শোভনের প্রেমের গভীরতাকে উপলব্ধি করে তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রেমের অভিষেক হতে এখনও দেরি। দ্বিতীয়ত কেটির প্রতি অমিতের বিতৃষ্ণার কোনও পরিচয় কোথাও আমরা পাই না। বরং কেটির হাতের আংটিই প্রমাণ করে, তাদের পূর্বরাগের কথা। পরে উচ্চ সমাজের গড্ডলিকাপ্রবাহে তা হয়তো চাপা পড়ে যায় কিন্তু পথ হারায় না। মনে হয় কেটি অমিতকে একান্ত আপন করে জেনেছিল বলেই, কেটির প্ররোচনায় কেটির ভাই নরেন মিটার ও তার বন্ধুনি অমিতের বোন সিসি, অবশেষে অমিতের সন্ধানে আসে শিলং পাহাড়ে। তারপর সকলের সামনে আংটি পর্বে তার পরাভবে যখন কেটির এনামেল করা মুখের পরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তখন সেই অশ্রু তার অন্তরস্থিত হৃদয়কে অবারিত করে। অমিত তখন তার পুরনো প্রেমকে আবার নবভাবে আবিষ্কৃত করে উদ্দীপ্ত হয়। লেখক আশ্চর্যভাবে লাবণ্যর সঙ্গে আংটিপর্ব সেরে রেখেছিলেন বলেই এই নাটকীয় মোড় সম্ভব হয়। অসম বিবাহের শোচনীয় পরিণাম রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন ভিন্ন প্রেক্ষিতে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে।
এই প্রসঙ্গে কাননবিহারী মুখোপাধ্যায় বলেন, “শেষের কবিতায় যা মূল তত্ত্ব তা চরিত্রের মধ্যে রূপ দিতে গিয়ে কথাকার বাস্তবতার সংস্পর্শ হারাননি। তাই দেখা যায় উপন্যাসের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত চরিত্রগুলি পূর্ণাবয়ব ও সুসঙ্গত। চরিত্রগুলির যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে গ্রন্থের আরম্ভ হয়েছিল, শেষ অধ্যায়ে দেখি তাদের পরিণতি খুব স্বাভাবিক। লাবণ্যর সঙ্গে বিবাহ না হওয়ায় পরিশীলিত ভাববিলাসী অমিতের মনে কোন গ্লানি ছিল না। কারণ ওর পাওয়ার মধ্যে কোন ফাঁক নেই। কেননা ও বুঝেছে, ওর মানসিক পক্ষবিস্তারের জন্য লাবণ্যের যে বন্ধুত্ব সে চেয়েছিল, তা ও নিঃশেষে পেয়েছে। তাই এই বিচ্ছেদে তার বিশেষ ক্ষতি হয়নি। লাবণ্যও তাই বলেছিল, “তোমার হয়নি কোনও ক্ষতি।” কিন্তু লাবণ্য তো অমিতের মধ্যে কেবল ভাবরসের সম্ভোগ খোঁজেনি, সে আরো বেশি বাস্তব কিছু চেয়েছিল। তাই এই বিচ্ছেদকে ও নির্বিকার চিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। বিচ্ছেদের পর ওর মনের গোপন কোণে লুকিয়েছিল বেশ একটু গ্লানি। তাই ওর শেষ কবিতার মধ্যে রয়েছে বেশ একটু বিষাদের সুর। ও ওর অজ্ঞাতেই বলছে, “যা মোর ধূলির ধন! যা মোর চক্ষের জলে ভিজে!”
ভাঙাগড়াটা খুব স্পষ্ট হলেও কবি, বিভ্রান্তি নিরসনে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে কল্পনাত্মক। কিন্তু জীবনের ঘটনা সেকথা বলে না। সুপ্ত প্রেম আবার জাগ্রত হওয়া কিছু অসম্ভব নয়। আসলে অমিত ও লাবণ্য পরস্পরের প্রভাবে প্রেমের অভিষেকে কেতকী ও শোভনলালের নিরুচ্চার প্রেমকে অনুভব করতে সমর্থ হয়। তাদের সেই নবজাগ্রত চিত্তের প্রসাদেই তারা কেতকী ও শোভনলালের প্রেমকে স্বীকৃতির মর্যাদা দিতে মনস্থ করে। প্রেমস্নিগ্ধ হৃদয়ে প্রেমমুগ্ধ প্রেমাস্পদের গ্রহণে জীবনে নতুন অধ্যায় রচনা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।
শেষের কবিতায় জীবন ব্যাখ্যায় অমিত যে নিত্যনৈমত্তিক ব্যবহারের ঘড়ার জল ও দিঘি সন্তরণের কথা বলেছে, সেটা তো একান্ত বাস্তব। অমিত যতিশঙ্করকে বলে, “যে ভালোবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয়া সঙ্গ; যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সবকিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে, সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।”
“তোমার কথা ঠিক বুঝছি কি না সেইটেই বুঝতে পারি নে। আর একটু স্পষ্ট করে বলো অমিতদা,” যতিশঙ্কর বলে। অমিত বললে, “একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার ওড়ার আকাশ; আজ আমি পেয়েছি আমার ছোট্ট বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি। কিন্তু আমার আকাশও রইল।”
“কিন্তু বিবাহে তোমার ঐ সঙ্গ-আসঙ্গ কি একত্রেই মিলতে পারে না।”
“জীবনে অনেক সুযোগ ঘটতে পারে কিন্তু ঘটে না। যে মানুষ অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা একসঙ্গেই মিলিয়ে পায় তার ভাগ্য ভালো; যে তা না পায়, দৈবক্রমে তার যদি ডান দিক থেকে মেলে রাজত্ব আর বাঁ দিক থেকে মেলে রাজকন্যা, সেও বড়ো কম সৌভাগ্য নয়।”
সব প্রেম সম্পর্ক কিন্তু বিবাহে পরিণতি লাভ করে না, তার দৃষ্টান্ত জীবনে ও সাহিত্যে প্রচুর। এই সঙ্গে আমি বিবাহবিচ্ছিন্ন দুটি অমলিন প্রেমের বাস্তব জীবনের কথা উল্লেখ করব। একটি স্বদেশি ও অপরটি বিদেশি। প্রথমজন প্রথিতযশা উর্দু কবি ও ঔপন্যাসিক, অসামান্য স্বাধীনচেতা পাঞ্জাবিভাষী অমৃতা প্রীতম। এবং অপর জন বিশ্ববিখ্যাত লেবানিজ আমেরিকান কবি ও চিত্রকর খলিল জিব্রান।
জীবনেও দেখি একই ঘটনার ছায়াপাত। উপনিষদের ঋষি যাজ্ঞবল্কের দুই স্ত্রী মৈত্রয়ী ও কাত্যায়নীর মতো, স্বয়ং কবির জীবনেও তা একান্ত সত্যরূপে প্রমাণিত। যেমন কবির সঙ্গে গৃহলক্ষ্মী মৃণালিনী দেবীর ছিল অত্য্ত নিবিড় গৃহস্থী সম্পর্ক। মৃণালিনী তাঁর স্বামীকে খুশি করার জন্যে প্রাণপাত পরিশ্রম করতেন; কবির অতিথিদের জন্য নিত্যনতুন ফরমায়েশি রান্না করতেন; শান্তিনিকেতনে এসে আশ্রমমাতার ভূমিকা পালন করেছেন; আশ্রমের জন্যে নিজের অলঙ্কার বিসর্জন দিয়েছেন। আবার সাধারণ বধূর মতোই মাধুরীলতার বিয়ের সময় কবির বাস্তববুদ্ধির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। তাই মৃণালিনী দেবীর অকালপ্রয়াণে, কবি দিশেহারা হয়ে বলেন, এমন শূন্যতা যে কারোর সঙ্গে মন খুলে দুটো কথা বলব তাও উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত মৃণালিনী দেবীর আত্মীয়া এসে সংসারের ভার গ্রহণ করলে রবীন্দ্রনাথ আশ্বস্ত হন। পরে কবির গৃহস্থ জীবনের সমস্ত ভার গ্রহণ করেন পুত্রবধূ প্রতিমা।
মৃণালিনীকে কবি ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধনে যেসব চিঠি লিখেছেন তা নিতান্তই গৃহস্থালী সমাচারে পূর্ণ। একই সময়ে তিনি তাঁর হৃদয়ের ভাব প্রকাশ করে চিঠির পর চিঠি লিখেছেন, ভাইঝি ইন্দিরাকে, যেগুলি কবির অন্তর্জগতের অমূল্য উপাদানরূপে ছিন্নপত্রাবলীতে সংকলিত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পত্রবিলাসী। সব ব্যাপারেই তিনি সকলের সঙ্গে পত্রের মারফত ভাবের আদানপ্রদানরূপে অসংখ্য পত্র লিখেছেন। তার অনেকগুলি পরে পৃথক বইরূপে প্রসিদ্ধ। যেমন ‘ইউরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ‘ইউরোপ-যাত্রীর ডায়েরি’, ‘সঙ্গীতচিন্তা’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘জাভাযাত্রীরপত্র’, ‘জাপানে’ প্রভৃতি। এমনকি রাণুকে লেখা, ‘ভানুদাদার পত্র’ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটি রাণুরই গ্রহিষ্ণুমনের একান্ত দান। সুতরাং ভাবের আদানপ্রদানের চিঠির পাত্র-পাত্রী দেখা গেছে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের। এটি সৃষ্টিশীল পুরুষ ও নারীর পক্ষে একইভাবে প্রযোজ্য, যার যেটি প্রাপ্য তাকে সেটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু পরস্পরের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ‘প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে।’
অবশ্য বুদ্ধদেব বসু যে অমিত-লাবণ্যর প্রেম, পরিণয়ে পরিণত না হওয়ার জন্যে আক্ষেপ প্রকাশ করে অমিতের অক্ষমতার ওপর দোষারোপ করেছেন, তাতে মনে হয় তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে বিভ্রান্ত হয়েছেন। সব প্রেম সম্পর্ক কিন্তু বিবাহে পরিণতি লাভ করে না, তার দৃষ্টান্ত জীবনে ও সাহিত্যে প্রচুর। এই সঙ্গে আমি বিবাহবিচ্ছিন্ন দুটি অমলিন প্রেমের বাস্তব জীবনের কথা উল্লেখ করব। একটি স্বদেশি ও অপরটি বিদেশি। প্রথমজন প্রথিতযশা উর্দু কবি ও ঔপন্যাসিক, অসামান্য স্বাধীনচেতা পাঞ্জাবিভাষী অমৃতা প্রীতম। এবং অপর জন বিশ্ববিখ্যাত লেবানিজ আমেরিকান কবি ও চিত্রকর খলিল জিব্রান।
কিশোরী কবিরূপে প্রতিষ্ঠিতা অমৃতা যিনি নিজেকে নির্মাণ করেছেন অধ্যয়নে ও অধ্যবসায়ে, সমস্ত বাধাকে দলিত করে, সাফল্য ও কীর্তির শীর্ষচূড়ায় অরোহণ করেছেন। তিনি ভালোবেসেছিলেন আর এক বিখ্যাত উর্দু কবি শাহির লুধিয়ানভিকে। তাঁকে অমৃতা দেখেছিলেন এক উর্দু শায়রীর মসলিশে। অমৃতা তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নিবেদন করেছেন শাহিরকে। ‘সুনেহড়ে’ কাব্যগ্রন্থে তথা অন্যান্য রচনায় স্বতঃস্ফূর্ত সেই নীরব প্রেমের আরতি কোনওদিন তার আরাধ্যকে কাছে পায়নি, বিবাহ তো দূরের কথা। শাহির ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও হিন্দি ছবির অন্যতম জনপ্রিয় গীতরচয়িতা। কিন্তু তিনি চিলেন স্বভাব-উদাসী ও বন্ধনহীন। একবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু কোনও কথা হয় না। শোনা যায় শাহিরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল অন্যজনের সঙ্গে। কিন্তু পরে শাহির যখন মারা যান তখন সেই ভীষণ দিনের কথা অমৃতা তাঁর ডায়েরিতে লেখেন—‘আজ মেরা খুদা মর গয়া।’
বিবাহবিচ্ছিন্না অমৃতা, পুত্রকন্যাসহ লাহোর থেকে এসেছেন দিল্লিতে এবং পরে তাঁর একান্ত ভক্ত ইন্দ্রজিৎ বা ইমরোজের সঙ্গে বন্ধনহীন গ্রন্থিতে থেকেছেন একান্ত ভালোবাসার আশ্রয়ে। কবিজীবনের স্বার্থে অমৃতা, শাহিরের মনের দিক থেকে কাছে থেকেও দূরে রয়ে গেলেন। তার ফল বোধ হয় উভয়ের জীবনই সৃষ্টিশীল হয়েছিল। তার পরে অমৃতা, ইমরোজের একান্ত সেবায় ও ভালোবাসায় আরও কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন। তাঁর শেষের কবিতায় অমৃতা ইমরোজের উদ্দেশ্যে লিখে গেছেন— ‘ম্যয় তৈনু ফির মিলহ্গি’ অবার দেখা হবে। প্রেম ও ভালোবাসার বৈচিত্রে এক প্রতিভাময়ী কবি ও সাহিত্যকারের জীবন সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। জীবনে প্রতিফলিত সঙ্গ ও আসঙ্গের পরিচয় অমৃতার জীবনে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
আর বিশ্বখ্যাত কবি খলিল জিব্রানের প্রেমকাহিনি তো বিবাহের রঙে রাঙা না হয়েও তাঁর জীবনের মূলে বাসা বেঁধেছে। তাঁর কবিজীবনের মূল প্রেরণা তথা ধারক ও বাহক ছিলেন Mary Elizabeth Haskell। খলিলের থেকে দশ বছরের বড়ো মেরি ছিলেন বস্টনের এক হাইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস। আসলে এই মেরিই আবিষ্কার করেন, জিব্রানের প্রতিভাকে এক চিত্র প্রদর্শনীতে এবং তার বিকাশের জন্যে তাকে পাঠান নিজের খরচে প্যারিসে শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে। মেরির সংস্পর্শে এসেই জিব্রান ইংরেজিতে লিখতে আরম্ভ করেন এবং মেরি সেগুলিকে সযত্নে এডিট করেন উৎকর্ষ সাধনে। পরে মেরির চরিত্র-মাধুর্যে মুগ্ধ জিব্রান, ধীরে ধীরে মেরির প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। মেরির বদান্যতাই শুধু নয়, মেরির প্রেরণাদায়ী ভালোবাসার পরম দানেই জিব্রান জীবনে সুপ্রতিষ্ঠ হন। তার প্রমাণ আছে তাঁদের পত্রবিনিময়ের মধ্যে যা পরে সংকলিত হয়েছে একটি গ্রন্থে।
কিন্তু বিমুগ্ধ খলিল যখন মেরিকে বিবাহের প্রস্তাব দেন তখন মেরি বলেন, তোমার বৃহত্তর স্বার্থেই তা হতে পারে না। কেন না আমাদের বন্ধুত্বটা স্থায়ী হোক, সেটা আমি চাই। আমার ভয় কিন্তু, একটা সাধারণ প্রেম যেন সেই বৃহৎ সম্ভাবনার বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সেটা হলে হবে একটা মহতি বিনষ্টি। অবশেষে খলিলের চোখের জলে সে পর্ব শেষ হয়। মেরি তাঁর দূরদৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছিলেন, খলিলের পক্ষে তাঁর কাছে বাঁধা পড়া ওর সাফল্যের অন্তরায় হয়ে উঠবে; ভবিষ্যতে ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছে এক বিরাট সাফল্য এবং বন্ধনহীনতা ওকে অনুপ্রাণিত করবে মহত্তম সৃষ্টিতে, যা ওকে অভিষিক্ত করবে নব নব সাফল্যে। সেকথা পরে সত্য হয়ে উঠেচিল। জিব্রান যে prophet লিখে বিশ্বখ্যাত হলেন, তার পশ্চাতে ছিল মেরির অসামান্য অবদান। বিশেষ করে বিয়ের মধ্যে খলিলকে পথ হারানো থেকে মুক্তি দিয়ে।
যদিও মেরি পরে বিয়ে করে ঘরসংসার করেছেন, এবং খলিলের জীবনেও অনেক নারীর সঙ্গ এসেছে। কিন্তু তা মেরি ও খলিলের আত্মিক সম্পর্ককে কিছুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। বরং তাদের মুক্ত প্রেম খলিলের জীবনে এক মহত্তম সৃষ্টির সার্থকতা এনে দিয়েছে। খলিলের আত্মার আত্মীয়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, মিশরীয় May Ziadeh। তাঁর সঙ্গে খলিলের কিন্তু কখনও দেখা হয়নি, শুধুই পত্রালাপ, যা পরে প্রকাশিত হয়। এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের একটি বিখ্যাত উক্তি খুবই প্রণিধানযোগ্য—“বড়ো প্রেম কেবল কাছেই টানে না, দূরেও সরাইয়া দেয়।”
অনেকেই মুক্তপ্রেমের এই গভীরাশ্রয়ী মহত্তম রূপকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার অভাবে অমিত-লাবণ্যের প্রেমকে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে ধরতে পারেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রজ্ঞা দৃষ্টিতে তাকে আবিষ্কার ও প্রকাশ করতে পারেন অপরিসীম দক্ষতায়। মেরির মুক্তদৃষ্টির প্রতিধ্বনিই আমরা লাবণ্যর শেষের কবিতায় শুনি—
“তোমারে যা দিয়েছিনু
তার পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয় অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান—
গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়।
যে বন্ধু বিদায়।”
তথ্যসূত্র:
১) রবীন্দ্ররচনাবলী (পশ্চিমবঙ্গ সরকার);
২) বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ সংগ্রহ (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি);
৩) মানুষ রবীন্দ্রনাথ, কাননবিহারী মুখোপাধ্যায়;
৪) My reading of Kahil gibram– ড. ইন্দ্রাণী চৌধুরী।
৫) আত্মকথা– অমৃতা প্রিতম্।