Felu Da

বাঙালির গোয়েন্দা গুরু

ফেলুদার অনেকগুণ। কাজের ক্ষেত্রে রয়েছে তার কঠিন ও জেদি মানসিকতা। ফেলুদা বলে, ‘হয় আমি এর বদলা নেব, নয় গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব।’ শার্লক হোমস তার গুরু। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ফেলুদা বলে, ‘গুরু তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি।’ ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দার্জিলিং, গ্যাংটক ছাড়িয়ে নেপাল, চিনে ছড়িয়ে পড়েছে। সাহিত্য শিল্পের প্রতি ফেলুদা বরাবর শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান। পড়াশোনা করা মানুষ। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে একটা অন্তর আছে, যেখানে স্নেহ-মমতা কানায় কানায় পূর্ণ। 

লালমোহন বাবুর গল্পের বিষয়বস্তুর নিয়ে ফেলুদার আপত্তি থাকলেও লালমোহনবাবুর প্রখর কল্পনাশক্তিকে সে সম্মান করত। নন্দলাল বসু যে কথা বলতেন, ফেলুদাও সেই একই কথা বলত। ব্যবসায়িক চিন্তায় শিল্প আসে না। ব্যবসায়িকরা শিল্পের আড়ালে নিজেদের মুনাফা অর্জন করতেই ব্যস্ত থাকে। ফেলুদা বলতো, ‘আর শিল্পটিল্প কিছু না। ওর আসল লোভ হচ্ছে টাকার। এখন খরচ করে জিনিস কিনছে,পরে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে পাঁচগুণ প্রফিট করবে।’ শিল্পটা সুনীতি ভাবনার প্রকাশ, ওটা আভিজাত্যের প্রদর্শনী হতে পারে না। ফেলুদা স্বাস্থ্য-সচেতন, তেমনই নিজের যোগ্যতা নিয়ে সজাগ। পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে চলতে পারে। অভিযোজন ক্ষমতা আছে তার। তার জেনারেল নলেজ ছিল চোখে পড়ার মতো। কারণ সে মনে করত, ‘কখন যে কোন জিনিসটা কাজে লেগে যায় তা বলা যায় না।’

ফেলুদার ডাক্তারি থেকে ইতিহাস, সাহিত্য, এমনকী সামাজিক খুঁটিনাটি বিষয়ে ভালই জ্ঞান ছিল। গ্যাংটকে গণ্ডগোল গল্পে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, ‘একদিন যদি আমরা এই রাস্তা দিয়ে যাই আমার বিশ্বাস ফেলুদার পর পর দোকানের নামই মুখস্থ হয়ে যাবে।’ ফেলুদা ভালোভাবে কোনও বিষয়ে মনোসংযোগ করতে পারত। অযথা ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করার মানুষ সে নয়। তার কাছে আড্ডা হবে প্রোডাক্টিভ, মুখেন মারিতং জগৎ নয়। সময়ের আগে চলতে পারত। সে অর্থে ফেলুদা আধুনিক। সে প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনষ্ক কিন্তু ভূত প্রেতে ফেলুদার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। 

তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে করা ফেলুদার মন্তব্য বেশ আকর্ষনীয়, ‘অনেক গুণী লোকই নাটুকে হয়, অভিনয় পছন্দ করে লোককে চমকে দিতে ভালোবাসে। এটা মানুষের অনেকগুলো স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে একটা।’ ফেলুদা মানুষের প্রবৃত্তির খবর রাখে।

শুধু সিগারেট খাওয়াটা ছাড়তে পারলো না। ওটা ছাড়তে পারলে তার কিশোর ভক্তদের কাছে একটা ইতিবাচক বার্তা যেতে পারত। তার কথার মধ্যে রয়েছে দর্শন। মানুষের মন পড়তে পারত। পারিপার্শ্বিক উপকরণের উপর ভিত্তি করে একটা ধারণা তৈরি করতে পারত, যা পরবর্তীকালে ঘটনার সামগ্রিকতা বিচারে সাহায্য করত। ফেলুদাকে চিনতে হলে তার সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। দূর থেকে তাকে দেখলে রাশভারী বলে মনে হতেই পারে। কৃতজ্ঞতা জানানো বা বড়দের সম্মান জানাতে সে কোনোদিন ভুলত না। একটা নির্দিষ্ট নীতির উপর জীবনটা দাঁড় করিয়েছিল ফেলুদা। নিজের কাজের উপর আস্থা ছিল ফেলুদার। সে জানে, সে যখন কোনও কাজ হাতে নিচ্ছে, তখন কোনও কিছু ভেবেই সেটাকে গ্রহণ করছে। কাউকে হতাশ করা বা, বোকার মত ঝাঁপিয়ে পড়ার লোক সে নয়। ফেলুদা যখন বলে, ‘কারণ না থাকলে কেউ কারো মৃত্যু কামনা করে না’, তখন আটপৌরে বাঙালির চেনা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ফ্রান্সিস বেকনের মত ফেলুদার বেশ কিছু খুঁতখুঁতে ব্যাপার ছিল। নিখুঁত হবার যাবতীয় চেষ্টা সে করত। 

তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে করা ফেলুদার মন্তব্য বেশ আকর্ষনীয়, ‘অনেক গুণী লোকই নাটুকে হয়, অভিনয় পছন্দ করে লোককে চমকে দিতে ভালোবাসে। এটা মানুষের অনেকগুলো স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে একটা।’ ফেলুদা মানুষের প্রবৃত্তির খবর রাখে। সে ফ্রয়েডকে পড়েছে। সে বাঙালির সময়জ্ঞানের অভাব নিয়ে চিন্তিত। দেশে অপরাধ বাড়ছে, দেশের সম্পদ বাইরে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে আর্থিক জালিয়াতি করে বিদেশে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়া একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে অপরাধীরা। ‘যত কান্ড কাঠমান্ডু’ গল্পে ফেলুদা বলছে, ‘খুন করে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে পারলে একটা মস্ত সুবিধা আছে।’ সময়ের বদল হয়েছে কিন্তু সমাজের বদল হয়নি। তাই ফেলুদার চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক।

চলমান বঙ্গজীবনে মোটিভেশন ট্যাবলেট হিসাবে দিনে একবার ফেলুদার বই পড়া দরকার! বর্তমানে কাজ যেমন নেই, কাজ করার মানসিকতাও নেই। কাজ করে অর্থ উপার্জন করার থেকে কাজ না করে অর্থ উপার্জন করাটাই এখন ট্রেন্ড হয়ে গেছে, সৌজন্যে রাজনীতি। ফলে মানবসম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অসুস্থ মেধার পাশে আতঙ্কের আর এক নাম কৃত্রিম মেধা।তাই ফেলুদার সেই তুখোড় মগজাস্ত্র ছাড়া এই ঘোর বিপদ থেকে মুক্তির পথ নেই।

সাফল্য বা ব্যর্থতা সবসময় নিজের উপর নির্ভর করে না। ফেলুদা সততার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। সে বলে, সততার সঙ্গে কাজ করবে। তাই পারিশ্রমিক নেবে। তবে তথ্য ভুল থাকলে সত্যের কাছে পৌঁছনো যাবে না। তাই তখন পারিশ্রমিক ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ফেলুদা বলে, ‘কেস সফল না হলেও সেটা ফেরত দেই না, কারণ সফল না হওয়াটা অনেক সময় গোয়েন্দাদের অক্ষমতার উপর নির্ভর করে না।’ পারিশ্রমিক নিয়ে কাজে ফাঁকি দেবার লোক ফেলুদা নয়। সে বলে, ‘ফ্র্যাকচার হোক আর যাই হোক, আমাকে বিছানায় শুইয়ে রাখতে পারবে না, এটা আগে থেকেই বলে দিলাম।’ 

কর্মসংস্কৃতির উপর জোর ছিল, সেটাও সততার সঙ্গে। বিভিন্ন বইপত্র পড়ত রাতের পর রাত। বইয়ের বিকল্প কেউ নেই। চলমান বঙ্গজীবনে মোটিভেশন ট্যাবলেট হিসাবে দিনে একবার ফেলুদার বই পড়া দরকার! বর্তমানে কাজ যেমন নেই, কাজ করার মানসিকতাও নেই। কাজ করে অর্থ উপার্জন করার থেকে কাজ না করে অর্থ উপার্জন করাটাই এখন ট্রেন্ড হয়ে গেছে, সৌজন্যে রাজনীতি। ফলে মানবসম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অসুস্থ মেধার পাশে আতঙ্কের আর এক নাম কৃত্রিম মেধা।তাই ফেলুদার সেই তুখোড় মগজাস্ত্র ছাড়া এই ঘোর বিপদ থেকে মুক্তির পথ নেই।

তবে আক্ষেপ একটাই, ফেলুদা কোনোদিন সুখ পেল না। সুস্থ শরীর থাকলেও শান্তিতে কোথাও ঘুরে বেড়াতে পারেনি। লালমোহনবাবুর প্রস্তাব না করতে পেরে রাজি হয়েছে কিন্তু সেখানে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে। সেই ক্রাইম, সেই গোয়েন্দাগিরি তাকে ছুটি দেয়নি। অবশ্য কাজ করতে করতেই সে সময় সমাজ কালকে চিনেছে ,সে যে উপলব্ধি করেছে সেখান থেকেই তার দর্শনের জন্ম হয়েছে। ফেলুদা ইউলিসিসের মত সচল অবিরাম অবিরত। ‘ভূস্বর্গ ভয়ংকর’ গল্পে ফেলুদা বলছে, ‘যা বুঝেছি ছুটি ভোগ মানেই দুর্ভোগ। ক্রাইম যেন আমাদের পিছনে ওঁত পেতে থাকে, একটু আরাম করলেই ঘাড়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।’