japanese sushi

বাঙালি রসনায় জাপানি রেসিপি – সুশি

সিঞ্চন নোহারা। বয়স পাঁচ বছর। দুষ্টুমিতে সব সেরা। বাবা মা ছোট বোন। প্রতিবেশী আর তাদের বাচ্চারা। মাঝে মাঝে দাদু ঠাকুমা। একটা পারিবারিক ছোটদের গল্প। ইয়োসিতো উসুই এর লেখা আর ছবিতে তৈরি কার্টুন। আমার মেয়ে সারাদিন দেখতো। বাম হাতের বুড়ো আঙুল মুখে পুরে। আমি বাড়ি থাকলে আমার পিঠের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে। সুতরাং সিঞ্চনদের আমিও চিনি। জানি। জাপানকে আরেক রকমে চেনা।

আরও অনেক আগে পাঠ্য আর গল্পের বইতে প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পারমাণবিক অস্ত্র। হিরোশিমা নাগাসাকি। জাপানকে একটু একটু চেনা। শূন্য থেকে, আগুন থেকে বারবার ফিনিক্স পাখির মত বেঁচে ওঠা, জাতীয়তাবোধ , কর্মঠ, মৃদুভাষী , বিনম্র। জাপানিদের আরো কিছুটা চেনা। হারাকিরি, কামিকাজে, আরিগাতো, গোজাইমাস শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচয়। কিমোনো আর ইউকাটা সেই হিউইয়ান যুগের এডো থেকে বর্তমানের আধুনিক টোকিওতেও ঐতিহ্যবাহী পোশাক। অতিমাত্রায় সুভদ্র এক সুন্দর পোশাক যা শুধুমাত্র একটি কোমরবন্ধ দিয়ে পরা।

ভূগোল চেনাল আরেক জাপানকে যেখানে জল আর আগুন একসাথেই থাকে। ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠায় কেউ অবাক হয় না। বাড়ি ঘর, শিল্পকাঠামো সে সব ভেবেই তৈরি। দুই সমুদ্রের মাঝে জাপান এক দ্বীপ। উষ্ণ আর শীতল জলস্রোত মিশেছে। তাই মাছ ধরা পড়ে অনেক অনেক। কিন্তু মাছেরা বিদেশ যায় অতি সামান্য। জাপানিরা মাছ খাওয়ায় সবাইকে অনেক পিছনে ফেলে দেয়।

খুউব ইচ্ছে হয়েছিল ওখানে বেড়াতে যাওয়ার। দুনিয়ার সবথেকে খরচসাপেক্ষ ট্যুর। দিন দশেকের জন্যে মাথাপিছু লাখ চারেক। পাঁচ ছয় বছর আগের কথা বলছি। অগত্যা নাকচ। কিন্তু জাপানের কেতায় চা খাওয়া চলতেই থাকলো। মেয়ের স্কুলে স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম নামে একটা ব্যাপার আছে। অন্য দেশের কিছু ছাত্রছাত্রী তাদের এডুকেশন ট্যুরে এখানে আসে। ছাত্র ছাত্রীদের বাড়িতে থাকে। খায় দায়। পড়াশোনা আর গল্প করে। আবার এখানের ছাত্র ছাত্রীদেরও ওখানে যাওয়ার ব্যাপার। জাপানের একটি দল এলো ২০১৮। আমাদের বাড়িতে থাকতে এলো সুজুকি নাকামুরা। ক্লাস সিক্স। ওসাকায় বাড়ি। মেয়ের ঘরে আর একটা বিছানা করতে হলো। সবাই খুব উত্তেজিত।

পুতুলের মতো দেখতে। পনিটেল। আমার মেয়ের অনেকটা ওই ধরনেরই চেহারা। আমি বলি ভুটিয়া। তো সুজুকি অদ্ভুত উচ্চারণে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে কথা বলে। খুউব আস্তে আস্তে। মাঝে মাঝেই শোনা যায় না। একটা ভয়েস ট্রানস্লেটর এনেছে। আমাদের কথা বুঝতে না পারলে ওটার সাহায্য নিচ্ছে। সঙ্গে করে চপস্টিক এনেছে। প্রথম দিন তো খুব বেকায়দায়। আমাদের ভাত তো আর স্টিকি রাইস নয়। শেষে চামচ দিয়ে খেয়ে শান্তি। দিন তিনেক পরে সেও অবশ্য আমাদের দেখে হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করল। আমি ওকে আঙুল চেটে খাওয়া শেখালাম। সবেতেই বলে থ্যাংকু। ভেরি নাইস। পার্ক হোটেলের ওরিয়েন্টালে এক সন্ধ্যেয় যাওয়া হলো। সুশী খেতে। প্রন টেম্পুরা আর টুনা মাকিজুসি নেওয়া হলো। ঘাবড়াবেন না। আগে শব্দ বসলে সুশি হয়ে যায় জুসি।

পরে আমরা বাড়িতে মাঝে মধ্যে সুশি বানিয়ে খাই। বন্ধুবান্ধব দেরও খাওয়াই। ভালোই লাগে বানাতে আর খেতে। আসলে সুশি মানে হলো নুন মিষ্টি দেওয়া ফারমেন্টেড ভাত। প্রাচীন জাপানে কাঁচা মাছকে নুন মাখিয়ে ভাতের মধ্যে মুড়ে রেখে দেওয়া হত। কখনও কখনও তিন চার মাস পর্যন্ত। তারপর ভাতটা ফেলে দিয়ে মাছটা খাওয়া হত। মুরেমচি আমলে এরকম খাবারের প্রচলন ছিল। একে নারেজুশী বা হোন্নারে বলা হত যার মানে হলো পুরোপুরি গেঁজে যাওয়া।

এই পদ্ধতি কিন্তু বহুকাল আগে থেকেই মেকং বা ইরাবতী নদীর অববাহিকা অঞ্চলে আজকের মায়নামার, লাওস, থাইল্যান্ড আর কম্বোডিয়ায় চালু ছিলো। এরপর সুশি পেরিয়ে এসেছে অনেক রাজতন্ত্র। কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে সুশি পরিবেশনের চল ছিলো বড় বড় জাপানি রেস্তোরাঁতে। পরিবেশনের পাত্রের রঙ আলাদা আলাদা রাখা হত দাম অনুযায়ী। এই সুশি কিন্তু প্রাচীন সুশির থেকে অনেকটাই আলাদা। রাইস ভিনিগার আবিষ্কারের পর ভাতের সঙ্গে রাইস ভিনিগার, চিনি আর নুন দিয়ে ইনস্ট্যান্ট ফার্মান্টেশন করে টাটকা মাছের টুকরো দিয়ে সুশি তৈরি হত। এই হায়াজুশি রন্ধনশৈলী সুশিকে ফাস্ট ফুডের পর্যায়ে নিয়ে আসে। আসলে সুশি অর্থ হলো টক এবং সুস্বাদু। আমরা এতেই খুশি।

অনেক রকমের সুশি হয়। সারা পৃথিবীর খাদ্যরসিকদের জনপ্রিয় জাপানি খাদ্য হলো সুশি। একটা কমপ্লিট খাবার। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন আর সবজির দারুণ এক মিশ্রন। নিগিরি , মাকি, টেরিমাকি, উরামাকি , চেরাশি। আবার এদের মধ্যেকার পুর অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের। আসলে সুশি একটা খাবার শুধু নয়। একটা সংস্কৃতি। কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা একটা উৎসব। টুনা, স্যামন , মিষ্টি জলের ইল, চিংড়ি, স্কুইড বা অক্টোপাস। সঙ্গে আভোকাডো, গাজর, শসা। এইসবই পুর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। মাকি মানে হলো রোল। পাটিসাপটার মত ব্যপার। পুরের সংখ্যা আর বিভিন্নতায় হসিমাকি, টেক্কিমাকি, ফুটোমাকি আর কাপ্পামাকি। আমার পছন্দ ফুটোমাকি। চলুন, বানিয়ে ফেলা যাক।

প্রথমে জিনিসপত্র জোগাড় করতে হবে। মাকিসু অর্থাৎ কিনা বাঁশের সরু টুকরো দিয়ে বোনা ছোট্ট মাদুরের মত একটা বস্তু। এটা সুশি রোল করতে লাগে। জাপানি সুশি রাইস, রাইস ভিনিগার, সুশি মিক্সড মশলা, টেরিয়াকি সস, ওয়াসাবি সস ( জাপানি ঘোড়া মুলোর সস, প্রচন্ড ঝাঁঝালো) । চাই গারি ( পিকলড কচি আদা) , গার্কিন ( পিকলড্ কচি শসা) , পাঁচ সেমি লম্বা এক সেমি চওড়া করে কেটে অল্প নুন জলে আধসেদ্ধ করা গাজর, পাতলা স্লাইস করে কেটে নেওয়া এভোকাডো,ভেজ মেয়োনিজ আর সাসেমি অর্থাৎ কিনা পাতলা স্লাইস করে কেটে নেওয়া টুনা, স্যামন বা স্কুইড। আমি অবশ্য মাঝারি আকারের চিংড়িকে অল্প ডিমের পরতে সোনালী করে ভেজে নিই। আর হ্যাঁ, নরি শিট মানে সামুদ্রিক উদ্ভিদের থেকে তৈরি একটা র‍্যাপ।

দেড়শো গ্রাম চালটা দু তিনবার ভালো করে ধুয়ে নিন। শেষে যেন চালধোয়া জলে সাদাটে ভাব কম থাকে। তিন গুন পরিমান জল দিয়ে সেদ্ধ হতে দিন মাঝারি আঁচে। মাঝে মাঝেই নেড়েচেড়ে দিতে হবে। একটা কাপে পঞ্চাশ মিলি রাইস ভিনিগার, দেড় চামচ চিনি আর দেড় চামচ নুন ভালো করে মিশিয়ে নিন। চাল সেদ্ধ হয়ে জল টেনে গেলে ওই মিশ্রণটা ভালো ভাবে ভাতে মিলিয়ে দিতে হবে। সুখী দাম্পত্যের মত। ঠান্ডা হতে দিন। এবার আসল খেলা। একটা টেবিল ম্যাটের উপর মাদুরটা বিছিয়ে দিন। ওটাকে সেলোফেন দিয়ে মুড়ে নিলে ভালো হয়। ওর উপর নরি শিট বিছিয়ে একদলা ভাত নিয়ে শিটের ওপর একটা মাঝারি লেয়ার করুন। কিছু সাদা আর কালো তিল ছড়িয়ে দিতে পারেন। দু চামচ মেয়োনিজ আর এক চামচ টেরিয়াকি সস দিয়ে সস টা বানিয়ে ফেলুন। এবারের মাদুরের লম্বালম্বি ভাবে সাজিয়ে নিন গাজরের টুকরো, স্যাসেমি, গার্কিনের লম্বা টুকরো, আভোকাডো। সসটা আর মশলাটা মিলিয়ে নিন। এবার সুন্দর করে চাপ দিয়ে চৌকো আকারের রোল বানান। ওই পরিমাণে তিনটে হবে। ফ্রিজে রাখুন। একই ভাবে চিংড়ি দিয়েও বানানো যায়। তবে আমার মেয়ের মতে টুনা বা স্যামনের সঙ্গে আভোকাডোর ব্যালান্সটা নাকি ওয়াও। জাপানি মাস্টারসেফরা ওয়াসাবী সসটা সুশি তৈরির সময় মিশিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা খাওয়ার সময় প্রয়োজনমত নেবো। আধঘণ্টা পর ফ্রিজ থেকে বার করে একটা ধারালো ছুরি দিয়ে এক একটা রোল সাত টুকরো করে কেটে নিন। মাৎসুতা বা সুগিমোতো আমার পছন্দ। না হলে যেকোনো। আয়েশ করে খান। পিকেলড কচি আদার গোলাপী রঙের টুকরো আর একটু সুশি সস, খুউব সামান্য ওয়াসাবি সস দিয়ে। অনেকে সয়া সস ব্যবহার করে। পসন্দ আপনা আপনা। একটা বিশেষ পাত্রে সুশি এবং সস ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়, তার নাম বেন্টো।

সুজুকিরা ফিরে গেল। পরের বছর আমার মেয়েদের ওসাকা যাওয়ার পালা। কিন্তু কোভিড এসে গেলো। সব ওলট পালট। এখনও মাঝে মাঝেই জাপান ট্যুরের লিফলেটগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। নাহলে কোলকাতার রেস্টুরেন্ট তো আছেই। আমাদের রান্নাঘরই বা কম কিসে? ভালো থাকবেন। ভালো খাবেন। কেতায় বাঁচবেন।।