Bengali story

ভীষ্মপতন

একচল্লিশ বছর বয়সে, একদিন সকালবেলায় ঘুম ভেঙে উঠে নির্মাল্য হঠাৎ বুঝতে পারলেন তাঁর বানপ্রস্থ নেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। এতে দুঃখের কিছু নেই- সকলকেই একদিন কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিতে হয়।হয় স্বেচ্ছায়, নয়তো জরা বা মৃত্যু একদিন ঘাড় ধরে নামিয়ে দেয় রঙ্গমঞ্চ থেকে।কিন্তু সেক্ষেত্রে একটা মুশকিল ঘটে- শেষ দিককার অভিনয়ে বড্ডো প্রকট হয় পড়ে সেই জরার চিহ্ন।মঞ্চের মেঝেতে কান পাতলে পাওয়া যায় বিলীয়মান জীবনের পদধ্বনি। 

তার চেয়ে এই ভালো! অপার বিস্ময় থাকবে সকলের।অন্তহীন কৌতূহলে দীর্ণ হবে ভক্তকূল।কত মানুষ ফোন করে অনুরোধ জানাবে ফেরবার।উপরোধ করে করে হার মানবে পরিবার।এই ভালো।খ্যাতির মধ্যগগনে আচম্বিতে বিদায়।নাটক ভাঙলেও তার রেশটুকু মিলোবে না। শেষ হয়েও শেষ হবে না এ অধ্যায়।এই ভালো!

নির্মাল্য বসু বর্তমান বাংলাসাহিত্যের একজন প্রখ্যাত লেখক।গত পুজোতেও বিভিন্ন নামী পত্রপত্রিকায় তাঁর তিনখানা গল্প বেরিয়েছে।সঙ্গে দুটো কবিতা আর একটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস।সামনের বইমেলায় তাঁর ‘ত্রস্ত তিস্তা’ সম্ভবত পুরস্কৃত হবে। প্রকাশিত হবে ‘সংগ্রামের ইতিবৃত্ত’ আর ‘বৃষ্টিমানুষ’। প্রতিদিনই ফেসবুকে তাঁর ওয়াল ভরে ওঠে প্রশংসাবাক্যে। চিঠিও বড়ো একটা কম সঞ্চিত হয়নি। ঝুলিতে ঢুকেছে -সারস্বত, কাব্যবিচরণ, অনিন্দ্য-কলম প্রভৃতি বহু পুরস্কার।  বিদায় নেওয়ার এর চাইতে ভালো সময় আর হয় না।  

নির্মাল্য হিসেবে করে দেখলেন আগামী এপ্রিলে তাঁর লেখক জীবন পঁচিশ বছরে পড়বে। ষোলো বছর বয়স থেকে লিখছেন,শুরু হয়েছিল তারার-মেলায় ‘ধনেশ পাখির ঠোঁট’ বলে একটা গল্প দিয়ে। তারপর আর ফিরে তাকাতে  হয়নি।একের পর এক লেখা প্রকাশ, একের পর এক সোপান আরোহণ, আলো-আঁধার পত্রিকার কর্ণধার হিসেবে যোগদান, ক্রমে, এই ৪১ বছর বয়সেই,বাংলা সাহিত্য জগতের ফাল্গুনী হয়ে ওঠা।বহু লেখকই এ বয়সে বা এর পরে লেখা শুরু করেন।তার থেকেও বেশি সংখ্যক কলমের এ বয়সটা কৈশোরকাল। 

ঘড়িতে ৭টা।নির্মাল্য বাবু বিছানা থেকে উঠে জানলাটা খুলে দিলেন।পাশের বিছানা খালি।রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।সুতৃষ্ণা চিরকালই খুব ভোরে ওঠে।আর ঠিক ১৫ মিনিট পরেই ঘরে ঢুকবে চায়ের পেয়ালা হাতে। রাজা স্কুলে চলে গেছে।তিতলি সম্ভবত তার ঠাকুমার কাছে স্নান করছে এখন।বাবা নিশ্চয়ই এখনো ওঠেননি। রিটায়ার করবার পর থেকেই বাবা ৯টা পর্যন্ত বিছানায় থাকেন।ওই, বাইরে বেল বাজলো।পাপু ফিরলো দুধ নিয়ে। মলিনার মাও নিশ্চই তাঁর লেখার টেবিল গুছিয়ে ফিটফাট করে রাখতে ব্যস্ত এখন। 

সংসার চলছে অভ্যস্ত ছন্দে।চলবেও।এখনও কেউ জানে না, নির্মাল্য বাবু লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।এ বাড়ির গৌরব নির্মাল্য বসু আর কোনোদিন লিখতে বসবেন না।।

নির্মাল্য কি ফুরিয়ে গেছেন? একজন লেখকের মৃত্যু ঘটে সেদিন, যেদিন তার আর নতুন করে কিচ্ছু বলার থাকে না।নির্মাল্য বাবুর অবস্থাটা একেবারেই সেরকম নয়।বরঞ্চ যা যা লিখবেন ভেবে কলম ধরেছিলেন একদিন, তার অধিকাংশই আজও অজাতক!

কলেজের সেই শ্যামলা মেয়েটা-যার জন্য প্রথম কবিতা লেখা- আর যার জন্য প্রথম রাত জাগা, যার জন্য ভেবেছিলেন লিখে রেখে যাবেন ভারতবর্ষের তৃতীয় মহাকাব্যখানা- তাকে কোনোদিন কিছু বলতে পারেননি মুখ ফুটে! সে আসবে জেনে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকেছেন প্রবল বৃষ্টিতে, শেষরাতে উঠে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আগেভাগে রেখে এসেছেন ক্লাসে তার নির্দিষ্ট ডেস্কে, তাকে বলেছেন কত কথা- শুধু সেই কথাটা বলতে পারেননি।ভেবেছিলেন সে বইখানা লিখে একদিন পাঠিয়ে দেবেন তার ঠিকানায়।এই বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডে সেই বইখানার অর্থ বুঝবে কেবল দুজন- সে বইখানার প্রথম পাতার প্রথম শব্দটাও লেখা হয়নি আজও। 

মেজপিসীর মুখাগ্নি করতে করতে ভেবেছিলেন, “আমার লেখায় তোমাকে আমি অমরত্ব দেব!”

সেই মেজপিসী।নিঃসন্তান।বাল্যবিধবা। রক্ত আমাশাতে যখন নির্মাল্য মরমর, বমির গন্ধে ঘরে ঢুকতে মাও দরজার কাছে ইতস্তত করেন একবার, তখন দু’হাতে কাঁচিয়ে সেই পায়খানা পরিষ্কার করতেন। সেই মেজপিসী- প্রায় প্রৌঢ় বয়সে পাপু হওয়ার পর মা যখন শয্যা নিলেন, দীর্ঘ তিন বছর এ বাড়িতে থেকে আগলে রেখেছিলেন নির্মাল্যকে- মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক।পাপুকেও মানুষ করেছেন বুকে করে। সেই মেজপিসী- যার চেয়ে বেশি ভালো এ সংসারে নির্মাল্যকে আর কেউ বাসেনি কক্ষনো। 

কোথায় সে বই? দশ বছর কেটে গেছে। মেজপিসীর মুখটা আর মনে পড়েনা! ঝাপসা হয়েছে কণ্ঠস্বরের স্মৃতিও! কিন্তু কোথায় সে বই?আজও তো তার একটা লাইনও লেখা হয়নি!

কোনও অভ্যেসই অনন্তকাল থাকে না- অভ্যেস জিনিসটা যেন কেমন একটা উল্টো জন্মান্তরের মতন- মানুষের এক অভ্যেস চলে গেলে, সে একই শরীরে জন্ম নেয় নতুন কোন অভ্যেস। এই যেমন বিকেলের কবিতার অবসর এখন কাটে রাজা তিতলিকে পড়াতে বা লাইব্রেরির আড্ডায়। তখন সারা সকাল কাটতো লেখবার টেবিলে পেন চিবিয়ে-এখন সে সময়টা, মায় বিকেলগুলোও যায় আলো-আঁধারের অফিস ঘরে।

লেখা হয়নি বরদাচরণ ইস্কুলের কথা, ঠ্যাং ভাঙা নালুয়ার কথা, ভুদো বেড়াল আর চিকু কাঠবেড়ালির কথা, পাপুকে মা’র বেশি ভালবাসবার কথা, শর্মিলার পাপুকে ঠকাবার কথা, সুতৃষ্ণার মুখের রেখায় রেখায় ফুটে ওঠা নিঃশব্দ অপ্রাপ্তির কথা! না হোকগে। পঁচিশ বছর তো লিখেছেন- তবু হয়নি! আগামী আরো পঁচিশ বছর লিখলেও যে ওসব কথা লেখা হবে তার স্থিরতা নেই কোন। 

তাছাড়া পৃথিবীতে ব্যর্থ একতরফা প্রেমের উপন্যাস লেখা হয়েছে কয়েক লক্ষ। পূর্বপুরুষ, বঞ্চনা, মনকেমন বা অপ্রাপ্তি নিয়ে তিনিই অন্তত লিখেছেন কয়েক ডজন গল্প।এসবে আর নতুনত্ব নেই কোনও। জগৎ সংসারকে আর নতুন কোন কথা শোনাবার নেই তাঁর। এরপর লিখলে তা হবে- বাজে পুনরাবৃত্তি বা একটু ভিন্ন ভাবে একই প্লটের চর্বিতচর্বন। 

অতএব বানপ্রস্থ। 

খ্যাতির মধ্যগগনে, ক্ষমতার শিখরে, সকলকে বিস্মিত করে অকস্মাৎ অন্তরালে গমন। 

এই ভালো।।  

তিন বছর কেটে গেছে। লেখা জিনিসটা একেবারে ছেড়ে দেওয়া যে কঠিন হবে জানতেন তবে এতটা কঠিন হবে- নির্মাল্য ভাবেননি কখনো।প্রথম প্রথম হাত নিশপিশ করতো।ঘুম থেকে উঠেই মনে সংশয় জাগতো- গতরাত্রের অর্ধসমাপ্ত গল্প বা উপন্যাস কিছু পড়ে আছে কিনা!তারপর ক্রমে ক্রমে অভ্যেস হয়ে গেছে।কোনও অভ্যেসই অনন্তকাল থাকে না- অভ্যেস জিনিসটা যেন কেমন একটা উল্টো জন্মান্তরের মতন- মানুষের এক অভ্যেস চলে গেলে, সে একই শরীরে জন্ম নেয় নতুন কোন অভ্যেস। এই যেমন বিকেলের কবিতার অবসর এখন কাটে রাজা তিতলিকে পড়াতে বা লাইব্রেরির আড্ডায়। তখন সারা সকাল কাটতো লেখবার টেবিলে পেন চিবিয়ে-এখন সে সময়টা, মায় বিকেলগুলোও যায় আলো-আঁধারের অফিস ঘরে। 

অলকেন্দু আর শ্রবণা বলে দুটি ছেলেমেয়ে বড়ো ভালো লিখছে আজকাল।বিশেষ করে শ্রবণা- ওর লেখায় যেন প্রথম জীবনের নিজেকে দেখতে পান তিনি।নবীন লেখকদের লেখা আজকাল স্বহস্তে নির্বাচন করেন নির্মাল্য।ফলে, গত তিন বছরে আলো-আঁধার প্রভূত উন্নতি করেছে।গ্রাহক সংখ্যাও বেড়েছে বেশ কয়েকগুণ। 

আপাতত ভালোই আছেন।পড়াশোনাটা ছাড়েননি।‘ধনেশ পাখির ঠোঁট’ পড়ে বাংলার স্যার দিব্যেন্দুবাবু পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন- “ভালো লিখতে গেলে কিন্তু পড়তেও হবে প্রচুর।” নিচের লাইব্রেরি ঘরে মধ্যরাত অবধি বই পড়েন নির্মাল্য। দেশবিদেশের কত কালজয়ী সাহিত্য যে না পড়া ছিল- এখনো আছে। পড়তে পড়তে বুঝতে পারেন যে তাঁর সিদ্ধান্ত একশো শতাংশ সঠিক।নতুন কিছু আর নতুনভাবে বলবার নেই তাঁর।এ পৃথিবীর সমস্ত কথা বলা হয়ে গেছে। 

তবু ভালো লাগে বেশ! অর্ধেক জীবন তো লেখক হিসেবে কাটলো, বাকি অর্ধেকটা নাহয় পাঠক হয়েই কাটবে-   

এ দেশে লেখক আর সিনেমা পরিচালক হওয়ার খ্যাতির ধরনে তফাৎ আছে। সিনেমাস্টার নিজের বাড়িতে বাসন মাজলে হেডলাইন হয়, লেখকের কর্মাবসান দূরে থাক- জীবনাবসান হওয়ার খবরও সবসময় ঠাঁই পায় না খবরের কাগজে। তবু নির্মাল্য বসুর কলমের অন্তর্ধান সাহিত্যজগতে কম আলোড়ন সৃষ্টি করেনি।ঠিক যতটা আশা করেছিলেন- ততটাই অনুরোধ করেছিল বন্ধুকুল।বিরক্ত করে মেরেছিলো ভক্তরা।সুতৃষ্ণা তো ব্যস্ত হয়ে তাঁর কাউন্সেলিং অবধি করাতে চেয়েছিলো।আপাতত আবার সব নিস্তরঙ্গ।নতুন অভ্যেস গ্রাস করেছে ওদেরকেও। 

নতুনত্ব ঘটেছে আরও একটা বিষয়ে-

শ্রবণার সঙ্গে সম্পর্কটা কীভাবে শুরু হয়েছিল, স্পষ্ট মনে আছে নির্মাল্যর। আলো-আঁধার-এর দপ্তরে এসেছিল শ্রবণা। নির্মাল্যই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।ওর একটা কবিতা একটু অতিরিক্ত দীর্ঘ মনে হয়েছিল তাঁর।বলেছিলেন সেকথা।  বলেছিলেন, “এই পঙক্তিটা বাদ দিলেও কবিতাটার ক্ষতি হচ্ছেনা তেমন, তাই না? তাছাড়া, এই জায়গাটায়,নয়নের বদলে আঁখিটা মনে হয়ে বেশি যাবে দেখো।  গদ্য কবিতা তো- ছন্দের ঝামেলা নেই-নয়নটা কেমন যেন গ্রাম্য শোনাচ্ছে।”

শ্রবণা চুপ করে শুনেছিলো পুরোটা। তারপর ওর ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো মেলে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি লেখা ছেড়ে দিয়েছেন কেন?” নির্মাল্য জবাব দেননি।একটু হেসেছিলেন শুধু।শ্রবণা মৃদু অথচ স্পষ্ট গলায় বলেছিল, “আমি খুবই নগণ্য, জানেন! আপনার সিকির সিকিভাগ জায়গাতেও যদি কোনোদিন পৌঁছতে পারি, নিজেকে ধন্য মনে করবো।কিন্তু সরি! দিনের শেষে আমার লেখাটা আমারই লেখা।সেখানে চোখ বোঝাতে আঁখি ব্যবহৃত হবে না নয়ন, সেটা একান্তভাবেই আমার বিচার্য্য। আপনার পছন্দ না হলে ছাপবেন না।আমি বরং আবার পরবর্তী সংখ্যার জন্য চেষ্টা করবো, কেমন?”

নির্মাল্য লেখাটা ছেপেছিলেন।নয়ন দিয়েই ছেপেছিলেন।শ্রবণার ওই ছেলেমানুষীটুকু বড্ডো ভালো লেগেছিলো তাঁর।  দার্ঢ্যটুকুও।

শ্রবণার লেখা নির্মাল্য রাত জেগে লুকিয়ে পড়েন। শ্রবণা যেদিন বাড়িতে এসেছিলো- শ্রবণা নিজে ছিল সহজ,সাবলীল; মা-বাবাকে প্রণাম করলো, সুতৃষ্ণা আর পাপুকে উপহার দিলো ওর কবিতার বই, রাজা তিতলিকে খানিক আদর করলো উসখুম-খুসকুম।ও চলে যাওয়ার পর সুতৃষ্ণা আপ্লূত গলায়  বললো-“মেয়েটাকে বাড়িতে  আনোনি কেন এতদিন? এতো ভালো একটা মেয়ে!”

শ্রবণারও নিশ্চই ভালো লেগেছিলো তাঁকে। তেতাল্লিশ বছরের প্রৌঢ়, বিরলকেশ আর ঈষৎ ভুঁড়িওয়ালা ভূতপূর্ব কোনও লেখককে যতটা ভালোলাগা সম্ভব-

শ্রবণা তাঁকে এস-এম-এস পাঠাতো। প্রথমে মাঝেমধ্যে, তারপর প্রতি রাতেই।একটামাত্র এস-এম-এস।একটা কবিতার লাইন। প্রতিরাতে লাইব্রেরির ঘড়িতে ১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে চোখ চলে যায় মোবাইলে-পর্দায় ভেসে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বা অন্য কোনও কবি।এক লাইন।কোনোদিন উত্তর দেননি নির্মাল্য।কেমন যেন মনে হত উত্তর দিলে ভারী সুন্দর একটা জিনিস অপবিত্র হয়ে যাবে।পরদিন ও এস-এম-এস আর আসবে না।।    

শ্রবণা কি তাঁর প্রেমিকা?

শ্রবণার সঙ্গে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছেন।ওর বালিকাসদৃশ মুখ দেখে মায়ায় ছেয়ে গেছে বুক।তিতলির অংক ভুল করে ঠোঁট ফোলানো দেখে মনে পড়েছে কোন লেখা মনোনীত না হবার পর শ্রবণার মুখের ভঙ্গিমা। আলো-আঁধার-এর বসন্ত সংখ্যার জন্য পৌষমেলা গিয়ে একসঙ্গে কাটিয়ে এসেছেন দুটো গোটা রাত।কখনও ওর হাতটুকুও স্পর্শ করেননি। 

শ্রবণা কি তাঁর অনুজা?

আহিরীটোলা ঘাটে শ্রবণার শ্যাম্পু করা চুলের গন্ধ তাঁকে মাতাল করে দিয়েছে।মধ্যরাতে ঘুমভেঙ্গে মনে পড়েছে শ্রবণার গলায় আবৃত্তি-“রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে 

তারে আমি পাই নাই;

কোনো এক মানুষীর মনে কোনো এক মানুষের তরে

যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে-

-নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে

কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।”

তারপর আর বাকিরাত ঘুম আসেনি নির্মাল্যর।

শ্রবণা কি তাঁর বন্ধু কেবল ?

শ্রবণার লেখা নির্মাল্য রাত জেগে লুকিয়ে পড়েন। শ্রবণা যেদিন বাড়িতে এসেছিলো- শ্রবণা নিজে ছিল সহজ,সাবলীল; মা-বাবাকে প্রণাম করলো, সুতৃষ্ণা আর পাপুকে উপহার দিলো ওর কবিতার বই, রাজা তিতলিকে খানিক আদর করলো উসখুম-খুসকুম।ও চলে যাওয়ার পর সুতৃষ্ণা আপ্লূত গলায়  বললো-“মেয়েটাকে বাড়িতে  আনোনি কেন এতদিন? এতো ভালো একটা মেয়ে!”

নির্মাল্যর কেন তখন নিজেকে পাপী বলে মনে হচ্ছিলো? কেন সুতৃষ্ণার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না নির্মাল্য? ব্যাখ্যাতীত এ কেমন সম্পর্কের নাগপাশে প্রতিনিয়ত আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাচ্ছেন তিনি?

শ্রবণাও বহু চেষ্টা করেছে তাঁকে দিয়ে আবার লেখাবার।ও কথাটা তিনি রাখেননি।বলেছেন, “লিখলে একমাত্র তোমার কথাতেই লিখতাম আবার।কিন্তু ও আর হয় না।” ও কথাটা বোধহয় শ্রবণার একমাত্র কথা যেটা তিনি রাখেননি। রাখতে পারেননি। 

জ্ঞানতঃ কারো সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেননি নির্মাল্য।পিতার কর্তব্য, পুত্রের কর্তব্য, বড়ো ভাইয়ের কর্তব্য, সমাজের কাছে নিজের কর্তব্য সমাপন করেছেন নিরলস নিষ্ঠায়।সুতৃষ্ণাকে তিনি ভালোবাসেন।শুধু চোখের মোহ নয়, শুধু শরীরী আকর্ষণ নয়, শুধু নরনারীর জৈবিক সম্পর্ক নয়, বিবাহ নামক অভ্যাস নয় কেবল; সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন।

তারপরেও, সমস্ত কিছুর পরেও, শ্রবণার সমস্ত কিছু ভালো লাগে। বড্ডো ভালো লাগে।সবচেয়ে আশ্চর্য ওর চোখদুটো।অমন নিকষ কালো টানাটানা নিটোল জোড়া ভুরু আর কখনোও দেখেননি নির্মাল্য।তার তলায় দুখানি অতলান্ত সমুদ্রের মতন চোখ। শ্রবণার মুখ, শ্রবণার স্বর, শ্রবণার ভঙ্গিমা, শ্রবণার সাহিত্য ঘুমে-জাগরণে অনুক্ষণ– অবিরত জেগে থাকে সমস্ত সত্তায়। শ্রবণাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব হবে না।চুয়াল্লিশ বছর বয়স এসব ছেলেমানুষি থেকে মুক্তি দেয় মানুষকে- বুঝিয়ে দেয় কেউই অপরিহার্য নয়। তবু শ্রবণা কোনোদিন যদি না থাকে  জীবনে- সে কল্পনাটা দুষ্কর বৈকি।

তবে সেদিন আসবে একদিন!এও নিশ্চিত জানেন নির্মাল্য।শ্রবণার যা প্রতিভা- ও নিশ্চই আরো বড়ো হবে, আরো নামডাক হবে ওর, বিদেশের বঙ্গসম্মেলনে যাবে, বিয়েও করবে একদিন- চুয়াল্লিশ বছরের বয়স্থ কোনো পুরুষের জন্য নিশ্চই জীবন যৌবন ব্যয় করবে না। সেটা কাম্যও নয় কোনভাবে। 

কষ্ট হবে।তবু মেনে নিতে হবে। নীরবে সরেও যেতে হবে। আরো একবার নিজেকে বলতে হবে– এই ভালো। বিদায় নেওয়ার এইতো উপযুক্ত সময়।ও প্রতিজ্ঞাটাও রাখবেন তিনি।ভাঙা বেড়া বাঁধার চেষ্টা করবেন না কোনোদিনই।জপ করবেন- এই ভালো।এই ভালো।|

তবে আপাতত সেসব ভেবে লাভ নেই।এখন যে মুহূর্ত বহমান- সেটাই সত্যি। ভবিষ্যতের ভাবনায় ক্লিষ্ট হয়ে সেটাকে নষ্ট করবার মানে হয় না কোনও। আপাতত শ্রবণার বইয়ের খসড়াটার প্রফ কারেকশন করতে বসাই বুদ্ধিমানের কাজ!

খবরটা এলো সকালবেলায়! সামনের সপ্তাহেই পুজোসংখ্যা বেরোবে।  আলো-আঁধার-এর অফিসে গতকাল রাত্রেও প্রায় দেড়টা অবধি কাজ করতে হয়েছে।সকালে একটু বেলা হয়ে গিয়েছিল ঘুম ভাঙতে- বাস্তবিক ঘুম ভাঙেনি; বলা ভালো, সুতৃষ্ণা আলুথালু বেশে তাঁকে ডেকে তুলেছিল।বাসি মুখেই শার্ট প্যান্ট গলিয়ে, সুতৃষ্ণাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে বেরিয়ে পড়েছিলেন নির্মাল্য। 

হাসপাতালে একটা কাঁচের ঘরে একা শুয়ে আছে শ্রবণা।গায়ের ওপর একটা টেবিল মতো দিয়ে উঁচু করে দেওয়া।  তার ওপর সাদা চাদর ঢাকা। কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।উদীয়মান লেখিকার এহেন দুর্ঘটনার খবরে প্রায় সমস্ত বইপাড়া ভেঙে পড়েছে হাসপাতালের করিডোরে। আজ সকালে রান্নাঘরে চা করতে গিয়ে, শাড়িতে আগুন লেগে দেহের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে শ্রবণার।ডাক্তারের কথায়- ‘চান্স অফ সারভাইভাল টেন পার্সেন্ট।এরপর বাকিটা ভগবানকে ডাকুন!’

নির্মাল্যকে দেখে ভিড়টা একটু পাতলা হল।পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে কাঁচের জানলায় চোখ রাখলেন তিনি। 

ও কে? কে ওটা? ও শ্রবণা হতেই পারেনা!কক্ষনো না! ও কি কোন মানুষ আদৌ না পিশাচী?গায়ে চামড়ার লেশমাত্র নেই। মুখে-নাকে অক্সিজেনের নল।যতটুকু দেখা যায় কেবল টকটকে লাল মাংসপিন্ড।ওর যে কোনওদিন অমন ভুরু ছিল, কান ছিল, নাক ছিল, কেউ আর বিশ্বাস করবে না কখনও।যেখানে চোখদুটো থাকবার কথা- সেখানে এখন কোনও গলিত পদার্থে ভরা দুখানা অতলান্ত গহ্বর। 

পাশে সুতৃষ্ণা অঝোরে কাঁদছে।কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে ওর সমস্ত দেহটা।কোলাহলে মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। 

নির্মাল্যর সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেমন! এ কেমন বোধ হচ্ছে তাঁর? ভয় করছে কি? আতঙ্ক? তাও তো নয় পুরোপুরি। দুঃখ নেই, হাহাকার নেই, শ্রবণার এমন অবস্থাতেও কোন যন্ত্রনায় মথিত হচ্ছে না হৃদয়। কেবল মনে হচ্ছে আর এক মুহূর্তও এ দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব নয় ওঁর পক্ষে।পালাতে হবে!এক্ষুনি পালাতে হবে!এ অনুভূতি কোনওদিন অনুভব করেননি তিনি! এ অনুভূতি তাঁর সম্পূর্ণ অচেনা!

অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে নির্মাল্য টের পেলেন-তাঁর একটা কাগজ কলম চাই! এক্ষুনি!

পুজো সংখ্যা আলো-আঁধার প্রকাশিত হয়েছে।এবারের বইমেলায় ‘সাহিত্যসম্রাট’ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে- সাহিত্যিক নির্মাল্য বসুর নতুন উপন্যাস-“চেনা মুখ- অচেনা হৃদয়।”