kabi-kahini

কবি-কাহিনী

কাজটা মোটেই ভাল করেননি রবীন্দ্রনাথের সেই বন্ধু, পরে মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের 

অথচ সে-কাজটা না করলে সেই সতেরো বছর বয়সেই প্রকাশিত হত না রবীন্দ্রনাথের প্রথম বই, কবি-কাহিনী 

প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথের বন্ধু, রবীন্দ্রনাথকে না-জানিয়েই বইয়ের আকারে ছেপে দিয়েছিলেন কবি-কাহিনী, ১৮৭৮ সালে সেটাই তরুণ কবির প্রথম বই 

আর পাঁচটা বাঙালি পরিবারের মতো রবীন্দ্রনাথের পরিবারও তখন চেষ্টা করে চলেছেন ছেলেকে রীতিমতো পড়াশোনা করিয়ে পরীক্ষা পাশ দেওয়ানোর আর সতেরো বছরের রবীন্দ্রনাথ কেবলই ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো স্কুল পালাচ্ছেন রবীন্দ্র-জীবনের বাইরের এই কাহিনির মধ্যে গোপনে গড়ে উঠছে এক কবির কাহিনি

সে-কাহিনিকে লালন করছে ভারতী, ঠাকুরবাড়ি থেকেই প্রকাশিত পত্রিকা ১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে, রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় যাত্রা শুরু সে মাসিক পত্রের প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথ তার লেখক পৌষ সংখ্যা থেকে তিনি হলেন ধারাবাহিক আখ্যানকাব্য কবি-কাহিনী-র কবি 

painting by gaganendranath thakur
কবি-কাহিনী রচনার সময়ে রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলিতে

সে কাব্যের নায়ক কবি কেন, লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনস্মৃতিতে— 

“এই প্রথম বৎসরের ভারতীতেই কবিকাহিনী নামক একটি কাব্য বাহির করিয়াছিলাম যে-বয়সে লেখক জগতের আর-সমস্তকে তেমন করিয়া দেখে নাই, কেবল নিজের অপরিস্ফুটতার ছায়ামূর্তিটাকেই খুব বড়ো করিয়া দেখিতেছে, ইহা সেই বয়সের লেখা সেইজন্য ইহার নায়ক কবি সে কবি যে লেখকের সত্তা তাহা নহে—সে আপনাকে যাহা বলিয়া মনে করিতে ও ঘোষণা করিতে ইচ্ছা করে, ইহা তাহাই ঠিক ইচ্ছা করে বলিলে যাহা বুঝায় তাহাও নহে, যাহা ইচ্ছা করা উচিত, অর্থাৎ যেরূপটি হইলে অন্য দশজনে মাথা নাড়িয়া বলিবে, হাঁ কবি বটে, ইহা সেই জিনিসটি

লেখকের সত্তা যে-কবি নয় সে-কবির এই কাহিনিকে পরে কাঁচা বয়সের লেখা বলে ফেলে দিতে চাইবেন রবীন্দ্রনাথ লিখবেন, 

“যে-বয়সে ভারতীতে লিখিতে শুরু করিয়াছিলাম সে-বয়সের লেখা প্রকাশযোগ্য হইতেই পারে না বালককালে লেখা ছাপাইবার বালাই অনেক—বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থার জন্য অনুতাপ সঞ্চার করিবার এমন উপায় আর নাই কিন্তু তাহার একটা সুবিধা আছে; ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখিবার প্রবল মোহ অল্পবয়সের উপর দিয়াই কাটিয়া যায় আমার লেখা কে পড়িল, কে কী বলিল, ইহা লইয়া অস্থির হইয়া উঠা—লেখার কোনখানটাতে দুটো ছাপার ভুল হইয়াছে, ইহাই লইয়া কণ্টকবিদ্ধ হইতে থাকা—এই-সমস্ত লেখা প্রকাশের ব্যাধিগুলো বাল্যবয়সে সারিয়া দিয়া অপেক্ষাকৃত সুস্থচিত্তে লিখিবার অবকাশ পাওয়া যায় নিজের ছাপা লেখাটাকে সকলের কাছে নাচাইয়া বেড়াবার মুগ্ধ অবস্থা হইতে যত শীঘ্র নিষ্কৃতি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল

এই সকলের মধ্যে ছিলেন কবির ‘নলিনী’-ও তাঁর সঙ্গে কবির পরিচয় সে-কালের বোম্বাইয়ে জীবনে প্রথম বিলেত যাওয়ার আগে ইংরেজি ভাষা আর আদবকায়দা শিখতেই তাঁর বোম্বাইয়ে থাকা স্কুল-পালানো বালকটিকে বিলেতে পড়িয়ে ব্যারিস্টার করে আনার সিদ্ধান্ত হল ঠাকুরবাড়িতে ভারতী পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ শুরু হল ১২৮৫-র বৈশাখ, ১৮৭৮-এর এপ্রিল-মে মাসে তখন, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘মেজদাদা প্রস্তাব করিলেন, আমাকে তিনি বিলাতে লইয়া যাইবেন…বিলাতযাত্রার পূর্বে মেজদাদা আমাকে প্রথমে আমেদাবাদে লইয়া গেলেন

‘মেজদাদা’ মানে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আইসিএস আমেদাবাদে তখন তাঁর পোস্টিং সেখানেই কয়েক মাস থাকছেন রবীন্দ্রনাথ, শাহিবাগ প্রাসাদে শিখছেন মারাঠি ভাষা, অনুবাদ করছেন তুকারামের অভঙ্গ, সত্যেন্দ্রনাথের প্রবন্ধের জন্য মনের গভীরে জমে উঠছে প্রাসাদ আর তার কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাবরমতী নদীর ছবি কলকাতায় মানুষ হওয়া রবীন্দ্রনাথ তখনও পর্যন্ত দেখেননি ‘ইতিহাসের মাথাতোলা চেহারা’ সেই প্রথম চলতি ইতিহাস থমকে গেল, দেখা গেল তার ‘পিছনফেরা বড়ো ঘরোয়ানা’ কিশোর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির পটে এই ছবি আঁকা হয়ে গেল অনেক পরে যার প্রকাশ দেখা যাবে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে 

কিন্তু বাদশাহি আমলের সেই প্রাসাদে, সাবরমতী নদীতীরের দিকের প্রকাণ্ড খোলা ছাদটিতে বেশি দিন থাকা হল না রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ-যাত্রার দিন এগিয়ে আসছে ইংরেজদের আদবকায়দা আর ভাষাটা ভাল করে শিখতে হবে ইংরেজিতে তখনও তিনি ‘নিতান্তই কাঁচা’, সে-ভাবনা বিলেত যাওয়ার আগে বিশেষ হয়ে দাঁড়াল কিন্তু কবি হাল ছাড়লেন না ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস বাংলায় লিখতে চাইলেন মেজদাদাকে বই এনে দিতে বললেন সত্যেন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-সংক্রান্ত রাশি রাশি বই হাজির করলেন এবং, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমি তাহার দুরূহতা বিচারমাত্র না করিয়া অভিধান খুলিয়া পড়িতে বসিয়া গেলাম সেই সঙ্গে আমার লেখাও চলিতে লাগিল এমন কি, অ্যাংলো স্যাক্সন ও অ্যাংলো নর্মান সাহিত্য-সম্বন্ধীয় আমার সেই প্রবন্ধগুলাও ভারতীতে বাহির হইয়াছিল এইরূপ লেখার উপলক্ষ্যে আমি সকাল হইতে আরম্ভ করিয়া মেজদাদার কাছারি হইতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত একান্ত চেষ্টায় ইংরেজি গ্রন্থের অর্থ সংগ্রহ করিয়াছি

শুধু ভাষা তো নয়, আদবকায়দাও তো শেখা চাই তাই বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্থঘরে তাঁকে থাকতে হল ছেলেবেলা-য় লিখছেন, ‘এখানে, [আমেদাবাদ] কিছুদিন থাকার পর মেজদাদা মনে করলেন, বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিতে পারলে হয়তো ঘরছাড়া মন আরাম পাবে ইংরেজি ভাষা শেখবারও সেই হবে সহজ উপায় তাই কিছুদিনের জন্য বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্থঘরে আমি বাসা নিয়েছিলুম

anna
আনা, বাংলায় যার অর্থ পদ্ম, যাঁকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখতেন নলিনী সম্বোধনে

সেই গৃহস্থ পরিবারটি ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরঙের ১৮৬৪-তে সত্যেন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনী যখন প্রথম বোম্বাই গেলেন তখন মানকজী করসদজীর বাড়িতে উঠেছিলেন সেখানেই পরিচয় পাণ্ডুরঙ-পরিবারের সঙ্গে পাণ্ডুরঙ বোম্বাই অঞ্চলে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের নেতা তাঁর তিন মেয়ে আনা, দুর্গা ও মানেককে তিনি ইংলন্ডে পড়িয়ে এনেছিলেন তার মধ্যে আনা, ‘এখনকার কালের পড়াশুনোওয়ালা মেয়ে ঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন তাঁর শিক্ষা বিলেত থেকে’ সেই আনার উপরেই ভার পড়ল রবীন্দ্রনাথকে গ্রুম করার

রবীন্দ্রনাথ কবে বোম্বাই গিয়েছিলেন? নির্দিষ্ট করে তারিখ বলা না গেলেও সম্ভবত ভাদ্র মাসের গোড়াতেই [Aug 1878] ঠাকুরবাড়ির হিসেবের খাতায় ওই বছরের ২৬ শ্রাবণ [10 Aug] ‘রবিবাবুর নিকট Ahmedabad প্রসন্নকুমার বিশ্বাসের এক পত্র লেখার টিকিট ব্যয়’-এর হিসেব পাওয়া যায় তার মানে, অগাস্টের অন্তত মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি আমেদাবাদেই ছিলেন, অনুমান করা যায় চার সর্গে কবি-কাহিনীর পত্রিকা-প্রকাশ ভারতীর ১২৮৪ পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায়—অর্থাৎ ১৮৭৭-এর ডিসেম্বর থেকে ১৮৭৮-এর মার্চ পর্যন্ত 

ভারতী থেকেই নিশ্চয় আনাকে কবি-কাহিনী পড়ে আর তর্জমা করে শোনাতেন ষোলো বছরের রবীন্দ্রনাথ একটা ছবি কল্পনা করে নেওয়াই যায়, রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন, কবি-কাহিনী থেকে,

…আর কিছু জানিত না, আর কিছু ভাবিত না, শুধু সে বালিকা ভালবাসিত কবিরে

শুধু সে কবির গান, কত যে লাগিত ভালো, শুনে শুনে শুনা তার ফুরাত না আর!

শুধু সে কবির নেত্র কি এক স্বর্গীয় জ্যোতি বিকীরিত, তাই হেরি হইত বিহ্বল! 

শুধু সে কবির কোলে ঘুমাতে বাসিত ভাল, কবি তার চুল লয়ে করিত কী খেলা

কবির কাছে আনা চেয়েছিলেন একটি বাংলা ডাকনাম কবি দিয়েছিলেন ‘নলিনী’, কবি-কাহিনীর নায়িকার নামে কবি-কাহিনীতে মুগ্ধ ছিলেন আনা রবীন্দ্রনাথ পরে ছেলেবেলা-য় লিখেছেন, ‘আমার বিদ্যে সামান্যই, আমাকে হেলা করলে দোষ দেওয়া যেতে পারত না তা করেন নি পুঁথিগত বিদ্যা ফলাবার মতো পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতুম যে কবিতা লেখবার হাত আমার আছে আদর আদায় করবার ঐ ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো মূলধন যাঁর কাছে নিজের এই কবিআনার জানান দিয়েছিলেম, তিনি সেটাকে মেপেজুখে নেন নি, মেনে নিয়েছিলেন কবির কাছ থেকে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম জুগিয়ে, সেটা ভালো লাগল তাঁর কানে ইচ্ছে করেছিলেম সেই নামটি আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাঁথুনিতে, শুনলেন সেটা ভোর বেলাকার ভৈরবী সুরে, বললেন কবি তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণ দিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি এর থেকে বোঝা যাবে, মেয়েরা যাকে আদর জানাতে চায় তার কথা একটু মধু মিশিয়ে বাড়িয়েই বলে, সেটা খুশি ছড়িয়ে দেবার জন্যেই মনে পড়ছে তাঁর মুখেই প্রথম শুনেছিলুম আমার চেহারার তারিফ সেই বাহবায় অনেক সময় গুণপনা থাকত

সেই আনা, আনা তরখড়, কোনও দিন দাড়ি না-রাখতে বলেছিলেন ছেলেবেলা-তেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘একবার আমাকে বিশেষ ক’রে বলেছিলেন একটা কথা আমার রাখতেই হবে তুমি কোনো দিন দাড়ি রেখো না–তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে তাঁর এই কথা আজ পর্যন্ত রাখা হয়নি সেকথা সকলেরই জানা আছে আমার মুখে অবাধ্যতা প্রকাশ পাবার পূর্বেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল

Rabindranath Thakur
যুবক বয়সে রবীন্দ্রনাথ, ১৮৭৯ সালে ইংল্যান্ডে

বই হয়ে কবি-কাহিনী তখনও প্রকাশিত হয়নি প্রকাশিত হল ৫ নভেম্বর ১৮৭৮ তার মাস-দেড়েক আগে, রবীন্দ্রনাথ বিলাতযাত্রা করলেন বোম্বাই থেকে বিলাতের পথে জাহাজ ছাড়লো ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ (৫ আশ্বিন ১২৮৫) কবি-কাহিনীর আখ্যানেও কবি, নলিনীকে পর্ণকুটীরে রেখে ভুবন-ভ্রমণে গিয়েছিল বলে গিয়েছিল, ‘নলিনি! চলিনু আমি ভ্রমিতে পৃথিবী!’

নলিনীর স্মৃতি নিশ্চয় ছিল সেই যাত্রী রবীন্দ্রনাথে কবি-কাহিনী বইটি কি ছিল? জীবনস্মৃতি পড়লে মনে হয় ছিল রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

“এই কবিকাহিনী কাব্যই আমার রচনাবলীর মধ্যে প্রথম গ্রন্থ-আকারে বাহির হয় আমি যখন মেজদাদার নিকট আমেদাবাদে ছিলাম তখন আমার কোনো উৎসাহী বন্ধু এই বইখানা ছাপাইয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিয়া আমাকে বিস্মিত করিয়া দেন তিনি যে কাজটা ভালো করিয়াছিলেন তাহা আমি মনে করি না কিন্তু তখন আমার মনে যে-ভাবোদয় হইয়াছিল, শাস্তি দিবার প্রবল ইচ্ছা তাহাকে কোনোমতেই বলা যায় না দণ্ড তিনি পাইয়াছিলেন, কিন্তু সে বই-লেখকের কাছে নহে, বই কিনিবার মালেক যাহারা তাহাদের কাছ হইতে শুনা যায়, সেই বইয়ের বোঝা সুদীর্ঘকাল দোকানের শেল্ফ এবং তাঁহার চিত্তকে ভারাতুর করিয়া অক্ষয় হইয়া বিরাজ করিতেছিল

অথচ, কবি-কাহিনীর প্রকাশতারিখ দেখলে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ ভুলে গিয়েছেন কারণ আগস্টের মাঝামাঝি আমেদাবাদ ছেড়েছেন রবীন্দ্রনাথ আর কবি-কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে নভেম্বরে কোনও কোনও রবীন্দ্রজীবনীকার অনুমান করেছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে বইটির ফাইল কপি পৌঁছেছিল বিলেত যাওয়ার আগে কিন্তু সে-অনুমান ভুল বলে মনে হয় কারণ তা যদি পৌঁছেই থাকবে তবে তা-ই তো তিনি আনাকে দিয়ে যাবেন, ভারতীর সংখ্যাগুলি নয় অথচ আনা চিঠিতে জানিয়েছেন, 

…though I have the poem myself in the numbers of ‘ভারতী’, in which it was first published, and which Mr. Tagore was good enough to give me before going away.

এই চিঠি আনা লিখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবি-কাহিনী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এক কপি পাঠিয়েছিলেন আনার কাছে তারই প্রাপ্তিস্বীকার করে ২৬ নভেম্বর ১৮৭৮ আনা লিখলেন, 

…I have to apologize to you for having kept your kind letter of the 11th inst., with the copy of ‘কবি-কাহিনী’ unacknowledged so long; but various causes, in the shape of illness, have combined to hinder me from doing so till the present moment, and have fever upon me. even as I write this, I Thank you very much indeed for sending me the entire publication of ‘কবি-কাহিনী’ though I have the poem myself in the numbers of ‘ভারতী’, in which it was first published, and which Mr. Tagore was good enough to give me before going away: and have had it read and translated to me, till I know the poem almost by heart. You are under a misapprehension when suppose that I have learnt’ Bengali. I was only a beginner, for ill-health has come in the way of my studies, and I have had to cease continuing them.

kabi o kahini
কবি-কাহিনী বইয়ের আখ্যাপত্র

 

রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম বইয়ের আখ্যাপত্রে ছিল, কবি-কাহিনী / শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত/ ও / শ্রীপ্রবোধচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক / প্রকাশিত/ কলিকাতা / মেচুয়াবাজার-রোডের ৪৯ সংখ্যক ভবনে / সরস্বতী যন্ত্রে / শ্রীক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায় কর্তৃক/মুদ্রিত / সংবৎ ১৯৩৫ ছআনা দামের বই, ছাপানো হয়েছিল পাঁচশো কপি একেবারেই নবীন এক কবির কাব্যের পক্ষে সংখ্যাটা বেশ বেশিই সে কারণেই হয়তো সে বইয়ের বোঝা সুদীর্ঘকাল দোকানের শেল্ফ এবং প্রকাশকের চিত্তকে ভারাতুর করে অক্ষয় হয়ে বিরাজ করছিল 

রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে এ বইয়ের আর কোনও পুনর্মুদ্রণ বা সংস্করণ হয়নি হতে দেননি রবীন্দ্রনাথ কারণ তাঁর অল্পবয়সের কাঁচা লেখা সম্পর্কে নির্মম ছিলেন তিনি লিখেছিলেন,

‘প্রকাশের পূর্ণতায় যা পৌঁছয়নি তারও মূল্য আছে হয়তো, ইতিহাসে, মনোবিজ্ঞানে; তাই সাহিত্যের অবজ্ঞা এড়িয়েও সে প্রকাশকের পাসপোর্ট পেয়ে থাকে’ 

চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিতে আরও লিখেছেন,

‘দ্রৌপদীর লজ্জা শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করেছিলেন, আমার কবিতার লজ্জা তোমরা রাখলে না …কবিকাহিনীতে ভগ্নহৃদয়ে অল্প-স্বল্প পাক ধরেছে, এই জন্যেই ওদের কৃত্রিম প্রগলভতাকে বলা যায় জ্যাঠামি সদরে তার প্রদর্শনীটা ভালো নয়

জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কবি-কাহিনীর জন্য একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ হয়তো তরুণ কবির সেই প্রথম কবিআনার সঙ্গে আনা জড়িয়েছিলেন বলেই তাই ১৯৪০-এ প্রকাশিত ছেলেবেলা-য় কাঁচা বয়সের লেখার সূত্রে থাকল আনার কথা এবং ওই ১৯৪০-এই রবীন্দ্র-রচনাবলী-র অচলিত সংগ্রহের প্রথম খণ্ডে থাকল কবি-কাহিনী, প্রথম প্রকাশের ৬২ বছর পরে 

আনাও মনে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর বিয়ে হয়েছিল স্কটিশ শিক্ষাবিদ লিটলডেল-এর সঙ্গে আনা প্রবন্ধ লিখতেন ‘নলিনী’ নামে 

কবি-কাহিনীর নলিনী!