মানব সভ্যতার জন্ম হয়েছিল প্রকৃতির আঁতুরঘরে। পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণে। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিবেচনাহীন কাজ, অসচেতনতার ফলে প্রকৃতি এবং পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য ক্রনাগত নষ্ট হচ্ছে। যার ফল জীবজগৎকেই ভোগ করতে হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণেই বিশ্বজুড়ে পরিবেশ মানুষ এবং প্রাণীর বাসযোগ্য থাকছে না। উন্নত দেশগুলির নিজেদের প্রয়োজনে যথেচ্ছভাবে পরিবেশের উপর আধিপত্য দেখাচ্ছে। মানুষের অরাজকতা, অসচেতনতা এবং লোভই এর জন্য সর্বাংশে দায়ী।
এই উপলব্ধি কিন্তু এক শতাব্দী আগে করে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে প্রকৃতি প্রাধান্য পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু প্রকৃতিকে কেবলমাত্র আবেগময় ভাষায় উপস্থাপন করেই থেমে থাকেননি। শিল্প বিপ্লব বা প্রযুক্তির বহুল প্রয়োগের কারণে পরিবেশের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল তা উদ্বিগ্ন করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, গান, ছোট গল্প, এমনকী চিঠিপত্রেও প্রকৃতি জড়িয়ে ছিল পরিবেশের সঙ্গে। আর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী এবং শ্রীনিকেতন স্থাপনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো তাঁর পরিবেশ মননের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন।
শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি তার ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছিল। উন্নত দেশগুলিতে আধুনিক কৃষিপদ্ধতি প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি বন-জঙ্গল এবং ফলন্ত জমি তিনি ধ্বংস হতে দেখেছিলেন। আর তাই প্রকৃতির প্রতি অনুরাগের জন্য প্রকৃতির ধ্বংস হওয়ার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই উদ্বেগ যে কতদূর সংগত ছিল, তা বোঝা যায়, যখন এই রাজ্যেই কৃষিজমিতে শিল্পস্থাপন নিয়ে আন্দোলন তৈরি হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ দিয়েই আশপাশের পরিবেশকে তাঁর প্রত্যক্ষ করা শুরু হয়। আবার প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা আমরা দেখতে পাই ‘দুই বিঘা জমি’তে।
…নমো নম নমো সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।…
এই কবিতায় দেখতে পাই কবি কেবল প্রকৃতিরূপের বর্ণনাতেই থেমে থাকেননি, প্রকৃতিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি প্রকৃতির মর্যাদা বা গুরুত্বকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ‘বৃক্ষ’ নামে কবিতায় মানুষকে নয় বরং বৃক্ষকেই ‘মৃত্তিকার বীর সন্তান’ এবং ‘আদি প্রাণ’ -এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। লিখেছেন
… মৃত্তিকার হে বীর সন্তান,
সংগ্রাম ঘোষিলে তুমি মৃত্তিকারে দিতে মুক্তিদান
মরুর দারুন দুর্গ হতে; যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে
সন্তরি সমুদ্র -ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে…
আর রবীন্দ্রনাথের গান জুড়ে তো প্রকৃতি বন্দনার কথা। প্রকৃতি, প্রেম, পূজা, যে পর্যায়েরই গান হোক না কেন, সর্বত্রই সেই সময়কার পরিবেশের চিত্র ফুটেছে কথায় সুরে। যেমন ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায় (প্রকৃতি), দিনান্ত বেলায় শেষের ফসল দিলেম তরী পরে, এপারে কৃষি হল সারা (প্রেম), আজি মর্মর ধ্বনি কেন বাজিল রে পল্লবে পল্লবে (পূজা)। প্রেম, পূজা, প্রকৃতি বহ গানেই পরিবেশ এসে ছায়া ফেলেছে। আর এই সমস্ত গানের সূত্র ধরেই রবীন্দ্রযুগের সতেজ প্রকৃতির চিত্ররূপ আমাদের মানসপটে গাঁথা হয়ে যায়।
কিন্তু কবির জীবদ্দশায়তেই এই প্রকৃতির ধ্বংসের বিষয়টি তাঁর কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি তার ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছিল। উন্নত দেশগুলিতে আধুনিক কৃষিপদ্ধতি প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি বন-জঙ্গল এবং ফলন্ত জমি তিনি ধ্বংস হতে দেখেছিলেন। আর তাই প্রকৃতির প্রতি অনুরাগের জন্য প্রকৃতির ধ্বংস হওয়ার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই উদ্বেগ যে কতদূর সংগত ছিল, তা বোঝা যায়, যখন এই রাজ্যেই কৃষিজমিতে শিল্পস্থাপন নিয়ে আন্দোলন তৈরি হয়।
১৯১৪ সালে জাপান সফরে যাওয়ার সময় সাগরে জাহাজের থেকে তেল চুঁইয়ে পড়তে দেখে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পরিবেশ বিষয়ে ধাক্কা খান। বিষয়টি নিয়ে আধুনিক মানুষের উদাসীন মনোভাব প্রকৃতিপ্রেমী রবিকে আরও উদ্বিগ্ন করে তোলে। আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগের ঘাটতি তাঁকে বিশদভাবে লেখার রসদ যোগায়। ফলে এরপর থেকে রবীন্দ্রনাথের বহু প্রবন্ধে পরিবেশ সচেতনতার বিষয়টি লক্ষ করা যায়। পল্লি প্রকৃতি, শহরও নগর, বিলাসের ফাঁস, অরণ্যদেবতা, উপেক্ষিতা পল্লি ইত্যাদি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের গভীর পরিবেশ সূচনা ও তার পরিবেশ ভাবনাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করবার তাগিদ জোগায়। পরিবেশকে বিপর্যস্ত বিপন্ন হতে দেখে কবি বিচলিত হয়ে পড়েন তাই ‘তপোবন’ প্রবন্ধে লেখেন – “…মানুষকে বেষ্টন করে এই যে জগৎপ্রকৃতি আছে, এ যে অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে মানুষের সকল চিন্তা, সকল কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। মানুষের লোকালয় যদি কেবলই একান্ত মানবময় হয়ে ওঠে, এর ফাঁকে ফাঁকে যদি প্রকৃতি কোনওমতে প্রবেশাধিকার না পায় তাহলে আমাদের চিন্তা ও কর্ম কলুষিত ব্যধিগ্রস্ত হয়ে নিজের অতলস্পর্শ আবর্জনার মধ্যে আত্মহত্যা করে মরে।”
আজ আমরা এতদিন পরে এসে দেখছি, প্রাকৃতিক শক্তির প্রাধান্যে নয়, যান্ত্রিক শক্তির প্রাবল্যে প্রকৃতি আজ সত্যিই অসহায়। এই ভবিষ্যৎবাণী তিনি তাঁর ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে লিখে গিয়েছেন। … লুব্ধ মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতিকে ডেকে এনেছে, বায়ুকে নির্মল করবার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা-কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই নষ্ট করেছে।… আজকের পরিবেশবিদরা গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান বলে যে স্লোগান দেন, তা রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণীরই প্রতিধ্বনি।
শিল্পায়ন নগরায়নের নামে যে ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ তাতে বিচলিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও তেমনই সতর্কবাণী দিয়ে গিয়েছিলেন। ‘পল্লী প্রকৃতি’তে তিনি বিষাদের সুরে হারিয়ে যাওয়া গ্রাম্য সৌন্দর্য আর শহর ও শিল্পের উত্থানে ব্যথিত হন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই যে নগরায়ন আর প্রকৃতির সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যতা একসময় আমাদেরকে হুমকির মুখে ফেলবে। তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘… আমাদের পল্লী মগ্ন হয়েছে চিরদুঃখের অন্ধকারে, সেখান থেকে মানুষের শক্তি বিক্ষিপ্ত হয়ে চলে গেছে অন্যত্র। কৃত্রিম ব্যবস্থায় মানব সমাজের সর্বত্র এই যে প্রাণ শোষণকারী বিদীর্ণতা এনেছে, একদিন মানুষকে এর মূল্য শোধ করতে দেউলে হতে হবে। সেই দিন নিকটে এল।…’।
আজ আমরা এতদিন পরে এসে দেখছি, প্রাকৃতিক শক্তির প্রাধান্যে নয়, যান্ত্রিক শক্তির প্রাবল্যে প্রকৃতি আজ সত্যিই অসহায়। এই ভবিষ্যৎবাণী তিনি তাঁর ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে লিখে গিয়েছেন। … লুব্ধ মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতিকে ডেকে এনেছে, বায়ুকে নির্মল করবার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা-কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই নষ্ট করেছে।… আজকের পরিবেশবিদরা গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান বলে যে স্লোগান দেন, তা রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণীরই প্রতিধ্বনি।বনবাণীর ‘বৃক্ষবন্দনা’ পরিবেশবাদী চিন্তাবিদদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা, কারণ গাছ রক্ষা বর্তমান পরিবেশবিদদের কাছে একটা বিষয়।
আবার তাঁর ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় শহুরে জীবনের প্রতি বিকর্ষণে লেখেন,
…দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নব সভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি…
আজ থেকে শতবর্ষেরও বেশি আগে তিনি যন্ত্রের ব্যবহার যাতে মঙ্গলময় হয় তার জন্য বলে গিয়েছেন। ‘পল্লী প্রকৃতি’তে লিখেছেন, মানুষ যেমন একদিন হালগুলোকে, চরকা তাঁতকে, চক্রবান যানবাহনকে গ্রহণ করে তাকে নিজের জীবনযাত্রার অনুগত করেছিল, আধুনিক যন্ত্র কেউ সেই রকম করতে হবে। ‘মুক্তধারা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ গানের মাধ্যমে যন্ত্রের বিকটতাকে তুলে ধরেছেন। লিখেছেন,
…নমো-যন্ত্র, নমো-যন্ত্র, নমো-যন্ত্র, নমো-যন্ত্র!
তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত, তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত,
তব বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ ধ্বংসবিকট দন্ত।…
রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকে আধুনিক যন্ত্রদানবের কথা বলা হয়েছে, দেখানো হয়েছে মানুষ কীভাবে বাঁধ নির্মাণ করে প্রকৃতির জলধারাকে বাগে এনে প্রকৃতির প্রতি অবিচার করেছে। এই নাটকে তার বিরুদ্ধে কবির প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তিনি ডাক দিয়েছেন — ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে।
সত্যিই আজ যন্ত্রই সারা বিশ্বের ভূগর্ভ থেকে নদী-নালা, খাল-বিল, বন-জঙ্গল নির্বিচারে ধ্বংস করে চলেছে। পরিবেশ আর প্রকৃতিকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। রবীন্দ্রনাথ যে আশঙ্কা করেছিলেন বহু আগেই। এবং সেজন্য সতর্কও করে গিয়েছিলেন।
‘রক্তকরবী’ নাটকটি মানুষের অপরিসীম লোভ আর পুঁজিবাদের চরিত্র প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কতটা অমানবিক দুর্বল হয়, ‘রক্তকরবী’র মকররাজ, তার উদাহরণ। রক্তকরবীতে মকররাজ তার যক্ষপুরীর কারাগারে মাটির তল খুঁড়ে একদল ক্রীতদাস দিয়ে সোনা আহরণে মগ্ন। রাজার নাগপাশে বন্দি একদল মানুষ। খুবই লোভী রাজার লোভের আগুনে পুড়ে মরছে তার নিযুক্ত সোনার খনি শ্রমিকরা। পুঁজিবাদের কালো থাবা যেভাবে খনি খুঁড়ে, শিল্পায়ন আর নগরায়নের নামে প্রকৃতিকে বিদীর্ণ করছে, আজকের যুগেও সেই চিত্রটি আমাদের অপরিচিত নয়।
আজকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল স্বরূপ আমরা জানতে পেরেছি মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে বিশ্বজুড়েই মানুষের পরিবেশ মানুষ এবং প্রাণীর বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠেছে। যে জন্য গবেষকরা দায়ী করছেন উন্নত দেশগুলিকে। যেখানে তারা পরিবেশের উপর আধিপত্য দেখাচ্ছে আর এর নেপথ্যে রয়েছে মানুষের অসচেতনতা আর লোভ।
সত্যিই তো আমাদের লোভ আমাদের পরিবেশের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতে প্রলুব্ধ করেছে ক্ষতিকর যেন বেশি লাভের জন্য আমরা ফলে সবজিতে মাছে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে বিভিন্ন রাসায়নিক সার, কীটনাশক দিয়ে অধিক উৎপাদন করাচ্ছি। প্রকৃতিবাদী রবীন্দ্রনাথের এই দর্শন চিন্তার প্রতিফলন রেখে গেছেন বিভিন্ন কাব্য সাহিত্যে। তাঁর ‘আত্মশক্তি’ প্রবন্ধে তিনি সাবধান করে দিয়েছেন। বলেছেন–…আমরা লোভবশত প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার যেন না করি। আমাদের ধর্মে কর্মে ভাবে ভঙ্গিতে প্রত্যহই তাহা করিতেছি, এইজন্য আমাদের সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল হইয়া উঠিতেছে– আমরা কেবলই অকৃতকার্য এবং ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িতেছি…
‘রক্তকরবী’ নাটকটি মানুষের অপরিসীম লোভ আর পুঁজিবাদের চরিত্র প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কতটা অমানবিক দুর্বল হয়, ‘রক্তকরবী’র মকররাজ, তার উদাহরণ। রক্তকরবীতে মকররাজ তার যক্ষপুরীর কারাগারে মাটির তল খুঁড়ে একদল ক্রীতদাস দিয়ে সোনা আহরণে মগ্ন। রাজার নাগপাশে বন্দি একদল মানুষ। খুবই লোভী রাজার লোভের আগুনে পুড়ে মরছে তার নিযুক্ত সোনার খনি শ্রমিকরা। পুঁজিবাদের কালো থাবা যেভাবে খনি খুঁড়ে, শিল্পায়ন আর নগরায়নের নামে প্রকৃতিকে বিদীর্ণ করছে, আজকের যুগেও সেই চিত্রটি আমাদের অপরিচিত নয়।
আর এখানেই সভ্যতা আর প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব। যে দ্বন্দ্বের কথা প্রতীকী রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘দুই পাখি’ কবিতায় বিধৃত। দুটি পাখি মধ্যে একটি বনের, একটি খাঁচার। এই দুই পাখির কথোপকথনের মাধ্যমে সভ্যতা ও প্রকৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থাপিত। দুই পাখি কবিতায় খাঁচার পাখি হল যাকে মানুষ বন্দী করে রাখে। তার নিজের মতো করে চালনা করে। প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা যে মানুষকে কতটা কৃত্রিম তোলে তার প্রমাণ মেলে খাঁচার পাখির কৃত্তিমতায়।
শিলাইদহে থাকতেই রবীন্দ্রনাথ গ্রামোন্নয়নের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তা তাঁর জমিদারির ব্যস্ততার চাপা পড়ে যায়। সেই অপূর্ণ ইচ্ছের প্রকাশ ঘটে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠায়। ১৯০৯ সালে কৃষিবিজ্ঞানে বিএস ডিগ্রি নিয়ে রথীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসেন। এবং পিতার ইচ্ছেতেই শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে কৃষি ও শিল্পের উন্নতিসাধনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় স্কটিশ নগর পরিকল্পনাবিদ প্যাট্রিক গেডেসের সঙ্গে। ১৯১৫ সাল থেকে দশ বছর ভারতে থেকে নগর-পরিকল্পনার কাজ করেন।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘বলাই’ পরিবেশ সচেতনতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। গাছপালার প্রকৃতির প্রতি বলাইয়ের আকর্ষণ বোধ আর ভালোবাসা দেখে বলা যায়, ‘বলাই’ পরিবেশ-সচেতন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য চরিত্র। একটা শিমুল গাছের প্রতি বলাইয়ের অনুরক্ততা, ঘাস লতাপাতা গুল্মের প্রতি বলাইয়ের ভালোলাগা কারো কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু বলাই এর কাছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ কেবল তাত্ত্বিকভাবেই পরিবেশকে তাঁর সাহিত্যকর্মে স্থান দেননি। কুষ্টিয়া শিলাইদহ ও পাতিসর গ্রামে ১৮৯৪ এবং ১৯১৪ সালে শান্তিনিকতনে তার পল্লী উন্নয়নের উদ্যোগ কুটির শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার নজির। প্রকৃতি নিয়ে তাঁর গভীর চিন্তার প্রমাণ দেয়। রবীন্দ্রনাথের পরিবেশবাদী চেতনার সর্বদাই অন্যদের থেকে আলাদা ছিল। শিলাইদহে থাকতেই রবীন্দ্রনাথ গ্রামোন্নয়নের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তা তাঁর জমিদারির ব্যস্ততার চাপা পড়ে যায়। সেই অপূর্ণ ইচ্ছের প্রকাশ ঘটে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠায়। ১৯০৯ সালে কৃষিবিজ্ঞানে বিএস ডিগ্রি নিয়ে রথীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসেন। এবং পিতার ইচ্ছেতেই শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে কৃষি ও শিল্পের উন্নতিসাধনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় স্কটিশ নগর পরিকল্পনাবিদ প্যাট্রিক গেডেসের সঙ্গে। ১৯১৫ সাল থেকে দশ বছর ভারতে থেকে নগর-পরিকল্পনার কাজ করেন। প্যাট্রিকের পুত্র আর্থার গেডেস বিশ্বভারতীতে এসেছিলেন। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আর্থার গেডেস শ্রীনগর, সুরুল, রায়পুর, গোয়ালপাড়া গ্রামকে প্রকৃতিময় করে তুলতে রবীন্দ্রনাথকে সহযোগিতা করেছিলেন।
শ্রীনিকেতনে পরিবেশ নির্মাণের যে ভাবনা ১৯১৬ সালে ‘জাপানযাত্রীর ডায়েরি’তে কবি লিখেছিলেন, তা নিছকই অভিজ্ঞতা ছিল না। কবি প্রকৃতির প্রতি সচেতন হয় বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গাছ লাগানোর একটি উৎসবের সূচনা করেছিলেন। ‘হলকর্ষণ’ শিরোনামে একটি রচনা লিখেছিলেন সেই উপলক্ষে। ১৯২৫ সালের ২৫শে বৈশাখ কবির জন্মোৎসব পালিত হয় শান্তিনিকেতনে। সেই উপলক্ষে সেদিন কবির সদ্য রচিত গান গাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ সচেতনতাকে প্রতিফলিত করে এই গানের পংক্তিগুলি। …মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ।/ ধুলিরে ধন্য করো করুণার পূণ্যে হে কোমল প্রাণ।।/মৌনি মাটির মর্মরে মর্মের গান কবে উঠিবে ধ্বনিয়া মর্মর তব রবে,/ মাধুরী ভরিবে ফুলে ফুলে পল্লবে হে মোহন প্রাণ।…
পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ যে অবস্থানের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বলেছিলেন তিনি যা আধুনিক গানটিক যুগেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজকের জি-২০ সম্মেলনেও আলোচনার বিষয়বস্ত তা। নির্বিচারে বন উজাড় করে গাছ কাটা, প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা, নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে উপজাত বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন প্রকৃতির উপর মানুষের অসীম লোভ আর ক্ষুধার কোন শেষ নেই তাই তিনি ‘প্রশ্ন’ কবিতায় আগাম বিচারের দাবি রেখে গিয়েছিলেন সভ্য সমাজের কাছে – ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো? তুমি কি বেসেছো ভালো?’ এই উত্তর আজও অধরা।