নাচো তো দেখি!

হ্যালো? কে?… ও আচ্ছা আচ্ছা! নমস্কার স্যার! প্লিজ কিছু মনে করবেন না। অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে বলে আমার গলার আওয়াজ একটু চড়ে গিয়েছে। খোদ আপনি ফোন করেছেন, এটা ভাবতে পারিনি। আসলে, আমাকে সবাই মিস্ড কল দেয়। কেউ ফোন করে না। সিমেন্ট-বালি, চুন-সুরকি, ইট-কাঠ, মার্বেল-গ্রানাইট— এইসবের সাপ্লায়ার; ইলেকট্রিক মিস্তিরি, কলের মিস্তিরি, সিন্ডিকেটের বড়দা— এদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা। এদের দৌড় মিস্ড কল দেওয়া পর্যন্ত। মালগুলো ‘মিস্ড কল’ পর্যন্ত বলতে পারে না। বলে ‘মিস্কল’’। আমিই সবাইকে রিং ব্যাক করি। আপনাকেও করব নাকি? দরকার নেই বলছেন? আচ্ছা, ঠিক আছে।

আমার ওঠাবসা ছোটলোকদের সঙ্গে হলেও থাকি ভদ্রলোকের লোকালিটিতে। কুসুমপুর স্টেশনের লাগোয়া এই পাড়ায় হাইলি এডুকেটেড লোকেদের বাস। টিচার, প্রফেসর, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার— এক সে বড়কর এক! এদের মধ্যে আমার মতো দু-এক পিস গবেট প্রোমোটার ট্যাঁকের জোরে ঢুকে পড়েছে…

আপনি স্যার ঠিকই ধরেছেন, আমি একদম গবেট নই। কুসুমপুর রাজ কলেজ থেকে বিএ পাশ। কথায় আছে, ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ম…’ অর্থাৎ বিদ্যা বিনয় দান করে। আমি তাই সবসময় বিনয়ী থাকি। ওতে এডুকেটেড ইমেজটা ভাল খোলে। অবশ্য এখানকার যা অবস্থা! লোকে বিদ্যা বলতে বিদ্যা বালন বোঝে। ঘোর কলি।

এডুকেশনের কথাই যখন উঠল, তখন সত্যি কথাই বলি, কুসুমপুর কলেজে পড়াশোনা কম করেছি, মারদাঙ্গা বেশি। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, বেঙ্গলের সব জিনিসে পলিটিক্স। এমনকি, রাজনীতিতে পলিটিক্স ঢুকে গেছে। কলেজে পড়ার সময় আমিও তাই পলিটিক্সে ঢুকে গিয়েছিলাম। যে পুজোর যে মন্তর। বাবার চুন-সুরকির ব্যবসা ছিল। হ্যান্ড টু মাউথ কেস। পুরো ব্ল্যাক অ্যা্ন্ড হোয়াইট বাংলা আর্ট ফিলিম। টিবি রুগি নায়ক রক্ত বমি করতে করতে মরে যাচ্ছে। আধ-পাগলি নায়িকা, ‘আমাকে বাঁচতে দাও’ বলে চেঁচাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুলোট বাঁশি বাজছে। কান ফেস্টিভাল বা নাক চলচ্চিত্র উৎসবে আমরা স্ট্রাগলের ফিলিম বানিয়ে পাঠালে সিয়োর সোনার গাধা কিংবা রুপোর উল্লুক পাবে। একার মেহনতে, একার কানেকশানে, একার ক্যালিতে আমি এখন কুসুমপুরের এক নম্বর প্রোমোটার। স্টেশনের পাশের এই জায়গাটাতে হেব্বি ডেভেলপমেন্ট দিয়েছি। মিডিল ক্লাস বেঙ্গলির পক্ষে আইডিয়াল ঠিকানা।

এ তো আর ক্যালকাটা নয় যে ছিয়াশিতলা মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিং উঠবে। শপিং মল আর মাল্টিপ্লেক্স হবে। ক্যালকাটা থেকে একশো কিলোমিটার দূরের জেলা শহরে ওরকম ডেভেলপমেন্ট হয় না। এখানে সবাই নিজের জন্যে বাড়ি বানায়। দোতলা বাড়ির সামনে কেয়ারি করা ছোট বাগান, বাগানের মাঝখানে নুড়ি বিছানো রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে মরশুমি ফুলের বেড। এখানে সবার বসার ঘরের দেওয়ালে ছৌ নাচের মুখোশ ঝোলে, সবার মোবাইলের রিংটোনে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজে। বিকেল হলে ছেলে-ছোকরার দল ফুটবল-ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন খেলতে নেমে পড়ে। যে মরশুমে যা। সন্ধে নামলে কচি কচি মেয়েরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধে, ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো।’ এখানে বাংলা ব্যান্ডের নাম ‘কলরব’ কিংবা ‘অচিন পাখি’। এখানে থেকেও শান্তি স্যার। আপনি যখন নতুন পোস্টিং পেয়ে কুসুমপুর থানায় এলেন, তখন আপনার সঙ্গে দেখা করে বলেছিলাম যে আমাদের পাড়ায় চলে আসুন। কিন্তু আপনি ভাঙাচোরা পুলিশ কোয়ার্টারেই সেটল করলেন। আমার রিকোয়েস্ট রাখলেন না।

এই বয়সটা স্যার ভাল না। বুড়ো-হাবড়া তো আর হইনি। জিনস, টি-শার্ট, স্নিকার পরি; রোববার গোঁফে আর চুলে কলপ করি, সন্ধেবেলা সিঙ্গল মল্ট খাই, হাতে আর গলায় সোনার চেন পরে বাইক দাবড়ে রাস্তা দিয়ে গেলে ছুঁড়ি থেকে বুড়ি, সবাই আড়চোখে মাপে। আপনারও স্যার ব্যাপক চেহারা।

সেদিন আসেননি, খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আজ এলেন না, এতে আমি খুশি। এ হল বিচক্ষণতার লক্ষণ। আপনি পুলিশের জিপ নিয়ে আসবেন, খাকি উর্দি পরে বাড়ির কলিং বেল টিপবেন, আধঘণ্টা ধরে আমায় জেরা করবেন। তারপর গম্ভীর মুখে, ভুরু কুঁচকে, জিপে উঠে চলে যাবেন। এতে স্যার লোকালিটিতে ব্যাড ইমপ্রেশান হয়। হাজার হোক, আমারএকটা সোশ্যাল রেপুটেশান আছে। কুসুমপুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের আমি প্রেসিডেন্ট, দুর্গাপুজোয় পঁচিশ হাজার টাকা চাঁদা দিই। কুসুমপুর নাট্যোৎসব আমাকে ছাড়া উতরোয় না, কুসুমপুর বইমেলা আমার জন্যই চলছে। অনেক বছরের পরিশ্রমে এই রেপুটেশান তৈরি হয়েছে।

বছর প্রসঙ্গে মনে পড়ল, আপনি আর আমি বোধ হয় এক বয়সি। পঞ্চাশের আশেপাশে। আপনি আটচল্লিশ? আমি তা হলে আপনার থেকে এক বছরের বড়। থানার বড়বাবুর এলডার ব্রাদার। হ্যাহ্যাহ্যা…

এই বয়সটা স্যার ভাল না। বুড়ো-হাবড়া তো আর হইনি। জিনস, টি-শার্ট, স্নিকার পরি; রোববার গোঁফে আর চুলে কলপ করি, সন্ধেবেলা সিঙ্গল মল্ট খাই, হাতে আর গলায় সোনার চেন পরে বাইক দাবড়ে রাস্তা দিয়ে গেলে ছুঁড়ি থেকে বুড়ি, সবাই আড়চোখে মাপে। আপনারও স্যার ব্যাপক চেহারা। জিম-ফিম করেন নাকি? করেন না? তাহলে ওটা ভগবানের দান। মেন্টেন্যান্স ফ্রি। আমাকে দেখুন, রোজ সন্ধেবেলা সিঙ্গল মল্টের কারণে একটা বাজে ভুঁড়ি ডেভেলপ করেছি। চোখের নিচে ব্যাগও হয়ে গেছে। রোজ ভাবি, ভোরবেলা উঠে কুসুমপুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের মাঠে চারপাক দৌড়ব। কিন্তু ভাবনাই স্যার।

যাক গে যাক! যা বলছিলাম। নিজে একদম ফিটফাট থাকি। শরীরের সব সিস্টেম হানড্রেড পার্সেন্ট টনকো। কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো পরিবার। তিরিশ পেরোতে না পেরোতেই আমার মিসেসের হাজার রকমের ব্যামো। আজ আধ-কপালি হচ্ছে, তো কাল ঢে-উ ঢে-উ করে ঢেকুর তুলছে। আজ থাইরয়েড গ্ল্যান্ড প্যাঁচ কষছে, তো কাল পেচ্ছাপের দ্বারে ইনফেকশান হচ্ছে। শালা! মিসেস না মেটিরিয়া মেডিকা? মাঝ চল্লিশে এসে দুটো বাচ্চা বিইয়ে ডিট্টো ইন্দির ঠাকরুনের মতো দেখতে হয়ে গেছে। ফঙ্গবেনে চেহারা, চামড়া খসখস করছে, চুল উঠে গেছে, গাল তুবড়ে গেছে, চোখের তলায় কালির পোঁচ। ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধে হলো পার করো আমারে’ গানটা চালিয়ে দিলে কোনও মাই কা লাল তফাত করতে পারবে না। পাশে শুতে দেয় না, কিস খেতে দেয় না, বাকি পববো না হয় বাদ দিলাম। গত পনেরো বছর ধরে আমরা আলাদা আলাদা ঘরে শুই। এখন আমরা ভাইবোন।

আমার স্যার দু-দুটো ইস্যু। বড়টা মেয়ে। সে ক্যালকাটায় চাকরি করে। উইকেন্ডে বাড়ি আসে। ছোটটা ছেলে। আপনার ছেলের সঙ্গেই কুসুমপুর হাইস্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। আপনার ছেলের সঙ্গেই পুনের সিমবায়োসিস কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আমার ছেলের স্ট্রিম কম্পিউটার সায়েন্স। আপনার ছেলের, আর্কিটেকচার। ঠিক বলেছি না? দেখেছেন স্যার, থানার বড়বাবু সম্পর্কে আমি নিয়মিত খোঁজখবর রাখি। সন্ধেবেলা সিঙ্গল মল্টের বোতল নিয়ে আপনার কোয়ার্টারে যাব নাকি? বাচ্চাগুলোর ফিউচার নিয়ে ডিসকাস করা যেত। ওরা তো আমাদের কাছে বাচ্চাই, তাই না স্যার? ছেলেমেয়ে যত বড়ই হোক না কেন, পেরেন্টদের কাছে বাচ্চাই থাকে।

আপনার কোয়ার্টারে যেতে বারণ করছেন? কেন স্যার? অন সেকেন্ড থট, না যাওয়াই ভাল। তুলতুলির ব্যাপারটা নিয়ে লোকালিটিতে একটা ক্যচাল বেঁধেছে, পাবলিক ভাববে মিউচুয়াল করতে থানায় গিয়েছিলাম।

ক্যাচাল বলতে স্যার, কুসুমপুরের পাবলিক আমার ওপরে খচে আছে। ভয়ভক্তি করে, তাই সরাসরি মুখ খুলছে না। আড়ালে ঘোট পাকাচ্ছে। এ নিয়ে আমার বিবেক একদম ক্লিয়ার। আমি আর তুলতুলি যা কিছু করেছি, এক দুজে কে লিয়ে করেছি।

বইটা দেখেছেন স্যার? আমাদের টাইমে রিলিজ করেছিল। কমল হাসান হিরো আর রতি অগ্নিহোত্রী হিরোইন। ‘হম বনে তুম বনে এক দুজে কে লিয়ে…’ হিরোইনের কr নাম! রতি! বইটা পনেরোবার দেখেছিলাম। সিন টু সিন মুখস্থ। শুনবেন?

না না! পুরনো ডায়লগ বলে আপনার ভ্যালুয়েবল টাইম ওয়েস্ট করব না। তুলতুলির কথায় আসি। কুসুমপুর হাইস্কুলের বাংলার মাস্টার গৌতমের মেয়ের নাম তুলতুলি। গৌতম-মাস্টারের বউয়ের নাম অনিন্দিতা। রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি থেকে কীসে যেন একটা এম.এ। কুসুমপুরের কালচার-ফালচারের ব্যাপারটা ও-ই দেখে। বিজয়া সম্মেলনী, পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, রসুন সন্ধ্যা— এসব অনিন্দিতাই দেখে। রসুন সন্ধ্যা মানে জানেন না? আপনি আমাকে হাসালেন স্যার! রবীন্দ্রনাথ-সুকান্ত-নজরুল সন্ধ্যা। থ্রি-ইন-ওয়ান কম্বো প্যাক। এবার বুঝেছেন?

আমি তুলতুলিকে চিয়ার আপ করতে নিয়মিত কুসুমপুর ড্যান্স অ্যাকাডেমিতে যেতাম। দেখতাম অনিন্দিতা নিজের মেয়েকে দিয়ে কী স্ট্রাগলই না করাত! ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেপস শেখাত। যেখানটায় ওড়না তুলতে তুলতে চেস্ট দোলাতে হয়—ওইখানটা পারছিল না বলে পায়ের গোছে শপাশপ স্কেলের বাড়ি মারত। লাল দাগ হয়ে যেত। আমাকে জড়িয়ে ধরে তুলতুলির সে কী কান্না! তখনই তখনই আমি স্যার গলে গেলাম।

ইন্ডিয়ায় বিশ্বায়ন আসার পরে এইসব কালচার তো উঠেই গেল। অনিন্দিতা তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলে ফেলল। বাড়ির একতলায় খুলে ফেলল ‘কুসুমপুর ড্যান্স অ্যাকাডেমি’। ‘ফার্স্ট টাইম ইন কুসুমপুর!’ বিয়ের আগে অনিন্দিতা টালিগঞ্জে খুব স্ট্রাগল করেছিল। এখনও রেগুলার ক্যালকাটা যায়। টলিউডে হেব্বি কানেকশান। কুসুমপুরের একমাত্র মেন্টর হল অনিন্দিতা-ম্যাম। হ্যাঁ স্যার! এদের মেন্টর বলা হয়। সঙ্গে স্যার বা ম্যাম। দাদা, দিদি, গুরুজি— এইসব আনস্মার্ট কথাবার্তা ফ্লিম-টিভির লাইনে চলে না।

আচ্ছা, আচ্ছা, ফ্লিম নয় ফিলিম। এনিওয়ে, কুসুমপুর ড্যান্স অ্যাকাডেমির প্রথম সাকসেস অনিন্দিতার মেয়ে তুলতুলি। ‘নাচো তো দেখি’ নামের যে ড্যান্স রিয়েলিটি শো-টা প্রতি সোম, মঙ্গল ও বুধবার রাত সাড়ে ন’টা থেকে এগারোটা পর্যন্ত স্কুপ চ্যানেলে দেখায়, তার অডিশানে একবারেই উতরে গেল। প্রথম দিন তুলতুলি নেচেছিল, ‘বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু, আমাদের প্রার্থনা এই শুধু…’ ওর নাচ দেখে সারা বেঙ্গল কেঁদে ভাসিয়েছিল। এই ডিসট্রিক্টের একজন ঢেলে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু এই পাবলিকের ভোটের ভরসায় বসে থাকলে তো চলবে না স্যার। আমি কুসুমপুরের সিটিজেন। আমার এক্সট্রা রেসপন্সিবিলিটি আছে। ওই একটা এপিসোডের জন্য আমি তুলতুলির পিছনে দশ হাজার টাকা ঢেলেছিলাম। লোকাল পিসিও’র চারটে ছেলেকে ফিট করেছিলাম। তারা চারটে মোবাইল থেকে একটানা ওকে ভোট দিয়ে গেছে। টাফ কম্পিটিশানের মধ্যে ফার্স্ট রাউন্ড কি এমনি এমনি পেরোল? তখনও স্যার, ওকে দেখে আমার কিছু মনে হয়নি ‘কিছু’ মানে স্যার… ওই আর কি! ইন্টুমিন্টু কেস। আপনি স্যার সবই বোঝেন। একটু আগেই তো বললাম, আমি আর আমার মিসেস আলাদা ঘরে শুই।

সেকেন্ড রাউন্ড ওকে গান দিয়েছিল, ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়?’ আপনি ভাবুন স্যার, কী শক্ত গান! খলনায়ক বইয়ের গান, মনে আছে নিশ্চয়? সঞ্জয় দত্ত হিরো আর মাধুরী দীক্ষিত হিরোইন। নীল ঘাগরা চোলি পরে মাধুরীর ওই ঠুমকা, ওই ঝটকা, ওই লচক, ওই মটক… পুরো ক্লাসিক! আমাদের তুলতুলি কি ওই জিনিস ফুটিয়ে তুলতে পারবে?

পারল, জানেন স্যার! আমি তুলতুলিকে চিয়ার আপ করতে নিয়মিত কুসুমপুর ড্যান্স অ্যাকাডেমিতে যেতাম। দেখতাম অনিন্দিতা নিজের মেয়েকে দিয়ে কী স্ট্রাগলই না করাত! ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেপস শেখাত। যেখানটায় ওড়না তুলতে তুলতে চেস্ট দোলাতে হয়—ওইখানটা পারছিল না বলে পায়ের গোছে শপাশপ স্কেলের বাড়ি মারত। লাল দাগ হয়ে যেত। আমাকে জড়িয়ে ধরে তুলতুলির সে কী কান্না! তখনই তখনই আমি স্যার গলে গেলাম। মেয়েদের কান্না দেখে কে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে বলুন? আমার মনে হল আমি শুকনো মরুভূমি, তুলতুলি আমার ঝরনা! আমি রাজ মালহোত্র, তুলতুলি সিমরন। আমি বীর, তুলতুলি জারা। আমি হীর, তুলতুলি রঞ্ঝা।

কালচার-ফালচার আমার আসে না স্যার। আমি প্রোমোটার মানুষ। জমি পছন্দ হলে তার দখল নিই। সেই দিন থেকে আমি তুলতুলির দখল… সরি দায়িত্ব নিলাম। অনিন্দিতাকে বোঝালাম, ‘কুসুমপুর ক্যালকাটা থেকে একশো কিলোমিটার দূরে। রোজ যাতায়াত করা ইম্পসিবল ব্যাপার। তাছাড়া তোর ড্যান্স অ্যাকাডেমি আছে। গৌতমের টিউশনি আছে। সামলাতে পারবি?’

অনিন্দিতা ঘাড় নাড়ল। গৌতম-মাস্টারও ঘাড় নাড়ল। আমি বললাম, ‘নো চিন্তা, ডু ফুর্তি! আমি আছি। শুটিং-এর দিনগুলোয় আমি তুলতুলিকে নিয়ে যাব। আমি ওর ড্রাইভার। তোরা চাইলে আসতে পারিস।’

গৌতম-মাস্টার বিশ্ব কুড়ে। একদিনের জন্যেও আসেনি। অনিন্দিতা সপ্তাহে একদিনের বেশি সময় দিতে পারত না। এদিকে তুলতুলিকে প্রতি মাসে একটানা কুড়িদিন কলকাতায় থাকতে হচ্ছে। নিজের শুটিং না থাকলেও থাকতে হচ্ছে। কখনও গ্রুমারদের জন্য, কখনও মেকআপ আর্টিস্টের জন্য, কখনও কোরিয়োগ্রাফারের জন্য, কখনও স্টাইলিস্টের জন্য।

ফাইনাল রাউন্ডে বেলি ডান্স করে, বেঙ্গলের লাখ লাখ মানুষের এসএমএস ভোটে তুলতুলি ‘ডান্সিং কুইন’ খেতাব জিতেছে। যারা ওকে ভোট দিয়েছে, তার মনে মনে ওকে নাবালিকা ধর্ষণ করেনি? আমি বিয়ে করে ঘরে বউ হিসেবে তুলতুলিকে স্থান দিয়েছি। দোষ হয়ে গেল আমার?

আমি স্যার বডি ফেলে দিলাম। গলফ্ গ্রিনে মিসেস ইন্দির ঠাকরুনের নামে একটা ফ্ল্যাট কিনে রাখা ছিল। বিপদে আপদে কাজে লাগবে বলে ইনভেস্টমেন্ট পারপাসে কেনা। মিসেস ঠাকরুন সেটা জানে না। মনে হল, অবলা নারীকে বিপদ থেকে বাঁচানোই পুরুষ সিংহের কর্তব্য। শুটিং শেষ হতে হতে ভোর পাঁচটা বাজত। তুলতুলিকে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে যেতাম।

আমি স্যার একটা গোদা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। সেটা হলো, এই সব ফ্যামিলি ম্যাটারে আপনি কেন ঢুকেছেন? ঘটনাটা নিয়ে আমার সঙ্গে মিসেস ঠাকরুনের ব্যাপক বাওয়াল হয়েছে। সে কখনও বলছে, ‘বিষ খাব’। কখনও বলছে, ‘রেললাইনে মাথা দেব’। কখনও বলছে, ‘ডিভোর্সের মামলা করব’। আমি বলেছি, ‘তিন নম্বরটাই বেস্ট।’ খোরপোশের টাকা যা চাও, দিয়ে দেব। মিসেস ঠাকরুন, তুমি শুধু আমাকে মুক্তি দাও। একস্ট্রা-ম্যারাইটাল অ্যাফেয়ার নিয়ে সিভিল কোর্টে রোজ একলাখ মামলা দায়ের হয়। তার সঙ্গে আরও একটা না হয় যোগ হবে। আমার মেয়ে, রোজ ফোনে শাসাচ্ছে, ক্যালকাটা থেকে আর ফিরবে না। পুনে থেকে ছেলে চমকাচ্ছে, সে আর কুসুমপুরে ব্যাক করবে না। পাড়াপড়শি চব্বিশ ঘণ্টা পিএনসিপি করছে। সব আমি সামলে নেব। কিন্তু ফ্যামিলি ম্যাটারে পুলিশ কেন নাক গলাবে?

কী বললেন স্যার, গৌতম আর অনিন্দিতা আমার নামে কুসুমপুর থানায় এফআইআর দাযের করেছে? আপনাকে তা হলে জানিয়ে রাখি যে, গতকালই পুরুত ডেকে তুলতুলি আর আমি বিয়ে করেছি। হিন্দুশাস্ত্র মতে ও আমার অফিসিয়াল বউ। আমার বাড়িতেই থাকছে। তুলতুলি যখন আপনাদের নাকের ডগায় ডিক্লেয়ার করবে যে ও নিজের ইচ্ছেয় আমাকে বিয়ে করেছে, তখন সামলাতে পারবেন তো? হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ঘরের মধ্যে কী করছে, সে বিষয়ে নাক গলানোর অধিকার পুলিশের নেই। কী বললেন? হিন্দু শাস্ত্রমতে দুটো বিয়ে আইনসম্মত নয়? এই নিয়ে প্লিজ, ঘোঁট পাকাবেন না। বলিউডের স্টার থেকে টলিউডের অ্যাকট্রেস— ও জিনিস এখন কহানি ঘর ঘর কি। আর বললাম তো, মিসেস ঠাকরুনকে আমি শিগগিরই ডিভোর্স দেব।

কী বলছেন স্যার? তুলতুলির বয়স কত? ও! এইবার বুঝতে পেরেছি। আপনি গৌতম মাস্টার আর অনিন্দিতার কথায় ভুলে আইনি প্যাঁচ কষছেন। একজ্যাক্টলি জানি না। দাঁড়ান, হিসেব করি। গৌতম মাস্টার আমার থেকে পনেরো বছরের ছোট। তা হলে ধরুন… না না, আরও সহজ হিসেব আছে। অনিন্দিতা আমার থেকে কুড়ি বছরের ছোট। তা হলে হলো…

আপনাকে তো আগেই বললাম স্যার, আমার বয়স উনপঞ্চাশ। ফর্টি নাইন মানে বুড়ো হয়ে গেলাম নাকি? আর যদি হইও, বুড়োদের এখন হেবি বাজার। ‘চিনি কম’ বইটায় তব্বুর সঙ্গে আর ‘নিঃশব্দ’ বইটায় জিয়া খানের সঙ্গে আমাদের অ্যাংরি ওল্ড ম্যান কী লটঘটটাই না করল! দেখেছেন স্যার? ক্লাসিক বই!

ওফ! সোজা হিসেবটা এতক্ষণে মনে পড়ল। তুলতুলি ক্লাস ফোরে পড়ে। ব্রাইট মেয়ে। ক্লাসে কখনও ফেল করেনি। তা হলে ওর বয়স এখন দশ বছর। আপনার পুলিশি কৌতূহল মিটল?

ফোনের মধ্যে চেঁচাবেন না স্যার। কানে লাগে। সামনে ‘নাবালিকা ধর্ষণ’ বলে হুমকি দিচ্ছেন কেন? আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। কারা বলছে যে তুলতুলি নাবালিকা? ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ গানটা তোলার সময় তুলতুলি যখন বুক নাচাতে পারত না— হ্যাঁ, তখন ভদ্রভাবে ‘চেস্ট’ বলেছিলাম, এখন সরাসরি ‘বুক’ বলছি—তখন স্কেলের বাড়ি মেরে মেরে কে ওকে বুক নাচানো শিখিয়েছিল? ওর মা অনিন্দিতা। থার্ড’ রাউন্ডে ‘সরকাইলে খাটিয়া জাড়া লাগে’ গানটার সঙ্গে নাচার সময় ওকে খাটিয়ায় চিত হয়ে শুয়ে পেছন দোলাতে কে শিখিয়েছিল? ওর কোরিয়োগ্রাফার। ফোর্থ রাউন্ডে ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানটার সঙ্গে নাচার জন্য পেটকাটা, পিঠকাটা, খাঁজ দেখানো ব্লাউজ আর শর্ট ঘাঘরা ওকে কে পরিয়েছিল? ওর স্টাইলিস্ট। ফিফথ রাউন্ডে’ ‘টিপ টিপ বরসা পানি’র গানটার তালে তালে নিচের ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ‘সিকিত সিকিত’ আওয়াজ দিতে ওকে কে শিখিয়েছিল? ওর গ্রুমার। সেমি-ফাইনাল রাউন্ডে ‘লক্ষ্মীটি দোহাই তোমার, আঁচল টেনে ধোরো না’ গানটার সঙ্গে ‘আহ্! ছাড়ো না!’ বলতে গিয়ে সেক্সি করে চোখ মারতে কে শিখিয়েছিল? ওর ডিরেক্টর। ফাইনাল রাউন্ডে বেলি ডান্স করে, বেঙ্গলের লাখ লাখ মানুষের এসএমএস ভোটে তুলতুলি ‘ডান্সিং কুইন’ খেতাব জিতেছে। যারা ওকে ভোট দিয়েছে, তার মনে মনে ওকে নাবালিকা ধর্ষণ করেনি? আমি বিয়ে করে ঘরে বউ হিসেবে তুলতুলিকে স্থান দিয়েছি। দোষ হয়ে গেল আমার? কী বলছেন স্যার? আপনি এখন আমার বাড়ির সামনে? প্রিজন ভ্যান নিয়ে আমায় গ্রেপ্তার করতে এসেছেন? কুসুমপুর থানার কনস্টেবলরা আমার বাড়ি ঘিরে ফেলেছে? আপনার কাছে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। অন্তত এই সুযোগে গরিবের কুটিরে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল। তুলতুলিই আপনাদের দরজা খুলে দিচ্ছে। লালপেড়ে, সাদা শাড়ি পরা আমার নতুন বউটা এখন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আমি স্যার ফোন রাখছি। আপনি চলে আসুন। সুস্বাগতম।

অঙ্কন: রৌনক পাত্র

শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২১