যত দু্র্যোগই হোক, এপার বাংলার মতো ওপার বাংলাতেও ‘পুজোর গন্ধ এসেছে।’ এই আবহে ওপার বাংলার পুজোর স্মৃতি নিয়ে কলম ধরলেন লেখক। তাঁর লেখনীতে ধরা পড়ল তাঁর শিশু বয়সে, একাত্তরে দাঙ্গা এবং রিফিউজি সমস্যার ক্রান্তিকালে প্রতিমার পরিবর্তে ঘট পুজোয় ওপার বাংলায় দু্র্গা পূজার নীরব স্মৃতিভার। যে ক্রান্তিকালের ছায়া আজও আবছায়া হয়ে যায়নি। আজও ওপার বাংলার বাতাসে দু্র্গা প্রতিমার খণ্ডিত হওয়ার ভাঙন-শব্দ। সেইসব খণ্ড স্মৃতিকেই জুড়লেন লেখক, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সারাক্ষণ, The Present World –এর সম্পাদক, স্বদেশ রায়।
দিনটা ছিল মহালয়া। সকাল থেকে উঠে লেখালেখি করছি। না, তখনও অবধি কোনও বন্ধু-বান্ধব মহালয়ার শুভেচ্ছা পাঠায়নি। অন্যবার এতক্ষণে টেলিফোন ও এসএমএস- এর মাধ্যমে শুভেচ্ছায় মনটা যেন পূজা পূজা গন্ধে থাকে। মনে করিয়ে দেয়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শোনার ছোট্টবেলার সেই দিনগুলো।
এবার যে কেউ ভুলে গিয়ে বা হিংসা থেকে শুভেচ্ছা জানায়নি, তা নয়। বাস্তবে শুভেচ্ছা জানায় তো, বন্ধু বান্ধবরাই। আর সবসময়ই সকলের নিজস্ব বলয়টি তো তার চরিত্র ও কাজ মিলিয়ে তৈরি হয়।
তো, এ হতভাগার বলয়টিতে লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী, সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান ব্যক্তিবর্গ, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাবেক ও বর্তমান বিচারপতি, কূটনীতিক, রাজনীতিক আর সাংবাদিক পেশার মানুষ তো রয়েছেই। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই অনেকগুলো করে হত্যা মামলার আসামি। কেউ কেউ একই দিনে একই সময়ে দেশের দুই তিনটি শহরের হত্যাকাণ্ডের মামলার আসামি। কেউ কেউ বিচারপতি হয়েও হ্যান্ডকাফ ও পিঠমোড়া অবস্থায় ডকে উঠছেন। এ সময়ে মহালয়ার শুভেচ্ছা আশা পাগলও করে কিনা জানি না।
যাহোক, এমন অনেক নীরব পূজার স্মৃতি একটি জীবনে জমা হয়েছে। যেমন আছে উৎসবমুখর অনেক পূজার- তেমনি খুব ছোটবেলার যে নীরব পূজার স্মৃতিটি কিছুটা ঝাপসা মতো মনে পড়ে আজ সেটাই লিখতে বসেছি।
…বেশ কয়েকদিন হলে সকলেই গ্রামের বাড়িতে। গোটা এলাকাটা তখনও হিন্দু অধ্যুষিত। তারপরেই কেন যেন সারাদিন বাড়ির ভেতর থাকতে হয়। দালানের ছাদগুলোতে শ্যাওলা। সেখানেও যাওয়া যায় না। টিনের চালে সারাদিন সেবার ঝম ঝম শব্দের বৃষ্টি পড়ছে। ওই বৃষ্টিতে ঘরের ভেতর বসে বসে কত আর ক্যারাম বা লুডু খেলে সময় কাটানো যায়!
এ অবস্থায় কখনও স্মরণাপন্ন হই, বাড়ির সব থেকে বৃদ্ধ ভট্টাচার্য দাদুর। ছোটবেলায় শুনেছি, ওঁর বাড়ি বরিশালে ছিলে, জ্যাঠামহাশয় কীভাবে যেন ওঁকে পেয়েছিলেন। তারপরে নিজে চিকিত্সা করে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। উনি অবশ্য বেশিদিন বেঁচেছিলেন না। বড় হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি, বরিশালের বড় দাঙ্গায়, যে দাঙ্গার পরে পাকিস্তানের সমর্থক যোগেন্দ্র মণ্ডলও পালিয়ে ভারত চলে যান- ওই দাঙ্গায় উনি সব হারিয়ে এমনকী স্মৃতিরও অনেকাংশ হারিয়ে, কীভাবে ঘুরতে ঘুরতে ইস্টিমারে উঠেছিলেন। সেখানে থেকেই জ্যাঠামহাশয় তাঁকে নিয়ে আসেন। যাহোক, তাঁর ছিল রূপকথা বলার এক অসাধারণ ক্ষমতা। এবং পরী থেকে শুরু করে ভূত ও দেবতা সবই তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। আর সেই সব “তাঁর মতে বাস্তবকাহিনী” এমনভাবে বলতেন, একা হলেও ঘন হয়ে তাঁর শরীরের কাছে চেপে বসতাম।
কিন্তু এভাবে গল্পশুনেও আর কতদিন পাঁচিলের মধ্যে থাকা যায়! দোপাটি ফুলগুলো বাগান ভরে বর্ষায় ফুটছে, তার ওপর বর্ষার জল পড়ছে, তাও একঘেঁয়েমি হয়ে যেতে থাকে। গোলাঘরগুলোর চড়ুই আর পায়রার ডাকও একঘেঁয়েমি মনে হতে থাকে।
ওই বছর দাঙ্গা ও রিফিউজি কী, তা কিছুই বুঝিনি, যেটুকু শুধু বুঝেছিলাম, এবার বাড়িতে শুধু নয়, আশেপাশেও কোথাও দুর্গা পূজা হবে না।
মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন দুর্গা পূজা হবে না? মা বলেছিলেন, এবার অনেক বেশি বৃষ্টি, তাই আত্মীয়-স্বজনরা কেউ আসতে পারবেন না এজন্য পূজা হবে না। এখন বুঝি একটি নির্মম রাষ্ট্র, একটি অসহনীয় সমাজ ভদ্র ঘরের একজন মাকেও তাঁর সন্তানের সঙ্গে মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য করে। মা হয়ে সন্তানের সঙ্গে মিথ্যে বলা কত কষ্ট, কতটা অসহনীয় এটুকু মনে হলে মনে হয়- দূর হয়ে যাক এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
এ সময়ে একদিন রাতে বাড়ির কুকুরগুলো বেশ হৈ চৈ বাধিয়ে দিলে। মা অবশ্য বিছানা থেকে উঠতে দেয়নি। পরদিন সকালে শুনলাম বেশ দূরের অনেক মানুষ- যারা বাবা ও জ্যাঠামহাশয়দের পরিচিত, তারা নাকি তাদের সব কিছু ফেলে রিফিউজি হয়ে চলে যাচ্ছে।
সেদিন সেজ জ্যাঠামহাশয়ের কাছে গিয়েছিলাম রিফিউজি কী, তা বুঝতে। জ্যাঠামহাশয় তার তাকিয়াতে হেলান দিয়ে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে সহজ ভাষায় রিফিউজি কী তা বোঝানোর যে খুব চেষ্টা করেছিলেন, তা বলব না? আর কী বলেছিলেন, তা-ও আমার মনে নেই। তবে আমার শুধু এটুকু মনে আছে, জ্যাঠামহাশয়কে আমি বলেছিলাম, ওরা ওদের বিড়ালগুলো নিয়ে যাচ্ছে তো?
বিড়াল কুকুরগুলোর কী অবস্থা হয় তা জেনেছিলাম ১৯৭১ -এ এসে। ১৯৭২ এ দেশে ফিরে দেখি কয়েকটি কুকুর ভেঙ্গে ফেলা বাড়ির ইটের ওপর এক বর্ষায় যে ঘাস জমেছে তার ওপর শুয়ে আছে। তাদের সেই সুন্দর স্বাস্থ্য আর নেই। যাহোক আর যা জেনেছিলাম, সেজ জ্যাঠামহাশয়ের কাছে যে দাঙ্গা হচ্ছে। বোকার মতো এই কথা বড় জ্যাঠামহাশয়কে বলতেই তিনি সেজ জ্যাঠামহাশয়কে ডেকে বলেন, কেন তিনি আমাকে এই সব দাঙ্গার কথা বলতে গেলেন। সেজ জ্যাঠামহাশয় হয়তো বড় জ্যাঠামহাশয়কে বলেছিলেন, দাঙ্গা কি তা বোঝার বয়স আমার হয়নি।
আসলে ওই বছর দাঙ্গা ও রিফিউজি কি তা কিছুই বুঝিনি, যেটুকু শুধু বুঝেছিলাম, এবার বাড়িতে শুধু নয়, আশে পাশেও কোথাও দুর্গা পূজা হবে না।
মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন দুর্গা পূজা হবে না? মা বলেছিলেন, এবার অনেক বেশি বৃষ্টি, তাই আত্মীয়-স্বজনরা কেউ আসতে পারবেন না এজন্য পূজা হবে না। এখন বুঝি একটি নির্মম রাষ্ট্র, একটি অসহনীয় সমাজ ভদ্র ঘরের একজন মাকেও তাঁর সন্তানের সঙ্গে মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য করে। মা হয়ে সন্তানের সঙ্গে মিথ্যে বলা কত কষ্ট, কতটা অসহনীয় এটুকু মনে হলে মনে হয়- দূর হয়ে যাক এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
না হয় কবি দাউদ হায়দারের কবিতার লাইনটিই সত্য, “জন্মই আমার আজন্মের পাপ”। মানুষ হয়ে যদি জন্মালাম তাহলে কেন এদেশে জন্মালাম। কেন বড় হয়ে পড়লাম, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ আবার সান্ত্বনা পাই, তবু তো আফগানিস্তান বা ইথোপিয়ায় জন্মায়নি। এখনও আমার দেশে শুধু সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বাদ যায়, আফগানিস্তানের মতো মেয়েদের লেখা বই তো বাদ যায় না। এটুকুও কি যথেষ্ট নয়? তাছাড়া যে দেশে মিডল ক্লাস থাকে না। সেকেন্ড জেনারেশন সব সময় চলে যায়। যে দেশ সব সময়ই ফাস্ট জেনারেশন দিয়েই শাসিত হয়- সে দেশে এর থেকে আর কী বেশি আশা করা যায়!
মায়ের কাছে যখন শুনলাম পূজা হবে না। তখন মনে মনে ওই চিন্তা করার বয়স হয়নি যে, পূজা হবে না তাহলে দিদিরা কেন স্কুল কলেজে যাবে না?
এর কয়েকদিন পরে আবার দেখলাম, সেজ জ্যাঠামহাশয় ও পুরোহিত ঠাকুরর্দা মিলে একটি পূজার ফর্দ করছেন। ওই ফর্দ শোনার দিকে মন না দিয়ে সোজা দৌঁড়ে চলে এলাম মায়ের কাছে। মা পূজা হবে না তা পূজার ফর্দ হচ্ছে কেন?
মা মাথায় হাত দিয়ে বললেন, পূজা তো আর বাদ দেওয়া যায় না, ঘট পূজা হবে। ঠিক মনে করতে পারি না, তবে যেন ঝাপসা একটা স্মৃতি মনে আসে ওইটুকু বলে, মা তার আঁচলটা একটু চোখের কোণায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
সেবার সম্ভবত দেবী নৌকায় এসেছিলেন, নইলে অত বৃষ্টি হবে কেন? সেই মুষলধারের বৃষ্টির মাঝে মা, জ্যাঠাইমা, কাকীমারা গরদের শাড়ি পরেন, আমরা নতুন কাপড় পরে বাড়ির পূজামণ্ডপে তিনদিনই বার বার গিয়েছিলাম। অঞ্জলি দিয়েছিলাম। না, বাড়ির মানুষ আর পাড়ার মানুষ ছাড়া কোন আত্মীয় স্বজন আসেনি। সবাই কেমন নীরব ছিল সে বছর।
এরপরে আবার রাষ্ট্রের নাম বদলেছে, পতাকা বদলেছে। আমারও বয়স বদলাতে বদলাতে এখন শুধুই কমছে। এই সময়ে এসে আরেক রকম ঘট পূজা করতে হচ্ছে। একদিকে প্রতিদিনই প্রায় প্রতিমা ভাঙা হচ্ছে। আবার বেশি করে প্রতিমা তৈরি ও বেশি সংখ্যক পূজা না করলে হত্যা মামলার আসামি হতে পারে যে কোন সময়ে। তাই দুই হাতে প্রতিমা গড়ার হিড়িক আর ভাঙারও মহোত্সব। এমনকী বাতাসেও প্রতিমা ভাঙছে।
পূজা মানে ভাগ্নে, ভাগ্নি আসবে। পূজা মানে দিদি আসবেন। পূজা মানে ছোট ঠাকুরদা আসবেন কলকাতা থেকে, ছোট মামা আসবেন নৈনিতাল থেকে, পিসি আসবেন বরিশাল থেকে- এই তো পূজা। না, সে সব কিছুই ছিল না সেবার।
দুর্গার প্রতিমা ছাড়া, গণেশের ইঁদুর ছাড়া যে পূজা হয় সেই প্রথম দেখলাম। অনেক শিশুবেলায়। এখন বড় হয়ে মনে হয় সংখ্যালঘু জীবন সব দেশে কত নির্মম! একটি শিশুকেও সহ্য করতে হয় এই নীরব মানসিক নির্যাতন। তাকে বঞ্চিত হতে হয় তার বয়সের আনন্দ থেকে। সমবয়সী ভাগ্নি এলে তার হাত ধরে দৌঁড়ে দীঘির ঘাটে গিয়ে রমাকাকাকে ডেকে একটা ডাঁসা পেয়ারা পেড়ে দিতে বলার আনন্দ, আর ভাগ্নিও বলবে, বুবাই মামা তুমি কি একা এই দীঘির ঘাটে আসতে পারো, দক্ষিণ পাড়ের ওই জঙ্গলে বাঘ নেই তো? মামা তখন বীরের মতো বলবে, বাঘের আমি ভয় পাইনে। লাঠি থাকে হাতে।
জীবনের কোন যশ, কোন খ্যাতি, কোন সাফল্য মানুষকে এই আনন্দ ফিরিয়ে দিতে পারে কি?
এরপরে আবার রাষ্ট্রের নাম বদলেছে, পতাকা বদলেছে। আমারও বয়স বদলাতে বদলাতে এখন শুধুই কমছে। এই সময়ে এসে আরেক রকম ঘট পূজা করতে হচ্ছে। একদিকে প্রতিদিনই প্রায় প্রতিমা ভাঙা হচ্ছে। আবার বেশি করে প্রতিমা তৈরি ও বেশি সংখ্যক পূজা না করলে হত্যা মামলার আসামি হতে পারে যে কোন সময়ে। তাই দুই হাতে প্রতিমা গড়ার হিড়িক আর ভাঙারও মহোত্সব। এমনকী বাতাসেও প্রতিমা ভাঙছে। হায়রে বাতাস! এত জায়গা, এত কাজ রেখে তুই কিনা ঢুকে যাস শুধু মন্দিরে প্রতিমা ভাঙতে।
আর এই প্রতিমা গড়া ও ভাঙার বাইরে হয়তো একটা পূজা হবে বাইরে। নতুন পাঞ্জাবী পরতে মন চাইবে কিনা তাও কেউ জানে না। শাড়ি কেনেনি এখনও কেউ বাড়িতে।
অর্থাত্ শিশু কাল থেকে এতটা পথ পেরিয়ে এসে এখন পেলাম আরেক পূজা- যাকে বলা যেতে পারে বাইরে প্রতিমা পূজা ভেতরে ঘট পূজা। রাষ্ট্র নির্মম কিনা বলা যাবে না, তবে এই ঘটের ভার অনেক বেশি- বুকে নিরন্তর বয়ে নিয়ে চলা যেন এক পাথর।