bhanu bandopadhyay

কমেডির বিবর্তন ও আমার বাবা

বিবর্তন বলতে যা বোঝায়, সেই অর্থে বাংলা কমেডির কিন্তু বিশেষ বিবর্তন হয়নি৷ তার প্রধান কারণ তিরিশ চল্লিশের দশকের তুলসী লাহিড়ী, রণজিৎ রায়, ডিজি, ইন্দ্র মুখোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, নবদ্বীপ হালদারের কমেডির মান এতই উন্নত ছিল, যে পরবর্তী প্রজন্মের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষদের বিশেষ পরিবর্তন করতে হয়নি৷ হলিউডে যেমন স্ল্যাপস্টিক কমেডির থেকে আমূল পরিবর্তন হয়ে সিচ্যুয়েশনাল কমেডিতে এসে উন্নতি হয়েছে৷ হলিউডের সাইলেন্ট যুগের কমেডিগুলো স্ল্যাপস্টিক না হয়ে উপায় ছিল না৷ চার্লি চ্যাপলিন, লরেল-হার্ডি, বাস্টার কীটন প্রভৃতিকে স্ল্যাপস্টিক কমেডিই করতে হত৷ টকির যুগ আরম্ভ হলে তারাও আর স্ল্যাপস্টিক কমেডি করত না, তার প্রমাণ চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’, ‘লাইম লাইট’ প্রভৃতি৷ অবশ্য সবাই চ্যাপলিন নয়৷ স্ল্যাপস্টিক যুগের প্রচুর রথী, মহারথীর কাজ বন্ধ হযে গেছিল টকি আসাতে৷ 

তুলসী লাহিড়ী একজন ভারসেটাইল কমেডিয়ান ছিলেন৷ একাধারে অভিনয়, পরিচালনা, কাহিনি ছাড়াও গানের কথা ও সুরও তিনি দিতেন৷ ওঁর কমিক স্কেচের রেকর্ডও আছে৷ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইকন ছিলেন এই তুলসী লাহিড়ী, ইন্দু মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি৷

কিন্তু বাংলার কমেডিয়ানদের সেরকম কিছু ভুলতে হয়নি৷ কারণ, বাংলার নির্বাক যুগে খুব বেশি কমেডি ছবি হয়নি, বেশির ভাগই তিন-চার রিলের ছবি আর ডিজি কিন্তু কমেডি ছবি করেছিলেন৷ যেমন, ‘বিজয় অ্যান্ড বসন্ত’, ‘ডি ম্যারেজ টনিক’, ‘অলীক বাবু’ প্রভৃতি৷ 

সবাক যুগের প্রথম দিকেও খুব বেশি কিছু কমেডি ছবি হয়নি৷ ‘জোর বরাত’, ‘এক্সকিউজ মি স্যার’, ‘রাত কহেনা’, ‘হাল বাংলা’ ছাড়া তুলসী লাহিড়ী কয়েকটি ছোটবড় হাসির ছবি বানিয়েছিলেন। যেমন ‘বেজায় রগড়’, ‘মণিকাঞ্চন’, ‘দিগদারী’, ‘হ্যাপী ক্লাব’ প্রভৃতি৷ এই তুলসী লাহিড়ী একজন ভারসেটাইল কমেডিয়ান ছিলেন৷ একাধারে অভিনয়, পরিচালনা, কাহিনি ছাড়াও গানের কথা ও সুরও তিনি দিতেন৷ ওঁর কমিক স্কেচের রেকর্ডও আছে৷ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইকন ছিলেন এই তুলসী লাহিড়ী, ইন্দু মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি৷ 

রণজিৎ রায়ও আরেক জন ভারসেটাইল কমেডিয়ান৷ অভিনয় ছাড়া, ইনি হাসির গান বা প্যারোডি গানও করতেন, ‘রাধিকার কুল ভক্ষণ’, ‘সদাই এর পদ বৃদ্ধি’, ‘পিঁয়াজ বন্দনা’, ‘উল্টো বুঝলি রাম’, রঞ্জিত রায়ের একটি হাসির গান ছিল এরকম– উড়ে গেল উড়ে গেল৷ কী? কী? চামচিকে‍ উড়ে গেল– বম চামচিকে বম৷ পরবতী’ যুগে ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ গানে এর প্রভাব পরিলক্ষিত৷ এছাড়া রঞ্জিত ‘অনেক দুঃখে বলছি হাসতে চাইলে হেসো, ভূতপূব’ বাবা আমার বর্তমানে মেসো’ বা নবদ্বীপ হালদারের ‘আলু ভাতে বেগুন পোড়া শুধুই ডাঁটার চচ্চরি, তরকারি’ এখনকার দিনের বিখ্যাত প্যারোডি গান, পরবর্তী যুগে মিন্টু দাশগুপ্ত হাসির গান বা প্যারোডি গান গেয়ে‍ বিখ্যাত হন৷ হাসির গান, প্যারেডি, বা কমিক স্কেচের রেকর্ড সে যুগেও ছিল৷ 

তবে পরবর্তী যুগে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় বা অজিত চ্যাটার্জি যা আরম্ভ করেন সেটা হচ্ছে স্ট্যান্ড আপ কমিক যেটা একটা বিবর্তন বলা যায়৷ এ সম্বন্ধে পুরোটা আইডিয়া দিতে হলে‍ আমার বাবা পুরো বিবর্তনের ইতিহাস বললে ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ আমার বাবা, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একদম প্রথমে অর্থাৎ সাত বছর বয়স থেকে পাড়ার ফাংশানে কবিতা আবৃত্তি করতেন কিন্তু আমার বাবা ঢাকাইয়া কুট্টিদের জোকস খুব ভাল বলতেন বলে দর্শকরা সেগুলোই শুনতে চাইত৷ এইভাবে বাবার স্টেজ পারফরমেন্স আরম্ভ হল৷ ঢাকা রেডিওতে ও কবিতা পাঠ করতেন৷ পরে ১৯৪২ সালে কলকাতায় এলে রেডিওতে হাসির নাটকে পাঠ করতে হয়৷ 

বাবা তৎক্ষণাৎ অর্থাৎ ইম্প্রপ্টু অর্থাৎ তখনকার কোনও সমস্যা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে অন স্টেজ কমিক স্কেচ করতেন৷ বলতে গেলে ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডির ভারতে পায়োনিয়র আমার বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পরে জহর কাকা, অজিত কাকাও করতেন। এগুলোকে তখনকার দিনে ‘ক্যারিকেচার’ বলা হত

এদিকে ছোটখাটো ফাংশানে ঢাকাইয়া কুট্টিদের জোকস বলতেন৷ যেমন একটা ছিল, ‘এক ভদ্রলোক ঘোড়ার গাড়ি করে বেরিয়েছেন মার্কেটিং করতে, রাস্তায় দোকান থেকে পাঞ্জাবি কিনতে দরাদরি করে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান তাগাদা দিচ্ছে বারবার তাড়াতাড়ি করে আসবার৷ ভদ্রলোক তড়িঘড়ি পাঞ্জাবি উল্টো পরে দৌড়ে চলে আসেন৷ গাড়োয়ান তাকে দেখে রগড় করে বলেন, ‘আরে হালার বাবু আপনি আয়েন না জায়েন৷’ আরেকটা ছিল — এক সাহেব প্রচুর মদ্যপান করে হাটের মধ্যে বেলেল্লাপনা করছেন, তাই দেখে কয়েকজন কুট্টি তাকে ধরে বেধড়ক মারে৷ সাহেব দু’হাত তুলে বলে ‘দ্যাটস এনাফ এনাফ’৷ কুট্টিরা বলে‍ ‘হালার সাহেব একলা খাইতে কুলায় না৷ আবার হালার এনাইফ্যারে ডাকস’, এই জোকসগুলো ঢাকায় খুব সমাদর পেত৷ কিন্তু কলকাতায় এদেশীরা একে তো ভাষা বুঝতে পারত না, তার উপর ভালগার ছিল বলে সভ্য সমাজে বিশেষ কদর পেত না৷ 

ঢাকার কুট্টি গাড়োয়ানদের নিয়েই বাবা একটা কমিক রেকর্ড করেছিলেন ১৯৪৩-৪৪ সালে, যার নাম ছিল ‘ঢাকার গাড়োয়ান’৷ ওখানে এক জায়গায় ছিল– খদ্দের ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া জিজ্ঞেস করতে গাড়োয়ান একটা দর বলে, খদ্দের তার চেয়ে অনেক কম দর দিতে চায়৷ তাই শুনে রসিকতা করে বলে গাড়োয়ান বলে, ‘আস্তে কন বাবু ঘোড়ায় হাসবো’৷ এখন সেই রেকর্ড কোম্পানির কর্তা এই লাইনটা কেটে দেয়। কারণ তার যুক্তি ঘোড়া কি মানুষের ভাষা বোঝে যে হাসবে৷ এরপরে বাবা তার ঢাকাইয়া কুট্টি জোকস করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ এক তো ভাষার প্রবলেম৷ দ্বিতীয়ত, কলকাতার লোক কোনওরকম ভালো গাড়িটি পছন্দ করত না৷ 

এরপর বাবা ভুল ইংরেজি নিয়ে কিছু কমিক স্কেচ করতেন যেমন, একটা ছিল একজন অফিসের কেরানি তার সাহেবকে তার মাইনে বাড়াবার জন্য বলছে, ‘সাহেব ইনক্রিস মাই স্যালারি’৷ সাহেব বলে ‘হোয়াই?’ কেরানি – ‘ইউ সি টুয়েন্টি লিভস ফলস ইন মাই হাউস এব্লা ওব্লা৷’ (অর্থাৎ ওনার বাড়িতে ২০ জন লোক এবেলা ওবেলা খায়) বেলা ইংরজিতে কি হবে ভেবে না পেয়ে এব্লা ওব্লা৷) 

আরেকটা হচ্ছে মেমসাহেবের সঙ্গে এক বাঙালি মেমসাহেব বাজার করতে গেছে৷ মেমসাহেব এক কাঁদি‍ কলা কিনবে কিন্তু তাতে এক কলা পচা৷ বাঙালি মেমসাহেবকে বলে, ‘ডোন্ট বাই দ্যাট’৷ মেম বলে ‘হোয়াই?’ বাঙালি বলে, ‘ইফ ওয়ান কলা পচেস ইন দা বাঞ্চ, পচেস দা বাঞ্চ ফুল’, (অর্থাৎ এক কাঁদি‍তে যদি একটা কলা পচা থাকে তাহলে পুরো কাঁদিটাই পচে যায়৷‍ কিছুদিন পরে এই ভুল জোকসগুলোও বাবা বন্ধ করে দেয়, কারণ দর্শক যদি ইংরেজিই না জানে, তা হলে ভুল ইংরেজির হাসিগুলি আসবে কোথা থেকে, এরপর বাবা এই জোকসগুলো বন্ধ করে দিল৷ 

এরপর বাবা তৎক্ষণাৎ অর্থাৎ ইম্প্রপ্টু অর্থাৎ তখনকার কোনও সমস্যা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে অন স্টেজ কমিক স্কেচ করতেন৷ বলতে গেলে ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডির ভারতে পায়োনিয়র আমার বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পরে জহর কাকা, অজিত কাকাও করতেন। এগুলোকে তখনকার দিনে ‘ক্যারিকেচার’ বলা হত, একটা নমুনা দিই৷ ৬০-এর দশকে গভর্নমেন্ট কোম্পানির প্রোডাক্টগুলো কেন খারাপ ও ঠুনকো হত৷ বাবার একটা কমিক ছিল, এক জায়গায় গভর্নমেন্ট কারখানা থেকে বানানো হাত পাখা বিক্রি হচ্ছে৷ ওটা দু-একবার ঘোরালেই হাতলটা ভেঙে যেত৷ একজন খদ্দের এসে ম্যানেজারকে কমপ্লেন করে ‘কী পাখা বানিয়েছেন দু’বার নাড়ালেই হ্যানডেল ভেঙে যায়?’ ম্যানেজার বলেন, ‘এ সরকারের পাখা ওভাবে ব্যবহার করা যায় না৷’ খদ্দের বলে, ‘তা হলে কী হবে৷’ ম্যানেজার বলে পাখাটা আপনার মুখের কাছে সোজা ধরে রাখবেন, আর আপনার মুখটা ডানদিক বাঁদি‍ক, ডানদিক বাঁদি‍ক ঘোরাতে থাকবেন৷ তাহলে হাওয়া পাবেন৷