নজরুল ইসলাম—জনগণের কবি

দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি নজরুল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি রূপে সম্মানিত ও চির আদৃত নজরুল এখনও তিনি দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে ‘চিরনবীন’, ‘চিরযুবা’ এই নবীনকেই তো ‘বলাকা’র কবি রবীন্দ্রনাথ গত শতকের দ্বিতীয় দশকে সাদর আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘চিরজীবী’, ‘চিরযুবা’ সম্বোধনে 

তখন নজরুলের বয়স একুশ-বাইশ স্কুলের পড়া শেষ না করেই নজরুল প্রথম মহাযুদ্ধে বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে মেসোপটোমিয়ায় যান ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দে যুদ্ধ থেকে ফিরে বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করলেন ও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন বলাকার ‘সবুজের অভিযান’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এইরককম তরতাজা যৌবনের দূতকেই নবীন বলে চিহ্নিত করে ‘আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচা’নোর গুরুদায়িত্ব তুলে দিতে চেয়েছেন রবীন্দ্রভক্ত নজরুল রবীন্দ্রানুসারী না হয়েও সেদিন সম্পূর্ণ স্বকীয়তা নিয়ে বাংলা কবিতার স্বর বদল ঘটালেন সোচ্চার প্রতিবাদ, বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে তিনি অন্যায়, শোষণ-পীড়ন, অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁর স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদকেই কাব্য-কবিতায় মূল সুর করে তুললেন বাঁধভাঙা যৌবনের বেগ, প্রাণের উত্তাপ, উদাত্ত বিদ্রোহী মনোভাব তাঁকে অসামান্য জনপ্রিয়তা দিল ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়’— নূতন কেতন সত্যই উড়ল তিনি বাঙালিকে নবজীবনের বার্তা শোনালেন—‘উষার দুয়ারে হানি আঘাত / আমরা আনিব রাঙা প্রভাত / আমরা টুটাব তিমিররাত /, বাঁধার বিন্ধ্যাচল!’

‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য কবি রাজরোষে পড়েননি ১৯২২-এ ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের বিরুদ্ধে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করা হয় রাজদ্রোহের কারণে পরের বছর ১৬ই জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর রায়ে নজরুলকে এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয় ‘আনন্দময়ীর আগমণে’ কবিতায় নজরুল স্পষ্টভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন

‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদনা দিয়ে সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেছিলেন নজরুল ১৯২২-এ সহযোগী সমর্থক, মুজফ্ফর আহমেদ পরম বন্ধুরূপে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তালতলার একই বাড়িতে দু’জনে থাকতেন পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশের আগে তিনি কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে আশীর্বাণী চাইলেন ‘ধূমকেতু’র জন্য রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী পাঠালেন ২৪শে শ্রাবণ, ১৩২৯-এ—‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু, / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, / দুর্দিনের এই দুর্গগিরে / উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন / অলক্ষণের তিলকরেখা / রাতের ভালে হোক না লেখা, / জাগিয়ে দে রে চমক মেরে / আছে যারা অর্ধচেতন!’

ইতিমধ্যেই নজরুল লিখে ফেলেছেন ‘বিদ্রোহী’র মতো দীর্ঘ কবিতাকবিতাটি লেখার পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু মুজফ্ফর আহমেদকে তালতলার ৩/৪ সি বাড়ির নিচের তলার ঘরে কবিতাটি ‘বিজলী’ পত্রিকায় ছাপা হয় প্রথমে ১৯২২-এর ৬ই জানুয়ারি সংখ্যায় এই কবিতার ভাবপ্রবাহে ‘অপূর্ব উন্মাদনার, অভূতপূর্ব আত্মবোধের প্রচণ্ডতায় কবিকে উচ্চকিত অনুভব করেছিলেন মনস্বী কাজী অবদুল ওদুদ তবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য কবি রাজরোষে পড়েননি ১৯২২-এ ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের বিরুদ্ধে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করা হয় রাজদ্রোহের কারণে পরের বছর ১৬ই জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর রায়ে নজরুলকে এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয় ‘আনন্দময়ীর আগমণে’ কবিতায় নজরুল স্পষ্টভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি লিখলেন–

‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল

দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীরযুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাসী?’

‘সব্যসাচী’ কবিতায় মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতি ও চরকা প্রসঙ্গে তাঁর আপত্তির কথাও নির্ভীক কণ্ঠে বলেছেন, ‘সুতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, বসে বসে কাল গুনি / জাগোরে জোয়ান / বাত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি’ চারণ কবির মতোই সেদিন নজরুল পরাধীন জাতিকে সজাগ সচেতন করার গান গেয়েছিলেন তাঁর কবিতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমকালীন রাজনীতির প্রতি শাসন-পীড়ন নীতির প্রতি প্রবল আপত্তি লক্ষ করা গেছে

এছাড়াও বহরমপুর জেলে বসে নজরুল লিখলেন, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে একটি প্রবন্ধ সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে জানালেন, ‘আমি লোভের বশবর্তী হয়ে আমার আত্মোপলব্ধি বিক্রয় করি নাই’ এছাড়াও ঐ সময় ‘ধূমকেতু’তেই পরপর লিখলেন ‘রুদ্রমঙ্গল’, ‘আমার পণ’, ‘মোরা সবাই রাজা’ প্রবন্ধগুলি এগুলিতে তাঁর বিপ্লবী প্রতিবাদী চেতনা সোচ্চার হয়েছে ধূমকেতুতেই ১৯২২-এর ১৩ই অক্টোবর নজরুল পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপক্ষে তাঁর মত প্রকাশ করে লিখলেন—‘সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায় স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক রথী এক একরকম করে থাকেন ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লীর অধিকার পর্যন্ত থাকবে না প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন নাতাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি, এখনো

এমন জোরালো কণ্ঠে ১৯২২-এ স্বাধীনতার অধিকার কাদের, সে কথা বোধহয় সরাসরি লিখে প্রকাশের সাহস যে ক’জনের মধ্যে পাওয়া যায়, নজরুল তাদের একজন তরুণ-তেজস্বী বীর নজরুল মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন তিনি ভারতের স্বাধীনতার পথেকই তাঁর জীবনসাধনা করেছেন স্বাধীনতার নামে যে আদান-প্রদান নীতি আবেদন-নিবেদনের মধ্যে দিয়ে দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, তাতে তাঁর আপত্তির কথা বলতেই তিনি দ্বিধা করেননি ‘আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দর করতে হবে’– এই কথা বলে নজরুল স্বজাতিকে সতর্ক করেছিলেন পরে ‘সব্যসাচী’ কবিতায় মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতি ও চরকা প্রসঙ্গে তাঁর আপত্তির কথাও নির্ভীক কণ্ঠে বলেছেন, ‘সুতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, বসে বসে কাল গুনি / জাগোরে জোয়ান / বাত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি’ চারণ কবির মতোই সেদিন নজরুল পরাধীন জাতিকে সজাগ সচেতন করার গান গেয়েছিলেন তাঁর কবিতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমকালীন রাজনীতির প্রতি শাসন-পীড়ন নীতির প্রতি প্রবল আপত্তি লক্ষ করা গেছে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সেনাদলের সংগ্রামী রণসঙ্গীতই যেন কবি নজরুলের অন্তরাত্মাকে দীপ্তি করেছে কিন্তু নজরুলের কবিতাগুলি সমকালীনতার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত, কারণ নজরুলের হৃদয় মানবিক উদারতায় প্রসারিত আবেগে উদ্বেলিত সহৃদয় স্বভাব নিয়ে নজরুল তার লেখায় মানবিকতাকেই শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন—‘আমি সেইদিন হব শান্ত / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না / অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ ভীম বনভূমে রণিবে না’ 

বলা বাহুল্য, এই থেকেই আমরা অনায়াসে যেতে পারি ‘সাম্যবাদী’ নজরুল, ‘সর্বহারা’র কবি মানবপ্রেমিক নজরুলের কাছে যিনি বলেন— ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন / বেলা বয়ে যায় খায়নি ক’বাছা / কচি পেটে তাই জ্বলে আগুন’ তিনি সেই কথা বলতে চান, সেই বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে চান—‘প্রার্থনা করো— যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস / যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ’ তিনি প্রকৃত অর্থেই জনগণের কবি শোষিত, নিপীড়িত, পরাধীন ভারতবর্ষের জনগণের দারিদ্র্য, বঞ্চনা, অসাম্য, ভেদাভেদ, ক্ষুধা, হাহাকার থেকে কবি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিক সহৃদয়তা নিয়ে সংগ্রামী কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধ রচনা করেছেন, এমনকী কৃষক আন্দোলনে সংযুক্ত হয়ে সেদিন কবি রূপে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন, তেমনি তাদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন প্রমাণ করেছিলেন কলমের শক্তি দ্বারা বিশাল জনহৃদয় জয় করা যায় তিনিই বিশ শতকের বাংলা কবিতার ইতিহাসে জনগণের কবি রূপেই সম্মানিত হয়েছিলেন 

আজ একবিংশ শতকেও সেই ভূমিকা সজীব প্রবহমান— তাই তিনি চিরজীবী কবি রূপেই দুই বাংলার জনচিত্তে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন অমর কবি আজও তাঁর লেখা কবিতা, প্রবন্ধ, গানের সম্ভার নিয়ে আমাদের জীবনে সমান প্রাসঙ্গিক 

১. উদ্ধৃতিগুলি কবি নজরুল ইসলামের রচনাসম্ভার থেকে নেওয়া হয়েছে

২. কবিতার উদ্ধৃতি ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে

কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬ তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে শনিবারের চিঠির শ্রদ্ধার্ঘ্য