literature and its cinema

সেলুলয়েডে পরশুরাম

দলে দলে শয়ে শয়ে লোক আসছেন এক মহাপুরুষের দর্শনে। তিনি ত্রিকালজ্ঞ। সেই মানুষটির নাম বিরিঞ্চি বাবা। বিরিঞ্চি শব্দটি  তিন দেবতার (ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব) পরিচয় বহন করায় শব্দটি ওজনে কিছুটা ভারী। তিনি বাকপটু।  দেখতে তাঁকে পঞ্চান্নর মতো হলেও কারও কারও মতে তাঁর বয়স ৫০০, আবার কারও কারও মতে পাঁচ হাজার। সবকালে সবসময় তিনি নাকি অবাধ বিচরণ করতে পারেন। তিনি বলেন যিশু সেদিনকার ছেলে। মনুকে তিনি ডাকেন বিদু বলে। মনুকে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, ভয় কি বিদু আমি আছি। সূর্য বিজ্ঞান আমার মুখের মধ্যে। বিরিঞ্চিবাবার পূর্বে দেখা তালিকা থেকে গৌতম বুদ্ধ, তুলসীদাস, আইনস্টাইন, জগত শেঠ, মানসিংহ কেউ বাদ যান না। গল্পের শেষ দৃশ্য যেন হাসির ফোয়ারা। হোম ঘরে হোম। গনেশ মামা দরজা আগলে। বিরিঞ্চিবাবা তুরীয় অবস্থায়। ঘরে বাছাই ভক্ত। হোম শেষ হতেই কোষা থেকে  জল নিয়ে কুন্ডে ছিটিয়ে দেন বিরিঞ্চি বাবা। আগুন নিভে যায়। ঘর তখন ঘোর অন্ধকার। সেই সময় আবির্ভাব ঘটে মহাদেবের বেশে ক্যাবলারাম। বাইরে থেকে শোনা যায় আগ লাগ গ্যয়া। ঘরে ঢুকতে থাকে শ্বাস রোধকারী ধোঁয়া। বাবা পালিয়ে যান। মহাদেবরূপী ক্যাবলাকে জাপটে ধরেন সত্যব্রত। ক্যাবলা  বলে ওঠেন মাইরি, এখন ইয়ার্কি ভালো লাগে না। চারদিকে আগুন। ছেড়ে দাও বলছি। এক নির্মল হাস্যরস। যে হাস্যরসের স্রষ্টা রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরাম (১৮৮০ থেকে ১৯৬০)। হাস্যরস সৃষ্টিতে যে লেখকের জুড়ি মেলা ভার।

Rajshekhar Basu
রাজশেখর বসু, যাঁর ছদ্ম নাম পরশুরাম

এই গল্প নিয়ে বিশ্ববন্দিত পরিচালক সত্যজিৎ রায় সৃষ্টি করলেন তাঁর ছবি। নাম দিলেন মহাপুরুষ। যেহেতু ছোটগল্প আর সেই গল্পকে টেনে লম্বা করতে চাননি সত্যজিৎ রায়। তাই একসঙ্গে দুটো ছবি তিনি নির্মাণ করলেন। নাম দিলেন ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ। 

কাপুরুষ ছবিটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের জনৈক কাপুরুষের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত আর বিরিঞ্চিবাবা অবলম্বনে মহাপুরুষ ছবিটি। প্রযোজক আর ডি বনশল। সত্যজিৎ রায় এই ছবির চিত্রনাট্যকার এবং সংগীত পরিচালকও বটে। চিত্রগ্রাহক সৌমেন্দু রায়। সম্পাদক দুলাল দত্ত। শিল্পনির্দেশক বংশীচন্দ্র গুপ্ত। এইসব নামকরা কলাকুশলীদের সঙ্গে শিল্পী নির্বাচনেও সত্যজিৎ রায় ছিলেন সজাগ। নাম ভূমিকায় তিনি নিয়ে এলেন চারুপ্রকাশ ঘোষকে। অনবদ্য বললে কম বলা হয়। গল্পে বর্ণিত বিরিঞ্চিবাবা স্পষ্ট উঠে এলেন চারুপ্রকাশ ঘোষের অভিনয়ের গুণে। তাঁর শিষ্য রূপে রবি ঘোষ প্রমাণ করলেন কমেডি অভিনয় কত উচাঙ্গের হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতালি রায়, রেনুকা রায় প্রমুখ। ১৯৬৫ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। দর্শক সমালোচকদের প্রশংসায় ধন্য হয়ে উঠল ছবিটি।

Mahapurush cinema by Satyajit Ray
আর ডি বনশল প্রযোজিত, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত মহাপুরুষ

পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবা নিয়ে এর আগেও একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। এখানে অবশ্য নাম পরিবর্তন করা হয়নি। মূল গল্পের নামটি রাখা হয়েছে। এখানেও একসঙ্গে তিনটি ছবি নির্মিত হয়েছিল। প্রথমটি রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের গল্প নিয়ে অলস্টার ট্রাজেডি, দ্বিতীয়টি রূপকথার গল্প নিয়ে গোঁজামিল এবং তৃতীয়টি বিরিঞ্চিবাবা। পরিচালকও ভিন্ন ভিন্ন। বিরিঞ্চি বাবার পরিচালক ছিলেন কানু সেন। সংগীত পরিচালক কালিপদ সেন। নাম ভূমিকায় মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন জীবেন বসু, শ্যাম লাহা, নৃপতি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী।

Bengali Cinema Parash Pathar
পরশপাথর ছবির পোস্টার

মহাপুরুষ ছবির আগেই সত্যজিৎ রায় পরশুরামের গল্প নিয়ে আরেকটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। তার নাম পরশপাথর। এখানে মূল গ্রন্থের নামও তাই। মূল চরিত্র দুটি। পরেশ বাবু নিজে এবং তার সঙ্গী প্রিয়তোষ। এছাড়া আছে পরেশ গৃহিণী গিরিবালা। মধ্যবিত্ত পরেশবাবু পরশপাথর প্রাপ্তির মাধ্যমে প্রচুর  সোনা করে প্রচুর বিত্ত-সম্পত্তির অধিকারী হন এবং শেষকালে ওই সোনার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে পরম প্রার্থিত কাম্যবস্তুর কথাই উঠে এসেছে ছবিতে।  পরেশবাবু প্রভূত পরিমাণে সোনা তৈরি করায় বিশ্বজোড়া বাজারে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ মানের বিচ্যূতি ঘটতে থাকে। পরেশবাবু খুব হিসেবী ও সাবধানি। সহকারী সম্পর্কে পরেশবাবুর সার্টিফিকেট হল প্রিয়তোষ রত্নবিশেষ। পরশপাথরটি একসময় গিলে ফেললেন প্রিয়তোষ। তবে বিপদ কিছু ঘটেনি। উদ্ভট কল্পনা দিয়ে শুরু  হলেও আধুনিক জীবনে সর্বাধিক সমস্যা জড়িত বিষয়টি ক্রমে ক্রমে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। 

Tulsi Chakraborty
পরশপাথর ছবির প্রধান চরিত্র তুলসী চক্রবর্তী

প্রধান চরিত্র পরেশ বাবুর ভূমিকায় তুলসী চক্রবর্তী। সহকারীর চরিত্রে কালী বন্দোপাধ্যায় এবং গিরিবালার চরিত্রে রানিবালা। একেবারে উপযুক্ত শিল্পী নির্বাচন। যে তুলসী চক্রবর্তী প্রায় অধিকাংশ ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রের অভিনয় করে গেছেন সেই শিল্পীকে এত বড় চরিত্রে সত্যজিৎ রায় নিলেন। তাঁর নির্বাচন যে সঠিক, তা স্বীকার করতেই হবে। সাড়ে চুয়াত্তর এবং পরশপাথর ছবি দুটিতে তুলসী চক্রবর্তী যা অভিনয় দেখিয়ে গিয়েছেন, তা চিরদিনের। এ ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস,পাহাড়ি সান্যাল, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, কমল মিত্র, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, পদ্মা দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখ। ১৯৫৮ সালের মুক্তি পেয়েছিল পরশপাথর।

পরশুরামের গল্প নিয়ে প্রথম ছবি করতে এসেছিলেন পরিচালক জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়। স্বনামধন্য না হলেও তিনি ছবিটি করেছিলেন।গল্পের নাম কচি সংসদ। এই সংসদের সদস্যরা হলেন  কচি সংসদের চিত্রগ্রাহক বিভূতি চক্রবর্তী। শিল্প নির্দেশক পরেশ বসু। তেমন নামজাদা কোনও শিল্পী ছবিতে ছিলেন না। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৭ সালে। এছাড়াও পরশুরামের গল্প নিয়ে আরও একটি ছবি নির্মিত হয়েছিল। নাম ছিল চিকিৎসা সংকট। পরিচালক বিনয় সেন।  বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য, তুলসী চক্রবর্তী, মলিনা দেবী,  ইরা চ্যাটার্জী প্রমুখ। প্রযোজক নরেশ দাশগুপ্ত। চিত্রগ্রাহক সন্তোষ গুহ রায়। সম্পাদক কালী রাহা। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৩ সালে।

বাংলা ছবিতে আবার যখন সাহিত্য ফিরে আসছে তখন আমরা আশা করতে পারি যে পরশুরামের শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড বা লম্বকর্ণ বা ভূশণ্ডির মাঠের মতো গল্পের চিত্ররূপ আমরা পাবো। হাসির ছবির নামে লোক হাসানো ছবির বদলে এই ধরনের গল্প নিয়ে ছবি তৈরি করলে দর্শক হাস্যরসের সন্ধান পাবেন। আমরা আশাবাদী। হয়তো তেমন দিন এল বলে।