কেউ কেউ বলেন, রান্নার লেখায় এত গল্পের অবতারণা কেন? অনেক প্রেম। কিছুটা ভ্রমণ। ভৌগোলিক ছোঁয়া। এক একটা পদ তো শুধু প্রণালী নয়। আরও অনেক অনেক কিছু। চোখে দেখা, চেখে দেখা, কানে কানে ফিসফিস, ঘ্রাণের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্ক প্রক্ষালন। শেষে আসে পরিতৃপ্তি। স্বাদের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো। এমন করেই গল্প তৈরি হয়।
আসলে অনেকে অনেকবার বললে গল্প হয়ে যায় মিথ। লেখক আর পাঠকের সম্পর্ক মিথোজীবী। এক ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ। পর্তুগিজ মশলাকে চিনব আর ইউসবিও রোনাল্ডো বাদ, তাই কি হয়? হয় না তা।
প্রতিটি রান্নার বিভঙ্গে থাকবে চোরা যৌনতা। ম্যারিনেশন তো আদপে ফোরপ্লে। প্রাকরমণ। রান্নার প্রধান উপকরণ চিনে নিতে পারে তার সঙ্গীদের। একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর। অতঃপর ধাপে ধাপে তুরীয়।
আহা, দিদিঠাকরুণের বাড়ি সেই সে বছর যে শুক্তো খেয়েছিলাম, তেমনটা আর হয় কই? সম্পর্ক, সংস্কৃতি, শ্রদ্ধা, স্মৃতি সব মিলেমিশে একাকার। এইসব আসলে প্রাককথন। ভূমিকা বললেও হয়। ধুলো উড়িয়ে একটা তীক্ষ্ণ বাঁকের পর জিপটা দাঁড়িয়ে গেল। থর। কালো। নতুন। ড্রাইভার সিট থেকে নেমে এসেছে সূর্য। সূর্য নায়েক। ভুবনেশ্বর আই টি সি থেকে ঠিক করে দেওয়া বিশিষ্ট ট্যুর গাইড। অবন্তিকা নেমে আসে গাড়ি থেকে। গত দিন কুড়ি ধরে ওড়িশা চিনছে। তিল তিল করে। দাদুর একটা ডাইরি থেকে হঠাৎই জেনেছে ওড়িশার সঙ্গে ওদের পারিবারিক সম্পর্কের কথা। কর্পোরেট ল আর ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ শেষে ওর নেদারল্যান্ড ফার্ম জয়েন তিন মাস পর। অগাধ সময়। স্বাচ্ছল্য। সুতরাং অতীত খুঁড়ে দেখা।
বেশ উঁচু উঁচু সিঁড়ি উঠে গেছে। আশিটা মাত্র। সূর্য হাসে। বাঁ গালে টোল। গাঢ় সবুজ আভিয়েটর। সাদা কর্ডের শার্ট। ব্লু ডেনিম। তামাটে। শক্তপোক্ত। ব্যাকব্রাশ। পাঁচ দশ। অকারনেই অবন্তিকা হাসে। গ্রামটার নাম গদামানাত্রী। আমরা এখন ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। পাহাড় কেটে মন্দির। রামচন্ডি মন্দির। ব্রাহ্মণ পূজারী নয়। এখানে জানী সম্প্রদায়ের আদিবাসী পূজারী। চলতে চলতে বলতে থাকে সূর্য। আর একটা কথা। পাইক – বরকন্দাজ বলে না? এই এলাকার লোকেরা ভারি যুদ্ধবাজ। এরাই পাইক উপজাতি।
দেবীপ্রতিমা নেই। কালো গ্রানাইট শিলা। সিন্দুর সজ্জিত। কালো চেলিকাপড়। নিচে গ্রামেও মন্দির আছে। পুজো হয়। চলন্তি প্রতিমা। মূল মন্দির এটাই। এই দেবিশিলা প্রায় ১০০ ফুট বলা হয়। এক মজার কাহিনী। পাশের তেঁতুল গাছের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাকি এই শিলা উচ্চতায় বাড়ছিল। একসময় পূজারীর নাগালের বাইরে। সাজাবে কী করে? রাগে দুঃখে পূজারী একদিন গালি গালাজ এমনকি চড় থাপ্পড় পর্য্যন্ত দেয় শিলার গায়ে। অবাক কান্ড। উচ্চতা বৃদ্ধিতে ছেদ।
আর একটা কাহিনি। পূজারির চাষের ক্ষেতে লাঙল দেওয়ার দুটি বৃষ। একটি গেল বাঘের পেটে। যে সে বাঘ নয়। দেবীর বাহন। পূজারী তো কেঁদেই আকুল। সংসার চলবে কেমন করে? দেবীর আদেশে পরদিন থেকে বাঘ এলেন লাঙল টানতে। আসলে আমাদের দেব দেবী তো ঘরের লোক। উমা আর তার সিদ্ধি ভাঙে মজে থাকা বাউন্ডুলে স্বামীকে নিয়ে হাজার লোকগান। সবই সম্ভব। কল্পনায় লাগাম টানতে কে আর মাথার দিব্যি দিয়েছে? ভারী চমৎকার কথা বলে সূর্য। আপনাদের বাংলায় যখন দুর্গাপুজো হয়, সেই সপ্তমী আর অষ্টমীতে এখানে বিরাট জলুস। শয়ে শয়ে পশুবলি। দেবীমূর্তিকে স্নান করিয়ে চুয়া হলুদ সিঁদুরে শোভা। কালো বেনারসী। তারপর একজন কালাসীর ভর হয়। মনে করা হয় দেবী মা তার শরীরের দখল নিয়েছেন। হলুদ সিন্দুর আর কালো কাপড়ের সজ্জায় এরপর তাঁকে নিয়ে গ্রামে ঘরে ঘরে যাওয়া। সাধ্যমত মানুষজনের উপঢৌকন। অষ্টমীতে পাইক আর খাঁড়াইত সম্প্রদায়ের খাঁড়াপুজো। আর তিরন্দাজি , কুস্তি, তরবারি খেলা। পশুবলি ওদিনও হয়। মেলা বসে। কিন্তু একটা অনুরোধ। আসবেন না ওই সময়। অত রক্ত। অত আর্তনাদ। ঈশ্বর বলেছেন? সুদর্শন মানুষটা ভেঙেচুরে যায়।
ফিরতি পথে দুটো নাগাদ জিপ ঘুরে যায় ডানদিকের রাস্তায়। খানিক পর পিচ রাস্তা ছেড়ে লাল টুকটুকে মোরামের পথ। পিছনে লাল ধুলো মেঘ। কোথায়? লাঞ্চ। আমার মামাবাড়ী। খোলা গ্রাম। ওপাশ দিয়ে গেলে ভিতরকনিকা। কী সুন্দর গ্রাম! গাছপালা, ক্ষেত, রাস্তা, ইতিউতি পুকুর, ছোট বড় একতলা দোতলা বাড়ি। সবেতেই ভালোবাসার ছাপ। ওড়িশার মানুষজন বড় আন্তরিক। অক্ষরগুলো কেমন গোলগোল। নরম নরম কথা। ফুলকাটা আসনে বসা। সামনে জলচৌকি। সূর্যের মামী ভাত বেড়ে দেন।
পোড়ামাটির থালায় জুঁই সাদা ভাত। চাষের চালের। মামী কুন্ঠিত। সমান্য আয়োজন করিলু। গোল গোল উচ্ছে ভাজা। কুমড়ো পাতা দিয়ে ডাল। অমৃত। দেশি মুরগির দম পোখত। সবজি চাটনী। হাত দিয়ে চেটে পুটে খাওয়া। সূর্যর মামাবাড়ির পদবী জেনা। দীঘল চোখের লম্বা মানুষ জন। একটু বিশ্রাম নিন। আপত্তি জানায় অবন্তিকা। একটু গ্রামটা দেখা যাবে? মামার ছেলে অনন্ত। বছর চোদ্দ। সঙ্গী হয়। আমরা কি একটু মেনুটার সুলুক সন্ধান করবো? ওরা ততক্ষণ গ্রামটা দেখে আসুক।
কালোজিরা চাল রান্নার আগে ভালো করে ধুয়ে অন্তত আধ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। চালের আড়াইগুণ পরিমান জল গরম হলে সামান্য নুন আর ভিজে চাল। ২০/২৫ মিনিটেই ভাত তৈরি। গরম গরম খেতে হবে কিন্তু। এবার কুমড়ো পাতা, নরম ডাঁটা টুকরো করে নিতে হবে। খোসা সমেত মুগ ডাল আর মসুর ডাল সম পরিমাণ। ঘণ্টা চারেক ভিজানো। কটা কাঁচা লঙ্কা মাঝারি কুচিয়ে নিতে হবে। প্রেসার কুকারে একটা সিটি। এবার ওভেনে কড়া বসিয়ে সরষে তেল। এক নম্বর। ঝাঁঝালো। ফুটে উঠলে পাঁচফোড়ন। দুটো শুকনো লঙ্কা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে। হলুদ গুঁড়া, লঙ্কা গুঁড়ো সামান্য। একটু চিনি। পরিমান মত নুন। গোটা রসুনের কোয়া কয়েকটা। এইবার দু মিনিট পরে ডাল আর কুমড়ো শাক সেদ্ধ। মিনিট পাঁচ। দুটো আলুবোখারা পিষে মিশিয়ে দিন। নামিয়ে নিন। তৈরি।
চিকেন দম পোক্ত তৈরি করা বেশ সহজ। এক কিলো দেশি মুরগির মাংস মাঝারি পিস। ওতে দিন বড় দু চামচ বেরেস্তা। মানে ওই যে, ঝুরঝুরে করে ভেজে রাখা পিঁয়াজের কুচি। একটা বড় এলাচ গোটা তিন ছোট এলাচ, দারচিনি, একটু আদাশুট, স্টার আনিস, সামান্য শা জিরে, কটা লবঙ্গ আর কাবাবচিনি,দুটো লং পিপার গরম তাওয়ায় নেড়েচেড়ে তারপর পিষে নিন। এই গরম মশলার এক চামচ মাংসে দিয়ে দিন। হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, গোলমরিচ গুঁড়ো সব ছোটো চামচের এক চামচ করে। আদা রসুন বাটা বড় এক চামচ। মন দিয়ে মাখাতে থাকুন মাংসে। ছটা আমন্ড বাদাম ভিজিয়ে পেস্ট করা আর ফেটানো দই আড়াইশো গ্রাম। খানিক চিনি , পরিমান মত নুন। ম্যারিনেশনের পর ঢাকা দিয়ে মিনিট কুড়ি। এক কাপের মত ঘন দুধ মাখিয়ে আরও পনেরো মিনিট।
নন স্টিক ডেকচি, চামচ চারেক দেশি ঘি। গরম হলে মাংসের মিশ্রণ। দশ মিনিট কষার পর একদম মিহি আঁচে এলুমিনিয়াম ফয়েল চাপা দিয়ে ডেকচিতে ঢাকা দিয়ে আধ ঘন্টা। মিনিট পাঁচ পর পর একটু নেড়ে দিলে মাংস খুশি হয়ে যায়। আসলে সবাই তো কিঞ্চিৎ গুরুত্ব চায়। ঠিক বলছি তো?
গ্যাস বন্ধ করার পাঁচ মিনিট আগে আরও আধ কাপ দুধে কাশ্মীরের গন্ধ ওয়ালা একটু জাফরান মিশিয়ে নিলে তোফা। রঙ, রূপ, স্বাদে গন্ধে একদম লা জবাব।
কাঁচা কুমড়ো, ভেন্ডি, রাঙা আলু, বেগুন আর চিচিঙ্গে বা তরুলি। ডুমো ডুমো করে কেটে নিন। ফুটন্ত জলে নুন দিয়ে একটু কম কম সেদ্ধ। এবার কড়াতে সরষে তেল , আধ ইঞ্চি দারচিনি, পাঁচফোড়ন, দুটো শুকনো লঙ্কা। পাকা তেঁতুল চটকানো দু চামচ। চার পাঁচ চামচ আখের গুড়। সমসত্ব মিশ্রণ হয়ে উঠলে আমসত্ত্ব – না না, ওই সবজি সেদ্ধ। একটু ফুটে উঠুক। মিনিট পাঁচ পরে ব্যাস। তৈরি। এটা কিন্তু নির্যস ওড়িয়া রেসিপি।
ফিরে যাওয়া এরপর ভুবনেশ্বরে। ডিনারের আমন্ত্রণ সূর্য রাখতে পারবে না। আসলে একটু একটু করে জড়িয়ে পড়ার ভয়। সম্পর্কের ভয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ট্যুর ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে সে কিছু স্বপ্ন নিয়ে। কিছু তো ছাড়তেই হবে। পাওয়ার জন্যে গোটা স্বভূমি। পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান থরের লাল দুটো চোখ। ব্যাকলাইট। অবন্তিকা লাউঞ্জের দিকে পা বাড়ায়। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস। ছোট বড় কাঁটা। ফুটতেই থাকে।
মাঝেমধ্যেই। কাল কোরাপুট যাওয়ার কথা। অন্য গাইড। অন্য গল্প। নাকি সূর্য – ই । আবার। ট্র্যাভেল ডেস্কের দিকে পা বাড়ায়।।

