বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি ভারতে বাংলাভাষার আধিকারের দাবিতে আরও দুটি আন্দোলনের দাবিতে। দু’টিরই শুরুয়াত এই মে মাসে। এর মধ্যে একটি অসমের বরাক উপত্যকার ১৯৬১ সালের ১৯ মে –এর আন্দোলন। অন্যটি মানভূম ভাষা আন্দোলন। এই মানভূম ভাষা আন্দোলনের একটি চিত্ররূপ প্রায় প্রতি বছরই ৬ মে তারিখে শুধু ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় মুদ্রিত হয়। যেখানে দেখা যায়, ১৯৫৬ সালের ৬ মে হাওড়া ব্রিজের ওপর মানভূম সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পদযাত্রীদের মিছিলের ছবিটি। যার ক্যাপশানে লেখা থাকে হাওড়ার শিবির থেকে কলকাতায় ঢুকছেন মানভূম সত্যাগ্রহীরা’। এক ব্যাপক দাঁতচপা লড়াইয়ের ইতিহাসকে ধারণ করে রেখেছে মে মাসের এই দিনটা এবং এই ভাষা আন্দোলন। যা বহতা কালে লালন করার ব্যাপারে গোটা পশ্চিমবঙ্গেই শিক্ষিত এবং ইতিহাস ও সংস্কৃতি সচেতন বাংলাভাষী মানুষদের মধ্যে কোনও সাড় নেই৷অথচ এই মানভূম ভাষা আন্দোলনই মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে বাঁচার আর্তি, যা হয়তো তলিয়ে গিয়েছে বিস্মরণে।
বিহারের পাটনার জাতক পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর তাতে সোল্লাসে বিহারের লোকেরা সম্মত হয় এবং সেই প্রক্রিয়া চলতে থাকে৷ এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে মানভূম জেলার বাংলাভাষী মানুষের তীব্র প্রতিবাদ এবং ক্ষোভকে আন্দোলনে রূপ দিয়ে যে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন হয়; এই মে মাসের ৬ তারিখে, ১৯৫৬ সালে। এর ছয় মাস পরে বিহারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া সেই মানভূম জেলার প্রায় অর্ধেক কেটে পুরুলিয়া জেলা তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গে জোড়া হয়; অন্যায়ভাবে ব্রিটিশের খামখেয়ালে যে বৃহৎ বাঙালির বসবাসের ভূমি বিহারে দেওয়া হয়েছিল— তার অর্ধেক চিরকালের জন্য বিহারভুক্তই রেখে দেওয়া হয়৷
বিস্তৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ ও বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলেনর চেয়ে মানুভূমের ভাষা আন্দোলনের বিস্তৃতি কম ছিল এবং তা শুধু মানভূম জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ভারতে বাংলার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন প্রথম শুরু হয়েছিল মানভূম জেলায়। যার সূচনা হয়েছিল ১৯১২ সালে। বঙ্গভঙ্গের সময়ে বাংলাভাষী প্রধান মানভূম জেলাকে বাংলা থেকে বিহার ও ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। পরে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও মানভূম জেলা বিহার ও ওড়িশার মধ্যেই থেকে যায়।

বিহারের পাটনার জাতক পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর তাতে সোল্লাসে বিহারের লোকেরা সম্মত হয় এবং সেই প্রক্রিয়া চলতে থাকে৷ এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে মানভূম জেলার বাংলাভাষী মানুষের তীব্র প্রতিবাদ এবং ক্ষোভকে আন্দোলনে রূপ দিয়ে যে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন হয়; এই মে মাসের ৬ তারিখে, ১৯৫৬ সালে। এর ছয় মাস পরে বিহারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া সেই মানভূম জেলার প্রায় অর্ধেক কেটে পুরুলিয়া জেলা তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গে জোড়া হয়; অন্যায়ভাবে ব্রিটিশের খামখেয়ালে যে বৃহৎ বাঙালির বসবাসের ভূমি বিহারে দেওয়া হয়েছিল— তার অর্ধেক চিরকালের জন্য বিহারভুক্তই রেখে দেওয়া হয়৷ এই চক্রান্তের অন্যতম সক্রিয় অংশীদার ছিলেন বিধানচন্দ্র রায় ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা৷ সেই ইতিহাসের ক্রম আসলে ১৯৪৭-৪৮ সালে সূচিত ‘মানভূম ভাষা সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়, যা প্রকট হয়ে ওঠে ১৬ জানুয়ারি ১৯৫৬ তারিখে প্রকাশিত ‘রাজ্য পুনর্গঠন সাব-কমিটি’র রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে৷ বাংলাভাষী সংখ্যায় বেশি হলেও মানভূম আর কিষাণগঞ্জ পশ্চিমবঙ্গকে না দেওয়ার শঠতাকে জনক্ষোভ বলে প্রদর্শন করতে ১৭ তারিখেই বিহারের কংগ্রেস নেতৃত্ব মানভূমে হরতাল পালন করায় জুলুম ও জবরদস্তি করে৷ ১৮, ১৯ এবং ২০ জানুয়ারিতেও তারা ওই অঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত করে দেয়৷ কিন্তু বাংলাভাষী মানুষের পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হওয়ার সঙ্গত দাবিকে সীমা কমিশন খণ্ড ও খর্বিত করার প্রতিবাদে আসল আন্দোলন করে বাঙালিরা ২১ জানুয়ারি গোটা মানভূম জেলায় সর্বাত্মক হরতাল ও অরন্ধন পালন করে৷ এইদিন পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্রও একই দাবিতে হরতাল হয় স্বতঃস্ফূর্ত৷ এই হরতাল দাবি জানায় ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রকৃত নীতি কার্যকর করতে, তা করলে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়তে হবে সাঁওতাল পরগণা, পূর্ণিয়া, আসামের গোয়ালপাড়া, কাছাড়া ও ত্রিপুরা–এই ছিল সেদিনের দাবি৷ আন্দোলন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সামনের সারির নেতৃত্ব, যাঁরা কংগ্রেস ছেড়ে বেরিযে এসে স্বাধীন দেশের সরকারের ব্যাপক অত্যাচারকে ভয় না পেযে ‘লোকসেবক সংঘ’ নামে রাজনৈতিক দল তৈরি করেই চলেন৷ এর প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ হলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর পত্নী শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, রাখালচন্দ্র গাঙ্গুলি, শৈলবালা ঘোষ, নীরদবরণ রায়, হেমচন্দ্র মাহাতো, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, হংসেশ্বর নদী, জগদীশ চ্যাটার্জি প্রভৃতি৷ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় য়ে এই মহান মানুষদের জীবনী খুঁজতে গিযে প্রচলিত বাঙালির চরিতাবিধানে আমি এই পোষ্টের ছবিতে দেওয়া অতুলচন্দ্র আর বিভূতিভূষণ ছাড়া আর কারও কোনও জীবনালেখ্য পাইনি!
২১ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা অমান্য করে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়, তাতে নেতৃত্ব দেন লাবণ্যপ্রভা ঘোষ৷ অন্যদিকে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে গ্রেপ্তার হন বহু বাঙালি, তাঁদের নেতৃত্ব দেন ভজহরি মাহাতো, সমরেন্দ্রনাথ ওঝা, ভীমচন্দ্র মাহাতো এবং অতুলচন্দ্র সিং ভুঁইয়া৷ কমিউনিষ্ট পার্টিরও সমর্থন ছিল এই আন্দোলনে, তাঁরা অমূল্য কর্মকারের নেতৃত্বে গ্রেপ্তার বরণ করেন৷ বলরামপুর, বেগুনকোদর, কাশীপুর, বন্দোয়ান, বরাবাজার, পুঞ্চা, পাড়া, চাঁন্দিল, আড়ষা, জয়পুর প্রভৃতি জেলার সর্বত্র বাঙালিরা দলে দলে স্বতস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে স্রোতের মত অংশ নেয়৷
সত্যাগ্রহীরা কলকাতায় ঢোকার পর ৬ মে রবিবার বিকেলে জনসভা হয়, সেই সভায় সত্যাগ্রহীদের বিপুলভাবে সংবর্ধিত করে বক্তৃতা দেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জি, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র, হেমন্তকুমার বসু ও সাতকড়িপতি রায়৷ ৭ মে সোমবার কলকাতায় হয় সত্যাগ্রহ৷ এই সত্যাগ্রহে অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ৯৬৫ জন সত্যাগ্রহী বেলা ৩.১৫ মিনিটে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে ১৪৪ ধারা অমান্য করে গ্রেপ্তার হন৷ এঁদের বিধান রায়ের সরকার বন্দি রাখে প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর জেল ও আলিপুর স্পেশাল জেলে৷ সত্যাগ্রহীদের মধ্যে ৩৪ জন ৭ মে প্রবল গরমের দাবদাহে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁরা ৯ মে বুধবার একই জায়গায় আইন অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কারাবরণ করেন৷ তাঁদেরও ওই তিনটি জেলে ঢোকানো হয়৷ ১৩ দিন কারাবাসের পর এঁরা মুক্ত হন ১৯ মে৷
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহের সঙ্গে ২৩ জানুয়ারি ১৯৫৬ এক যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করে বলেন, সীমা কমিশনের সুপারিশ কাউকে সন্তুষ্ট করেনি, তাই দুই রাজ্যকে জুড়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ বিহার সংযুক্ত প্রদেশ’ নামে রাজ্য তৈরি করা হবে৷ ভারতের বাংলাভাষী মানুষরা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়, বলাই বাহুল্য৷ ধিক্কার জানিয়ে বিবৃতি দেয় বিভিন্ন সমাজ-সংস্থার সঙ্গে সম্মানিত বাঙালি ব্যক্তিত্বরাও; যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অতুলচন্দ্র গুপ্ত, বিমলচন্দ্র সিংহ, সাতকড়িপতি রায়৷ কংগ্রেস ছাড়া সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন কলেজ স্ট্রিট সেনেট হলে এক সম্মেলনে মিলিত হয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে৷ এই সম্মেলনে বক্তৃতা দেন সাংবাদিক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র, গোপাল হালদার, দাশরথি তা, সত্যপ্ৰিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত, কাজী আবদুল ওদুদ প্রভৃতি৷ ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা-বিহার সংযুক্তি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গোটা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও মানভূম জেলায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে বাঙালিরা৷ জনমতের তীব্রতা দেখে বিধানচন্দ্র রায় জানান আসন্ন এপ্রিল/মে মাসে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী পরাজিত হলে তিনি এই বঙ্গ-বিহার সংযুক্তি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেবেন৷ পশ্চিমবাংলায় সমাজ ও রাজনীতির পরবর্তী তিন মাস এটাই মুখ্য আলোচ্য হয়ে উঠলেও বিহারের কংগ্রেস ও সরকার সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাঙালির মুখ বোজানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়৷ ১৬ মার্চ মানভূমে সংযুক্তি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে হরতাল পালিত হয়৷ ওইদিন বিকেলে রাসমেলায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন অতুলচন্দ্র ঘোষ৷ বক্তব্য রাখেন ‘লোকসেবক সংঘ’-এর প্রধান সচিব৷ বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, কমিউনিস্ট পার্টির অমূল্য কর্মকার, প্রোগ্রেসিভ ব্লকের অশোক চৌধুরী, পুরুলিয়া পৌরসভার কমিশনার মহাদেব মুখার্জি৷ এই সভায় বাংলা-বিহার ‘মার্জার’-এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়৷ প্রবল বৃষ্টির কারণে এই সভা দ্রুত শেষ করতে হয়৷ পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা এই সংযুক্তি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে “পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি”, এর নেতৃত্বে চালিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনে কারাবরণ করেন ১০৫২ জন সত্যাগ্রহী৷ ‘লোকসেবক সংঘ’ ঘোষণা করে মানভূম থেকে কলকাতা সত্যাগ্রহ অভিযান; জানায়, ২০ এপ্রিল মানভূম জেলার পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে ১০০৫ জন সত্যাগ্রহী যাত্রা শুরু করবেন, এতে ১০ জন মহিলাও পদযাত্রায় অংশ নেবেন৷ সত্যাগ্রহীদের পরিক্রমা পথে কোথায় কোথায় তাঁরা বিশ্রাম নেবেন তা ঠিক করতে প্রধান নেতাদের কয়েকজন ৪ এপ্রিল সাইকেলে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন, এঁদের নেতৃত্ব দেন বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, কৃষ্ণপ্রসাদ চৌধুরী, চিত্তভূষণ দাশগুপ্ত, ভোলানাথ হালদার প্রভৃতি নেতা৷ সত্যাগ্রহীদের থাকা, খাওয়া ও পরিচর্যার জন্য বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি ও হাওড়া জেলার মানুষের মদ্যে ব্যাপক উন্মাদনা সৃষ্টি হয়৷

২০ এপ্রিল সকালে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিয়ে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ ও ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা’ গান দুটি পালাক্রমে গাইতে গাইতে সত্যাগ্রহীদের পদযাত্রা শুরু হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় ঢোকার পর এঁদের স্বাগত জানাতে সভায় সম্বর্ধনা জানান মোহিত মৈত্র, সাতকড়িপতি রায়, কশেব চক্রবর্তী, চণ্ডিচরণ ব্যানার্জি, সত্যেন্দ্র বসু, রাখহরি চ্যাটার্জি প্রমুখ নেতৃবৃন্দ৷ সত্যাগ্রহ পদযাত্রীরা মোট ১৭৩ মাইল হাঁটেন ১৭ দিনে (২০ এপ্রিল থেকে ৬ মে ১৯৫৬)৷ সত্যাগ্রহীরা কলকাতায় ঢোকার পর ৬ মে রবিবার বিকেলে জনসভা হয়, সেই সভায় সত্যাগ্রহীদের বিপুলভাবে সংবর্ধিত করে বক্তৃতা দেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জি, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র, হেমন্তকুমার বসু ও সাতকড়িপতি রায়৷ ৭ মে সোমবার কলকাতায় হয় সত্যাগ্রহ৷ এই সত্যাগ্রহে অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ৯৬৫ জন সত্যাগ্রহী বেলা ৩.১৫ মিনিটে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে ১৪৪ ধারা অমান্য করে গ্রেপ্তার হন৷ এঁদের বিধান রায়ের সরকার বন্দি রাখে প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর জেল ও আলিপুর স্পেশাল জেলে৷ সত্যাগ্রহীদের মধ্যে ৩৪ জন ৭ মে প্রবল গরমের দাবদাহে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁরা ৯ মে বুধবার একই জায়গায় আইন অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কারাবরণ করেন৷ তাঁদেরও ওই তিনটি জেলে ঢোকানো হয়৷ ১৩ দিন কারাবাসের পর এঁরা মুক্ত হন ১৯ মে৷ জেল ফটকে তাঁদের সংবর্ধিত করেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত, রাজ্য পুনর্গঠন পরিষদ এবং ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন কমিটি৷ দেশপ্রিয় পার্কে এক বিশাল জনসভায় সত্যাগ্রহীদের আপ্যায়িত করা হয়৷ দীর্ঘ ৯ মাইল রাস্তায় শোভাযাত্রা করে তাঁরা হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছন৷ পরদিন ভোর চারটেয় একটা স্পেশাল ট্রেনে তাঁরা পুরুলিয়া অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করেন৷ পথে খড়গপুর, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি জায়গায় তাঁদের সংবর্ধনা দেয় স্থানীয় জনতা ও নানা সামাজিক সংগঠন৷ দুপুর ৩.১৫ মিনিটে সত্যাগ্রহীরা পুরুলিয়া পৌঁছান৷ সেখানে পৌঁছবার পরেও চলে সংবর্ধনা ও শোভাযাত্রা এবং রাস ময়দানে জমায়েত৷ এই পর্বেও নেতৃত্ব দেন বর্ষীয়ান জননেতা অতুলচন্দ্র ঘোষ৷ রাস ময়দানের সভায় সম্বর্ধনা-ভাষণ পাঠ করেন অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক ডাক্তার তারাপদ রায়৷ বক্তব্য রাখেন পুরুলিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান সুকুমার মুখোপাধ্যায়, অমলাপ্রসাদ সিংহ, অমূল্য কর্মকার, প্রণবকুমার দে, কালীকৃষ্ণ রায় প্রমুখ নেতা৷ গভীর রাতে শুরু হয়ে এই সভা শেষ হয় মধ্যরাতে৷
এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলাকালে উত্তর-পশ্চিম কলকাতা লোকসভা আসনের উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়৷ সম্মিলিত জনগণের প্রার্থী মোহিত মৈত্র বিধানচন্দ্র রায়ের কংগ্রেস প্রার্থী ব্যারিস্টার অশোককুমার সেনকে ৩৩ হাজার ৭৩ ভোটে পরাজিত করেন৷ বিধানচন্দ্র রায় বাধ্য হন বাংলা-বিহার ‘মার্জার’ বা বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে জুড়ে দেওয়ার মতলব প্রত্যাহার করতে৷ ১৭ ও ২৮ আগস্ট ১৯৫৬ যথাক্রমে লোকসভা ও রাজ্যসভায় ‘বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্ধারণ বিল’ পাশ হয়৷
পয়লা সেপ্টেম্বর বিহারের ভূমিপুত্র তথা দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রজেন্দ্রপ্রসাদকে এই বিলে সইি করতে হয়৷ ১ নভেম্বর ১৯৫৬ থেকে এই বিল কার্যকর হয়— যার দ্বারা এক দশকের একটি আন্দোলন খণ্ডিত হলেও সফল হয় এবং বিহারের পূর্বতন মানভূম জেলার ঝালদা, জয়পুর, পুরুলিয়া, বলরামপুর, হুড়া, আড়ষা, পুঞ্চা, বাঘমুণ্ডি, বরাবাজার, বান্দোয়ান, মানবাজার, রঘুনাথপুর, সাঁতুড়ি, নিতুড়িয়া, কাশীপুর ও পাড়া থানার ভূমি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অন্বিত হয়৷ এর মোট এলাকা ২৪০৭ বর্গমাইল, লোকসংখ্যা ১১ লক্ষ উনসত্তর হাজার সাতানব্বই জন৷
এই ভাষা আন্দোলনের সাফল্যে পুরুলিয়ার বাংলাভুক্তির আনন্দ-উৎসব পালনে ১ নভেম্বর ১৯৫৬ থেকে যে সাতদিনব্যাপী উৎসব পালিত হয় পুরুলিয়ায়, তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কবি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবী ‘সুস্বাগতম’ নামে যে কবিতা লেখেন তার শেষ চার পংক্তি পাঠকদের অনুধাবন ও তলিয়ে ভাবার জন্য স্মরণ করে শেষ করা যাক:
“জানি জানি যাহা রয়ে গেল বাকী
মাতৃভাষার ঐক্য তীরে,
তোমাদের দৃঢ় সাধনার বলে
একদা তাহাও আসিবে ফিরে৷”