Diamond

অভিশপ্ত রত্ন

পৃথিবী জুড়ে অভাব নেই চোখ ধাঁধানো মণি মাণিক্যের। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী, মহারাজা-মহারানিদের মুকুটে, অঙ্গে শোভা পেয়ে এসেছে এইসব মহার্ঘ্য মাণিক। কিছু জহরতের নামও জগৎজোড়া। তবে তাদের কয়েকটির সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে আছে অভিশম্পাত ও দুর্ভাগ্যের কাহিনিআর যুগে যুগে লোকমুখে রহস্যময় চরিত্র নিয়ে চর্চিত হয়েছে শাপগ্রস্ত সেসব রত্ন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে, এর অধিকাংশের জন্মই ভারতে। 

শুরু করা যাক কুখ্যাত হোপ-ডায়মণ্ড’ (Hope diamond) দিয়ে। সর্বপ্রথম পাওয়া ঐতিহাসিক নথিপত্র বলে – এটির প্রথম মালিক ফরাসী রত্ন-ব্যবসায়ী জাঁ বাপ্তিস্ত ত্যাভারনিয়ের। ধূসর-নীল এই হীরের জন্ম তৎকালীন গোলকুণ্ডা রাজ্য, অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের গুনটুর জেলার কুল্লুর খনিতে। ত্যাভারনিয়েরের ছবার ভারত অভিযানের একটিতে, সম্ভবতঃ ১৬৬৬ সালে, হীরেটি তাঁর কাছে আসে। এর প্রকৃত মালিক সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। হীরেটির ওজন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও জানা যায় যে অখণ্ডিত অবস্থায় এর ওজন ছিল ১১২.২৩ থেকে ১১৫ কারাটের মধ্যে। ত্যাভারর্নিয়ের সেটি নিয়ে যান প্যারিসে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ভারত থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আরও অনেক দুষ্প্রাপ্য মাণিক্য। যাই হোক, এই বিশাল হীরে তিনি বিক্রি করলেন রাজা চতুর্দশ লুইকে, সম্ভবতঃ ১৬৬৮ বা ১৬৬৯ সালে। লুই তখন রাজসভার মণিকার সিওর পিতত্তকে বললেন হীরেটি এমনভাবে কাটতে যে সেটি যেন হয়ে ওঠে এক দর্শনীয় বস্তু। তিনি চেয়েছিলেন যে একটি পিনের ওপর লাগিয়ে সেটিকে ব্যবহার করবেন গলবন্ধ হিসাবে। পিতত্তরের দুটি বছর লেগেছিল সেটি কেটে ঠিক করতে। শেষে তার থেকে তিনি তৈরি করলেন পায়রার ডিমের আকারে ৬৯ কারাটের ত্রিভুজাকার হিরে, যার থেকে বিচ্ছুরিত হত অপূর্ব ধূসর-নীল রঙের জ্যোতি। লুই এটি সোনায় বাঁধিয়ে লকেট করে গলায় পরতেন। হীরেটির নামকরণ তিনি করলেন দিয়ামন্ত ব্ল দ্য লা কুরন দ্য ফ্রঁস্’, যার ইংরেজি অর্থ ব্লু ডায়মণ্ড অফ দ্য ক্রাউন অফ ফ্রানস।’  সেই থেকেই ধীরে ধীরে অভিশপ্ত হতে শুরু করল রাজবংশ। 

মাদাম্‌ দ্য মন্‌ভেস্‌প্যান ছিলেন লুইয়ের প্রেমিকা ও রক্ষিতা। ফলে প্রতিপত্তি যথেষ্টই ছিল মাদামের। রক্ষিতাকে হীরেটি দিয়েছিলেন লুই এবং বহুবার সেটি পরেছিলেন মন্‌তেস্‌প্যান। তিনিও রেহাই পেলেন না ভাগ্য বিপর্যয়ের থেকে। নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও রাজপরিবারের অন্তবর্তী এক চক্রান্তের অপবাদ চাপিয়ে দেওয়া হল মন্‌তেস্‌প্যানের ওপর। প্রেমিকাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন লুই। তাঁরই রাজকার্যের তত্ত্বাবধানে ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী নিকোলাস্ ফুকে। একটি উৎসবে পরবেন বলে লোভনীয় ধূসর-নীল হীরেটি চেয়ে নিয়েছিলেন সম্রাটের থেকে। ধূলি ধূসরিত হয়ে গেল ফুকের জীবন। অদ্ভুতভাবে অপযশ ও লাঞ্ছনার শিকার হলেন তিনি। লুই বন্দি করলেন মন্ত্রীকে। বন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয় ফুকের। চতুর্দশ লুইয়ের শেষ কটি দিনও ছিল কষ্টকর। উত্থানশক্তি রহিত হয়ে পায়ের গ্যাংগ্রিনে মারা যান। এই বংশেরই প্রিন্সেস দ্য লামবেল্অল্প সময়ের জন্য পরেছিলেন হীরেটি। এঁর বিয়ে হয়েছিল লুই আলেকজান্দ্রে দ্য বোরবোঁর সঙ্গে যিনি পরিচিত ছিলেন দ্য লাম্‌বেল্নামে। বেশীদিন বিয়ের সুখ সইল না কপালে। বিধবা হলেন প্রিন্সেস। এর পরে ফরাসী বিদ্রোহে উন্মত্ত জনতার রোষের বলি হন তিনি। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে, বংশ পরম্পরায় ব্লু-ডায়মণ্ড তখন রাজা ষোড়শ লুই ও রানি মারি আঁতোনিয়েতের জিম্মায়। দুর্দিন ঘনাতে বেশি সময় লাগেনি। নানান কীর্তিকলাপের জেরে সেসময় প্রজাদের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় লুই ও মারি। তাঁদের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই ফুঁসছিল দেশের মানুষজন। এক বিশাল রূপ নিয়েছিল ঐতিহাসিক ফরাসী বিদ্রোহ। পালাবার ফন্দি এঁটেও শেষরক্ষা হল না। গিলোটিনে দেওয়া হল মারি ও লুইকে। মারি ও লুই যখন প্রজাদের হাতে বন্দিসেসময় রাজার রত্নভাণ্ডার লুঠ করে বিদ্রোহীরা ও চোরের দল। তারপর ইতিহাসের পাতা থেকে উধাও হয়ে যায় হোপ-ডায়মন্ড। ১৯৭২ সালে আবার এর দেখা মেলে প্যারিসে। তারপর নানান হাত ঘুরে চোরাচালান হয়ে সে হীরে আসে লন্ডনে। কিন্তু তখন কাটাকুটি হয়ে তার আসল চেহারা গেছে বদলে। 

এ ব্যাপারেও আছে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মত। কারও মতে রাজভান্ডার লুঠের সময় ক্যাডেট গিও নামে এক চোর নাকি এটি নিয়ে লণ্ডনে পাচার করে। লোকের সন্দেহ থেকে বাঁচার জন্য নাকি কাটাও হয় হীরেটি। ১৯৭৬ তে এটি পুনরায় বাজারে বিক্রি করার জন্য জেল হয় গিওর। আবার ঐতিহাসিক রিচার্ড কুরিনের অনুমান, বিদ্রোহী নেতা জর্জ দাত ফ্রেঞ্চ ক্রাউন জুয়েল’  লুঠের নেতা। এক মিলিটারি কমাণ্ডার কার্ল উইল্‌হেম্‌কে এজন্য ঘুষ দিয়েছিল জর্জ। ১৮০৫ সালে নেপোলিয়নের আক্রমণের সময় নাকি কার্ল পালিয়ে এটি ব্রিটেনে (১৮০৬) নিয়ে আসেন। আর তিনিই নাকি ধরা পড়ার ভয়ে এর আসল রূপ পরিবর্তিত করেন। আবার শোনা যায়, লণ্ডনের হীরে ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল এলিয়াসনের কাছে নাকি এমনই এক হীরে দেখা গিয়েছিল ১৮১২ সালে। দুই দশক ধরে এ হীরে অন্তর্ধানের পেছনে রয়েছে এমনই নানান অনুমান। শোনা যায়, একসময় ব্লু-ডায়মণ্ড’ – এর মালিক হল রাজা চতুর্থ জর্জ। পুরোনো নথিপত্র বলে, বিপুল দেনার দায়ে গোপনে তিনি এটি বিক্রি করে দেন। রাজার মৃত্যুর পর তাঁর শেষ উপপত্নী এলিজাবেথ কনিংহাম্ চুরি করেন এটি। এরপরই ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে তিনিও গোপনে বিক্রি করে দেন ক্রাউন-জুয়েলতখনকার ব্রিটিশ রাজপরিবারে আর থাকেনি এ জহরত। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, লণ্ডনে এক ব্যাঙ্কের মালিক হেনরি ফিলিপ হোপ কিনে নেন হীরেটি। তাঁর পরিবারের নামেই হীরের নাম হয় হোপ ডায়মণ্ড

Hope Diamond
হোপ ডায়মন্ড

ফিলিপের মৃত্যুর পর বংশ-পরম্পরায় তাঁর উত্তরাধিকারীরা অনেকেই লড়েছে এটির মালিকানা পাওয়ার জন্য আর হয়েছে ভাগ্য বিপর্যয়। এই বংশের শেষ উত্তরাধিকারী লর্ড ফ্রান্সিস্ হোপও এটি বিক্রি করতে বাধ্য হন প্রচণ্ড দেনার কবলে পড়ে। হীরে চলে যায় লণ্ডনের জহুরী সাইমন ফ্র্যাঙ্কনেলের কাছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য ঘটনাচক্রে দেনার দায়ে পড়লেন ফ্র্যাঙ্কনেল। ধার মেটাতে হোপ-ডায়মণ্ড বিক্রি করলেন পিয়ের কার্তিয়ের কে (১৯০৯)। হীরের ব্যাপারে কিন্তু ভয়ই ধরেছিল তাঁর। নানান ঘটনা দেখে ফ্র্যাঙ্কনেল আবার হোপ ডায়মণ্ডের নাম দিয়েছিলেন – ‘Hoodo Diamond’পিয়ের হীরেটি দেখালেন মার্কিন কোটিপতি মহিলা ইভালিন ওয়াল্‌শ্‌ ম্যাকলীনকে। তিনি আবার আগে অনেক কিছুই শুনেছেন হীরেটি সম্পর্কে এবং পিয়েরও কিছু গোপন করেননি। কিন্তু কথার ছলে হীরের রহস্যটা বেশ জমিয়ে দিলেন। তখন হীরেটি কেনার ব্যাপারে দোনামনা করেও ইভালিন একবার দেখতে চাইলেন হোপ-ডায়মণ্ড। দেখার পর তো সম্মোহিত ইভালিন। হালকা ধূসর-নীল হীরের মায়াদ্যুতি যেন আলেয়ার আকর্ষণ। ব্যস, শুরু হল ভাগ্য বিপর্যয়। তাঁর ছেলের মৃত্যু হল গাড়ী দুর্ঘটনায়, অতিরিক্ত মাদকসেবনে জীবন শেষ হল কন্যার আর অসুস্থ অবস্থায় চলে গেলেন স্বামী।

নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স্‌‘-এ সেসময় এই কুহকী হীরে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল অনেক গল্পকথা। ১৯১১ সালে হীরেটি কেনেন ইভালিন ম্যাকলীন আর তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৪৭ সালে। ম্যাকলীনের মৃত্যুর পর তাঁর অন্যান্য জহরতের সঙ্গে হীরেটিও কিনে নেয় হ্যারি উইন্‌স্‌টন কোম্পানী। ধূসর-নীল হীরে যার কাছেই গেছে তার জীবনের রঙ হয়েছে ধূসর। এসব নিয়ে বহু লেখালেখি হয় ওয়াশিংটন পোস্ট’-আরও কিছু অদ্ভুত ঘটনা জানা যায় ১৯১১ সালের নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স’ –এর খবর থেকে। হীরেটি সাইমন ফ্র্যাঙ্কনেলের কাছে থাকাকালীন একসময় নাকি বিত্তশালী জাঁক কোলেট্‌ সেটি কিনে নেন। তারপরই আত্মহত্যা করেন তিনি। প্রকৃত ঘটনা জানা যায়নি, তবে নিশ্চিতভাবে কিছু ঘটেছিল। কারণ, মারা যাবার আগেই কোলেট এটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রিন্‌স্ ইভান কানিটোভস্কিকে। তারপরই ইভানকে হত্যা করে রাশিয়ান বিদ্রোহীরা। গ্রিক ব্যবসায়ী সাইমন মন্‌থারাইদেস্ কিছুদিনের জন্য হয়েছিলেন হোপ-ডায়মণ্ডের মালিক। গাড়ী দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে মৃত্যু হয় সাইমনের। ১৯৫৮ সালে হ্যারী উইন্‌স্টন্ কোম্পানি হোপ-ডায়মণ্ড দান করে দেয় ওয়াশিংটনের স্মিথ্‌সোনিয়ান মিউজিয়াম অফ ন্যাশনাল হিস্ট্রিকে। কোম্পানি হীরেটি পাঠিয়েছিল জেমুস্ টড্‌ নামে এক পিওন মারফৎ। নিজস্ব ট্রাক নিয়ে গিয়েছিল টড্‌। হীরে হস্তান্তর করে ফেরার পথে সাংঘাতিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় টডের ও আগুন লেগে যায় তার বাড়িতে। জেমস টড্‌ই হোপ-ডায়মণ্ডের শেষ বলি।

kahinoor-and-england-queen
কোহিনূর মণি ও ব্রিটেনের রানি

যে অলোকসামান্য শুভ্র হীরের বর্ণচ্ছটায় আকৃষ্ট হয়ে রচিত হয়েছে কত না ষড়যন্ত্র, যার মালিকানা পাবার জন্য ঘটেছে কত রক্তাক্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ, সেই অমূল্য কোহিনুরের জন্মস্থানও ভারতবর্ষ। গোলকুণ্ডার কুল্লুর হীরের খনিতেই পাওয়া গিয়েছিল এই অমূল্য রত্ন যার ওজন সেসময় ছিল আনুমানিক ১৯১ মেট্রিক কারাট বা ৩৮.২ গ্রাম। পরে এটি নানাভাবে কাটাকুটি করে ওজন কমিয়ে ডিম্বাকৃতি আকারে আনা হয়। প্রথম দিকে কোথায় কীভাবে ছিল এ হীরে, সে সম্পর্কে তেমনভাবে কিছুই জানা যায় না। একটু পরের দিকের ইতিহাস বলে, চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৩০৬ সালে দক্ষিণের প্রতাপশালী কাকতীয় বংশের রাজা প্রতাপরুদ্রর কাছে হীরেটি সম্ভবতঃ আসে মালওয়ার রাজা মহালকাদেবের থেকে। তখন এর নাম ছিল না কোহিনুর। কাকতীয় রাজা হীরেটি বসালেন দেবী ভদ্রকালীর চোখে। কিন্তু আলাউদ্দীন খিলজীর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেননি তিনি। লুঠ হয়ে গেল হীরে। এরপর এ হীরে বহুবার হাতবদল হয়েছে মুঘল, আফগান ও শিখ শাসকদের মধ্যে। জনশ্রুতিতে কোহিনুরও জড়িয়ে আছে এক রহস্যের ঘেরাটোপে। কোন দেবী স্থানীয় নারী বা কোন রমণীই শুধু ব্যবহার করতে পারবেন এই হীরে। পুরুষ নৈব নৈব চ। তাহলেই ঘনিয়ে আসবে দুর্ভাগ্য। কাকতীয় বংশের মণি-মাণিক্যর সঙ্গে কোহিনুর লুঠ করার পর বেশীদিন রাজত্ব করা হয়নি আলাউদ্দীন খিলজির। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর এই দুর্মূল্য রত্ন চলে যায় তুঘলক রাজবংশে (১৩২০-১৪১৩) তারপর এটি হয় তৈমুর লঙের সম্পত্তি। তিনি হীরেটি নিয়ে চলে যান সমরকন্দ। বাবরের হাত ধরে ভারতে আবার হীরে ফিরে আসে ১৫২৬ সালে। বাবরের কাছে হীরেটির মালিকানা আসার ঘটনা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। তবে বাবরনামা’-য় লেখা আছে যে, এটি তাঁকে দিয়েছিলেন সুলতান ইব্রাহিম লোদী। আবার ইব্রাহিম লোদী ওই হীরে কিভাবে পেয়েছিলেন সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে এটুকু জানা যায় যে, তুঘলক বংশের (১৩২৫-১৩৫১) পর এর মালিকানা যায় সইদ বংশের কাছে (১৪১৪-১৪৫১)। বাবর নিজে কিন্তু কখনও হীরেটি কোনভাবে ব্যবহার করেননি। পুরোনো কারাট মতে হীরের ১৮৭ কারাট ওজনের কথা লিখে গেছেন তিনি। বাবরের লেখা থেকেই কিন্তু জানা যায় আলাউদ্দীন খিলজির কাছে ছিল হীরেটি। যাই হোক, হীরেটির সে সময় নামকরণ হয়েছিল ‘Babur’s Diamond’বাবর সেটি দিয়ে যান তাঁর উত্তরাধিকারীকে। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহ্‌জাহান হীরেটি বসালেন তাঁর বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনে। কিছুদিনের মধ্যেই বন্দী হলেন পুত্র ঔরংজেবের হাতে। আগ্রা দুর্গে আমৃত্যু কেটেছে তাঁর বন্দিজীবন। ঔরংজেবের পৌত্র মোহাম্মাদ শাহের রাজত্বকালে দিল্লী আক্রমণ করলেন পারস্যের বাদশাহ নাদির শাহ্‌ (১৭৩৯)। তখন টলমল মুঘল সাম্রাজ্যের মস্‌নদ। ময়ূর-সিংহাসন শুদ্ধ সব কিছু লুঠ করলেন নাদির শাহ্‌। কিন্তু পেলেন না সেই দুর্মূল্য হীরে। মোহাম্মদ শাহ্‌ তখন দিন কাটাচ্ছেন হারেমে বন্দি অবস্থায়। তিনি তাঁর পাগড়ীর ভাঁজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন হীরেটি। হারেমেরই এক খোজা রক্ষী নাদির শাহ্‌র প্রিয়পাত্র হবার লোভে তাঁর কাছে ফাঁস করে দেয় সেকথা। নাদির শাহ্‌ তখন এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি এক বিশাল ভোজসভার আয়োজন করে নিমন্ত্রণ করলেন মোহাম্মদ শাহ্‌কে। সেসময় পাগড়ী-বদল ছিল এক সম্মানসূচক প্রথা। তিনি মোহাম্মদের কাছে সেই প্রস্তাবই রাখলেন। স্তম্ভিত মোহাম্মদের পক্ষে তো ফেরানো অসম্ভব বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ সেই প্রস্তাব। ব্যস, হাতবদল হয়ে গেল মুঘল সাম্রাজের মহার্ঘ সম্পদ। প্রথম দেখাতেই তো বাকরুদ্ধ নাদিরশাহ্। হীরেটির নামকরণ করলেন কোহ্‌-ই-নূর’, ফার্শীতে যার অর্থ ‘Mountain of light’হীরে কিন্তু সইল না বেশীদিন। ১৭৪৭ সালে ঘুমন্ত অবস্থায় আপন অনুচরদের হাতেই নিহত হলেন নিষ্ঠুর নাদিরশাহ্‌। শাহে্‌র চোদ্দ বছরের নাতি শাহ্‌রুখ মির্জার কাছে এল পিতামহের গর্বের বস্তুটি। নাদির শাহ্‌র সাহসী সেনাপতি আহ্‌মদ আবদালিই রাজত্ব চালাতেন শাহ্‌রুখের হয়ে। নানাভাবে আবদালির কাছে উপকৃত শাহ্‌রুখ কোহিনুরটি উপহার দিলেন আবদালিকে। এই আহ্‌মদ শাহ্‌ আবদালিই ছিলেন আফগানিস্তানে দুরানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১৭৭২ সালে আহ্‌মদ দুরানির মৃত্যুর পর কোহিনূর আর সিংহাসনের মালিকানা নিয়ে লড়াই বেধে গেল তাঁর তেইশটি সন্তানের মধ্যে। ১৮০০ সালে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জামালকে সরিয়ে তখ্‌ত্ দখল করলেন ছোট ভাই মামুদ। জামালকে অন্ধ করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। কোহিনুরটি ছিল কিন্তু জামালের সঙ্গেই। কোনভাবে কারাগারের দেওয়ালে সেটি লুকিয়ে রাখলেন তিনি। এবার মামুদকে উৎখাত করলেন আরেকভাই শা-সুজা। মামুদেরও স্থান হল কারাগারে। তখন চাপাচাপিতে জামাল ভাইকে বলতে বাধ্য হলেন কোহিনুরের কথা। এদিকে মামুদ তাঁর বিশ্বস্ত অনুচরদের সাহায্যে পালিয়ে মিত্রপক্ষের সহায়তায় রাজত্ব ফিরে পান। পরে রাজ্যপাট টলমল হতেই তিনি কোহিনুরের সঙ্গে জামালকে নিয়ে পঞ্জাবে পালিয়ে এসে রাজা রণজিৎ সিংয়ের আশ্রয় চাইলেন। পঞ্জাবকেশরী সন্দেহ করেছিলেন কোহিনূর নিয়েই পালিয়ে এসেছেন এরা। তিনি সেটি চাওয়ায় হীরের অস্তিত্ব অস্বীকার করল দুই ভাই। কোহিনুর আদায় করার জন্য এক পন্থা বার করলেন রাজা। তাদের খাবার দেওয়া বন্ধ করে পাহারা বসালেন বাড়ীর সামনে। সত্যিটা বেরিয়ে এল আর হীরের মালিক হলেন রঞ্জিৎ সিং। ১৮৩৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর পতন হয় শিখ সাম্রাজ্যের। তাঁর মৃত্যুর আগেই অবশ্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় সব সম্পত্তি। বাধ্য হয়ে ব্রিটিশদের হাতে কোহিনুর তুলে দেন রঞ্জিৎ সিং। তাঁর আত্মজ দিলীপ সিংয়ের আট পুত্রই ছিলেন সন্তানহীন। জনশ্রুতিতে রঞ্জিৎ সিং কোহিনুরের মাণিক হয়েছিলেন বলেই নাকি এই অভিশাপ। দেখা গেছে, পুরুষের হাতে এর মালিকানা এলেই ঘটেছে পারিবারিক দুর্ভাগ্য, বিশ্বাসঘাতকতা, রক্তপাত ও পতন। ১৮৫০ সালে লর্ড ডালহৌসীর হাতে এটি যাওয়ার পর কিন্তু মাঝেমধ্যেই টালমাটাল হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত। তড়িঘড়ি জাহাজে করে হীরেটি ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে ঐ সালেরই জুলাই মাসে লণ্ডনে এক অনুষ্ঠান করে কোহিনুর তুলে দেওয়া হয় মহারাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে। তিনি আবার জহুরী দিয়ে এটি কাটিয়ে ছোট করেন (১০৮.৯৩ কারাট)। তাঁর উইলে লেখা ছিল – শুধু রাণীরাই পরবেন এই হীরে। তাঁর মৃত্যুর পর এটি বসানো হয়েছে কুইন মেরী (১৯১১), রাণী আলেকজান্দ্রা (১৯৩২) ও কুইন মাদার এলিজাবেথের অভিষেক-মুকুটে (১৯৩৭)। শুনলে অবাক লাগে, এই একবিংশ শতাব্দীতেও ব্রিটিশ রাজপরিবার কিন্তু কোহিনুরএর ব্যাপারে বেশ সন্ত্রস্ত্র। শোনা যায়, রাজপরিবারে ভুলেও যে পুরুষেরা এটি ব্যবহার করেছেন বা তাঁদের জিম্মায় রেখেছেন তাঁরা হয় পড়েছেন অসুস্থতার কবলে কিংবা মৃত্যু ঘটেছে তাঁদের। রাজা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেকের সময় কিন্তু মুকুটটি পরেছিলেন তাঁর মা। কোহিনুর আর ফেরেনি ভারতে। বর্তমানে এটি রয়েছে টাওয়ার অফ লণ্ডন’-, যেখানে প্রতিদিন এটি দেখার সুযোগ পান অগণিত দর্শক।

black-arlav
ব্ল্যাক অরলভ

 ‘ডেল্‌হি পারপল্ স্যাফায়ার’ (Dellhi Purple Sapphire) – এই লালচে বেগুনী আভার রত্নটি হঠাৎই হাতে এসে পড়ে লণ্ডনের মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির অল্পবয়সী কিউরেটর পিটার ট্যাণ্ডির। কৌতূহলবশতঃ একটি ছোট্ট বাক্স পড়ে থাকতে দেখে সেটি খোলে পিটার। ভেতরে রূপোর আংটিতে বসানো রক্ত-বেগুনী আভার একটি পাথর এবং তার সঙ্গে রয়েছে টাইপ করা সতর্কবাণী – যে এই বাক্সটি খুলবে, প্রথমেই যেন পড়ে নেয় পুরো লেখাটি। তারপর পাথরটি নিয়ে সে কি করবে, সেটা তার ইচ্ছে। তবে আমার মত, একে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া। সময়টা ছিল ১৯৪৩। শুরু হল পারপরল্ স্যাফায়ার সম্পর্কে খোঁজখবর। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এটিও পাওয়া যায় ভারতে। যাওয়া যাক সন তেতাল্লিশের আগে। জানা যায় যে, একসময় ব্রিটিশ অধিকৃত বাংলায় কর্মরত ব্রিটিশ অশ্বারোহী বাহিনীর কর্নেল ডবলিউ ফেরিস ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যান এই পাথরটি।এটি নাকি সিপাহী বিদ্রোহের সময় (১৮৫৭) কানপুরে দেবরাজ ইন্দ্রর মন্দির থেকে লুঠ করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। ফেরিস তো আর জানতেন না যে এই জহরতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাগ্যবিড়ম্বনা। তিনি ইংল্যাণ্ডে ফেরার পরই প্রলয় ঘটে গেল তাঁর সুখী, স্বচ্ছল পরিবারে। হঠাৎই প্রচণ্ড অর্থসঙ্কটে দেউলিয়া হলেন ফেরিস্। তিনি ও তাঁর ছেলে যে যে ব্যবসায় টাকা খাটিয়েছিলেন সব মুখ থুবড়ে পড়ল। তাঁর এক পারিবারিক বন্ধু নিয়েছিলেন এই স্যাফায়ার। আচম্‌কা আত্মহত্যা করায় ধ্বংস হয়ে গেল তার পরিবার। ঐ সময়ের সুবিখ্যাত লেখক, এড্‌ওয়ার্ড হেরল্ড অ্যালেন, যিনি ছিলেন অস্‌কার ওয়াইল্‌ডেরও খুব ভাল বন্ধু, বিশ্বাস করতেন না কুসংস্কার বা পাথরের রহস্যময় শক্তিতে। কিন্তু  ‘ডেল্‌হি-স্যাফায়ারবাড়িতে আনার পরই ঘটতে লাগল অদ্ভূত ধরনের নানা রহস্যময় ঘটনা, যার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি। তখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন পাথরটির অতীন্দ্রিয় সংকেতে। তাঁরও ধারণা হল যে, জনশ্রুতি অনুযায়ী হিন্দু দেবতার মন্দির থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জহরতটি নিশ্চিত ভাবে দেবতারই সম্পত্তি। দেবতার রোষেই ঘটছে নানান ঘটনা। পরে তাঁর যে সব বন্ধুরা পাথরটি নিজেদের কাছে রেখেছিলেন অদৃষ্টের ফেরে তারা ভুগেছেন এমন সব ঘটনার জেরে যা তাদের কল্পনাতীত। সবাই এটি আবার ফেরৎ দিলেন এডওয়ার্ডকে। এবার তিনি সেটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন নিকটবর্তী একটি খালের জলে। অদ্ভুত ব্যাপার যে এক জহুরীর মাধ্যমে স্যাফায়ার আবার ফিরে এল তাঁর কাছে। পাথরটি পাওয়া গিয়েছিল একটি যন্ত্রের ভেতরে যেটির সাহায্যে খাল-বিল-নদীর মাটি তুলে ময়লা পরিষ্কার করা হয়। এইবার অ্যালেন পাথরটি একটি খামে পুরে তার মুখ আটকে দিয়ে খামটি রাখলেন একটি বাক্সের মধ্যে। সঙ্গে ছিল সাবধানবাণী। একটি ব্যাঙ্কে বাক্সটি দিয়ে অনুরোধ করলেন লন্ডন মিউজিয়ামে জমা দেবার জন্য। ২০০৭ সালে ডেল্‌হি-পারপল স্যাফায়ারের এই আংটি সাধারণ মানুষকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। দক্ষিণ ভারতের পন্ডিচেরীতে ব্রহ্মামন্দিরে ব্রহ্মার চোখে বসানো ছিল একটি কালো হীরে। তার থেকে ঠিকরে বেরোয় হালকা নীলের সঙ্গে কালচে সবুজ অপূর্ব দ্যুতি। এটি অপহৃত হওয়ার মূলে নাকি এক জেসুইট পাদরি। যেখানেই হয়েছে  ‘ব্ল‍্যাক-অরলভএর পদার্পণ, সেখানেই ঘটেছে শিহরণ জাগানো ঘটনা ও মৃত্যু। ১৯৩২ সালে এক ব্রিটিশ রত্নব্যবসায়ী জে.উবলিউ প্যারিসের মাধ্যমে কালোমাণিক চলে যায় মার্কিন মুলুকে। প্যারিসের কাছে হীরেটি কিভাবে আসে তা জানা যায় না। তিনি এটি কাকে বিক্রি করেছিলেন তাও অজানা। কিন্তু বিক্রি করার পরই ম্যান্‌হাটানে এক বহুতল বাড়ীর ওপর থেকে ঝাঁপ দেন তিনি। তারপর কালো হীরে কিভাবে রাশিয়ায় গেল সে ব্যাপারে রয়েছে ধোঁয়াশা। এটির মালিক হয়েছিলেন রাশিয়ার প্রিন্সেস নাদিয়া অরলভ – যাঁর নামে হয়েছে হীরেটির নামকরণ। ১৯৪৭ সালে রোমে একটি বাড়ীর ওপরতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনিও। তখন তিনি কিন্তু ছিলেন এক রাশিয়ান জহুরীর ঘরণী। কিছু গবেষকের মতে এক ফরাসী সৈনিক নাকি এটি চুরি করে বিক্রি করেছিলেন রাশিয়ান কাউন্ট গ্রেগরি অরলভ্‌কে। শোনা যায়, পরে এটি কিনে নেন চার্লস এফ উইনসন নামে এক জহুরিতিনি নাকি হীরেটি কেটে তিন টুকরো করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে অভিশাপ ভাঙার ব্যাপারে  তিনি আত্মবিশ্বাসী। তাঁর মনে হয়েছিল এতে হয়ত কেটে যাবে অভিশম্পাত। তারপর আর এ সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তবে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে এই ব্ল‍্যাক-অরলভের লকেট দেওয়া একটি হার ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে রাখা হয় দুষ্প্রাপ্য হীরের প্রদর্শনীতে। অখণ্ড অবস্থায় নাকি এর ওজন ছিল ১৯৫ কারাট। কাটাকুটির পর দাঁড়ায় ৬৭.৫০ কারাট। মাঝেমধ্যে চর্চিত হয়েছে এমনই আরো কিছু জহরতের কথা। কিন্তু লিখিত প্রমাণের অভাবে সেগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, যে সব রত্ন দিয়েছে অশুভ সঙ্কেত, আলেয়ার মত তা টেনেছে মানুষকে। জনমানসে গেঁথে গেছে রহস্যভরা সব ঘটনা। রহস্যের মোড়কেই তো জীবনকে দেখতে ভালবাসে মানুষ।