শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞাপনের বিষয়টি। তাই অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে থাকলেও আবারও রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফিরে যেতে হচ্ছে।
১৯৫৪ সালের মাসিক বসুমতীর বৈশাখ সংখ্যায় কোলে বিস্কুট কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড অক্ষয়তৃতীয়া উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এবং ভগবান বুদ্ধকে একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একই পাতায় যুক্ত করেছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই বিজ্ঞাপনে কোলে বিস্কুট প্রস্তুতকারক কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথকে ঋষি বলে সম্মোধন করেছেন। রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রজীবনে তথাগতর প্রভাব লক্ষ করা যায়। বুদ্ধ ও বৌদ্ধসংস্কৃতি কবিকে বারেবারে আকৃষ্ট করেছে। ৪ জ্যৈষ্ঠ, বাংলার ১৩৪২ সালে কলকাতার শ্রীধৰ্মরাজিক চৈতবিহারে বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে ভাষণের প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমি যাকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি।’

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার আদিপর্ব থেকেই বৌদ্ধবিদ্যা চর্চায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই কি কোলে বিস্কুট কতৃপক্ষের এহেন উদ্যোগ! সব থেকে আশ্চর্য লাগে যখন দেখি ২০২৫ সালেও কবির ১৬৪ তম জন্মোৎসবেও কলকাতার বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে বিভিন্ন প্রোডাক্ট প্রস্তুতকারকরা তাঁদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে রবীন্দ্রতর্পন করছেন! উইনার আইক্রিম কবি রচিত বইয়ের প্রচ্ছদ ও উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে সিমপ্লেক্স পাইপ প্রস্তুতকারক সংস্থা তাদের প্রোডাক্ট-এর সঙ্গে সামঞ্জষ্য রেখে রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন ব্যবহার করেছে। সাম্প্রতিকতম এই বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রপ্রতিকৃতির পাশে লেখা রয়েছে, ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল চলছল…’।

শ্রীঘৃতর বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই, তাছাড়াও এই পণ্যের বিজ্ঞাপনটিতে অংশ নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, ফজজুল হক, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নলিনীরঞ্জন সরকার। এই বিজ্ঞাপনগুলি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন বছরে প্রবাসী পত্রিকায়। ‘ডায়না’ ন্যাশনাল কসমেটিক্স থেকে ১৩৫৯ সালের ভাদ্র মাসে মাসিক বসুমতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার ব্যবহার দেখা যায়, ‘কুরুবকের পরত চূড়া কালো কেশের মাঝে’।
লণ্ঠন থেকে ইলেকট্রিক বাল্ব বিক্রির জন্যও কবির শরণাপন্ন হতে হয়েছে। গৌর মোহন দাস এন্ড কোম্পানির লণ্ঠনের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে’।… আবার দি বেঙ্গল ইলেকট্রিক ল্যাম্প ওয়ার্কর্স লিমিটেড থেকে প্রস্তুত করা বাল্ব-এর বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছে আরও একটি গানের মাঝের লাইন, ‘ যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো’। মূল গানটি হল, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’।

রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনগুলি যে সব সংস্থা দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল বার্মা শেল, দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়ে, উষা কোম্পানি, সুলেখা কালি, মুদ্রণী, হাওড়া মোটর কোম্পানি, গ্রামাফোন কোম্পানি, মেগাফোন কোম্পানি, বঙ্গজীবনের অঙ্গ বোরোলিন ইত্যাদি। ওই বছরই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্র শতাব্দী স্বারক গ্রন্থ ‘গীতবিতান’ পত্রিকা, প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন-এর পক্ষ থেকে গোপাল হালদার সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ -শতবার্ষিকী প্রবন্ধ সংকলন’, রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কিশোরদের সংকলন, ‘প্রণাম নাও’ ইত্যাদি। কলকাতা পুরসভার ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটের প্রসঙ্গ তো আগেই উল্লেখ করেছি। এইসব পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় রবীন্দ্র বিষয়ক একাধিক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এবং একই সঙ্গে এই পত্রিকাগুলির বিজ্ঞাপনও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায়। ভারতী সেন্ট্রাল ব্যাংকের বিজ্ঞাপনেও কবি উপস্থিত!

জানা যায় যে ১৮৮৯ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে কবি প্রথম বিজ্ঞাপনের কাজ করেছিলেন তারপর থেকে দিনে দিনে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞাপনের জন্য পণ্যের বন্দনা গানের ধারাবাহিকতা চলেছিল ১৯৪১ সাল পর্যন্ত, মানে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ অবধি বলা চলে। মৃত্যুতেও রেহাই নেই। শুরু হল সদ্য প্রয়াত বিশ্বকবিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা।

প্রথমেই গ্রামাফোন কোম্পানি প্রকাশ করেছিল এক প্রচারপত্র, যাকে আজকের চলতি ভাষায় সহজেই লিফলেট বা ফোল্ডার বললে ভুল হবে না। চার পাতার ফোল্ডারের প্রথম পাতায় রবীন্দ্রপ্রতিকৃতি আর নীচে লেখা, ‘সন্ধ্যার রবি উদিবে প্রভাতে নূতন জনম lobhi’, পরের পাতায় কাজী নজরুলের লেখা ‘রবিহারা’ কবিতা। আর ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ গান, পাশে লেখা এই কবিতা আর গানের রেকর্ড নম্বর।

তার সঙ্গে লেখা কুমারী যুথিকা রায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্র স্মৃতি সঙ্গীত, নীচে গান দুটির নাম এবং রেকর্ড নম্বর। তৃতীয় পাতায় যুথিকা রায়ের গাওয়া দুটি গান ও রবিহারা কবিতার শেষ অংশ। দুটি পাতার নিচে লেখা রয়েছে কবিগুরুর পুন্য-স্মৃতির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন…..। পরের অর্থাৎ শেষ পৃষ্ঠায় ৯ জন শিল্পীর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডের তালিকা যা পূর্ব প্রকাশিত। শেষ পৃষ্ঠার একদম নীচে ডানদিকে গ্রামাফোন কোম্পানির অধিকারিককে ইংরেজিতে লেখা কবির একটি চিঠির প্রতিলিপি। তাঁর আশি বছরের দীর্ঘ জীবনে রবীন্দ্রনাথ নাকি ৯০ টি বিজ্ঞাপনের জন্য কলম ধরেছিলেন। পণ্যের স্তুতিবাক্য লেখার জন্য কবি সম্ভবত কোনওদিনই অর্থের দাবি করেননি।