বাংলা চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ অনুভূত হয়েছে। নির্বাক থেকে সবাক চলচ্চিত্রের যুগে বিভিন্ন গুণী চিত্রনির্মাতারা যেমন একের পর এক রবীন্দ্রকাহিনি ভিত্তিক ছবি তৈরি করেছেন, তেমনই কবি নিজেও ১৯৩২ সালে কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে এসেছিলেন তাঁর ‘নটীর পূজা’ চলচিত্রায়িত করতে। স্টুডিওর প্রতিষ্ঠতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার কবিকে সাদরে অব্যর্থনা জানান। ছবি পরিচালনার কাজে তাঁকে সহায়তা করেন প্রেমাংকুর আতর্থী। কবি যখন সোভিয়েত রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার চলচ্চিত্রকর্মীদের সঙ্গে তিনি মিলিত হন।
নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির ছোট ভাই মুরারী ভাদুড়ি ১৯২৯ সালে চলচ্চিত্র সম্মন্ধে কবির মতামত জানতে চান। তার উত্তরে একটি চিঠিতে কবি তাঁর চলচ্চিত্র ভাবনা ব্যক্ত করেন। কবি লিখেছিলেন, ‘…উপকরণের বিশেষত্ত্ব অনুসারে কলারূপের বিশেষত্ব ঘটে। আমার বিশ্বাস ছায়াচিত্রকে অবলম্বন করে যে নূতন কলারূপের আবির্ভাব প্রত্যাশা করা যায় এখনও তা দেখা দেয়নি। রাষ্ট্রতন্ত্রে স্বাতন্ত্রে সাধনা, কলাতন্ত্রেও তাই। আপন সৃষ্ট জগতে আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রত্যেক কলাবিদ্যার লক্ষ্য। নইলে তার আত্মমর্যাদার অভাবে আত্মপ্রকাশ ম্লান হয়।’
রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত, ‘নটীর পূজা’ মুক্তি পায় ১৯৩২ সালের ২২ মার্চ উত্তর কলকাতার চিত্রা পেক্ষাগৃহে। ছবির বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয় ১৭ মার্চ দীপালি পত্রিকায়। ওই ছবির বুকলেটের প্রথম পাতায় কবির ছবিও ছাপা হয়েছিল। এরপর থেকে রবীন্দ্রসাহিত্য অবলম্বনে যত ছবি নির্মিত হয়েছিল, সেইসব ছবির বিজ্ঞাপন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু সেই সমস্ত বিজ্ঞাপনের বেশিরভাগই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
অবশ্য ১৯৫৩ সালের পর থেকে রবীন্দ্রকাহিনি ভিত্তিক যে সব ছবি তৈরি হয়েছিল, সেইসব ছবির বিজ্ঞাপন বেশিরভাগই উদ্ধার করা গিয়েছে। অনেকের সংগ্রহেই সেগুলো রয়েছে। সেইসব বিজ্ঞাপনের মধ্যে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন সেই সময়ের বিশ্বভারতী পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৫৮ সালের ২৫ এপ্রিল The Statesman পত্রিকায় রীতা রায় এবং ভারতী দেবী অভিনীত এবং নীতিন বসু পরিচালিত, ‘যোগাযোগ’ ছবির একটি বিজ্ঞাপন উদ্ধার করা গেছে। এই বিজ্ঞাপনটি থেকে জানা যায় যে, ‘যোগাযোগ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল তৎকালীন সাহেবপাড়ার নিউ এম্পায়ার পেক্ষাগৃহে।
বর্তমান রচনায় আগের একটি অংশে আমি লিখেছিলাম যে কবির শোধবোধ ছবির বুকলেটের ভেতরের পাতায়, ‘ চিত্রা সোডা ফাউন্টেন’-এর একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গীত-সুধার প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে।
ষাট এবং সত্তরের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত রবীন্দ্ররচনাভিত্তিক ছায়াছবির বিজ্ঞাপনগুলি, ‘উল্টোরথ’, ‘দীপালি’, ‘দেশ’, ‘জলসা’, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের নিজের সাহিত্য ভিত্তিক ছবির বিজ্ঞাপন ছাড়াও অন্যান্য বাংলা ছায়াছবির বিজ্ঞাপনে প্রযোজকরা কীভাবে কবির উদ্ধৃতি এবং প্রশংসাসূচক বাক্য ও লাইন ব্যবহার করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে আগেই লিখেছি। এই প্রসঙ্গে একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। অবন ঠাকুরের পৌত্র অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শুনেছিলাম একবার জোড়াসাঁকোর লালবাড়ি অর্থাৎ বিচিত্রাভবনের দোতলায় তাঁদের কর্তাবাবা মানে রবীন্দ্রনাথ বাড়ির সকল সদস্যদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কারণ, লালবাড়ির বড় ঘরে ১৯৩৮ সালে সতু সেন পরিচালিত রবীন্দ্ররচনা অবলম্বনে নির্মিত বায়োস্কপ, ‘চোখের বালি’ দেখানো হয়েছিল।
কবির রচনাভিত্তিক হিন্দি ছায়াছবির বিজ্ঞাপনগুলি খুব একটা চোখে না পড়লেও রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে নির্মিত, হিন্দি ছবি ‘ উপহার’ -এর একটি ছোট বিজ্ঞাপন আবিষ্কার করা গেছে ছবির প্রযোজক সংস্থা রাজশ্রী প্রোডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেডের লেটারপ্যাডে। সেই বিজ্ঞাপনে ছবির দৃশ্যর একটি ছবির পাশে লেখা ছিল, ড. রবীন্দ্রনাথ টেগোর-এর ‘সমাপ্তি’ অবলম্বনে নির্মিত, ‘উপহার’ ছবির নির্মাতা, সংগীত পরিচালক, প্রযোজক, গীতিকার প্রমুখের নাম।