(দ্বিতীয় পর্ব)
প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর বছর ছয়েক পর পুনর্বিবাহ করেন জ্যোতিবাবু। পাত্রী আলিপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বীরেন্দ্রনাথ বাবুর বড় কন্যা কমল বসু। এই প্রসঙ্গে নিশিকান্তবাবু তাঁর ১৯৪৮ সালের ৫ ডিসেম্বরে তাঁর দিনলিপিতে লিখছেন, “…আমার ছোট পুত্র জ্যোতি বসু এম. এল. এ. এবং কমিউনিস্ট পার্টির লিডার আজ রেজিস্ট্রি করিয়া ২ বার বিবাহ করিল। … সে (কমল) বি.এ. পর্যন্ত পড়িয়াছে। আমার আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সকলেই এই বিবাহে অত্যন্ত সুখী হইয়াছিল। বিশিষ্ট ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলাগণ বিবাহের রাতে বীরেনবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইয়া বর কন্যা কে আশীর্বাদ করিলেন।…”
লক্ষণীয়, পুত্র ‘কমিউনিস্ট পার্টির লিডার’ হিসাবে সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হলেও, নিশিকান্তবাবু কিন্তু তাঁর জীবনচর্যায় আজীবন হিন্দু সামাজিক রক্ষণশীলতার পরিসরটি সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। যেমন, ১৯৪৮ সালের ৫ ডিসেম্বরের দিনলিপিতে তিনি পাত্রীর পারিবারিক পরিচয় দিয়ে জানিয়েছেন, “… বাড়ি ঢাকার বহর গ্রামে। তাহারা সেখানে ‘উচ্চ বংশীয় কুলীন’।” অন্যদিকে, জ্যোতিবাবুর প্রথমা পত্নী ‘ছবি’র সম্পর্কেও তিনি জানিয়েছিলেন, ‘ সমৃদ্ধশালী উচ্চ বংশে ও বিশিষ্ট ভদ্র ও ‘কুলীনের’ ঘরে জন্ম।
অন্য একটি বিষয়ের উপরও অগাধ আস্থা ছিল নিশিকান্তবাবুর। তা হলো জ্যোতিষ চর্চা। তাঁর ছোট ছেলের কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষী যা গণনা করেছিলেন, তা যে সর্বাংশে মিলে গিয়েছিল, তা তিনি তাঁর আত্মকথনে অকপটে জানিয়েছেন। “… ৪৩/১ হ্যারিসন রোডের বাড়িতে আমার ছোট পুত্র জ্যোতির জন্ম হয়। মাদ্রাজ হইতে মিস্টার ভাট নামে এক জ্যোতিষী কলিকাতায় আসিলেন। কন্যা ও ছোট পুত্রের কোষ্ঠী লইয়া তাঁহার নিকট গেলাম। ছোট পুত্র জ্যোতির কোষ্ঠী দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম সে ICS হইবে কিনা। তিনি জানালেন, সে ব্যারিস্টার হইবে এবং ৩৫ বছর বয়সে সে সকল ব্যারিস্টারদের শীর্ষ স্থানে থাকিবে।…”

এর পর বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছে। ১৯৩৫ সনের অক্টোবর মাসে ছেলেকে আই সি এস পরীক্ষা দিতে বিলেত পাঠিয়েছিলেন নিশিকান্তবাবু। “… ১৯২৪ সনে এক জ্যোতিষী বলিয়াছেন যে সে আই সি এস হইবে না – ব্যারিস্টার হইবে। কিন্তু তাহাকে যখন বিলাতে পাঠাইলাম তখন ঐ কথা একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিলাম। … জ্যোতি বিলাতে এক বৎসর থাকিবার পর আই সি এস পরীক্ষা দিল। কিন্তু অকৃতকার্য হইল। তখন মনে হইল এক মাদ্রাজী জ্যোতিষী বলিয়াছিলেন জ্যোতি আই সি এস হইবে না – ব্যারিস্টার হইবে।”
জ্যোতিষীর গণনার রায়কেই শিরোধার্য করলেন নিশিকান্তবাবু। তিনি জানিয়েছেন, “…তৎক্ষণাৎ কেবল (cable) করিয়া তাহাকে ব্যারিস্টারীতে ভর্তি হইবার জন্য টাকা পাঠাইলাম। দ্বিতীয় বৎসর আই সি এস দিল। এবারও অকৃতকার্য হইল। বুঝিলাম এ তাঁহার মঙ্গল ইচ্ছা। ব্যারিস্টারী পড়িতে লাগিল।…”

লোকনাথ বাবার প্রতি অগাধ আস্থা যে তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা ছিল, এই দিনলিপি – আত্মকথনের ছত্রে ছত্রে তার হদিস মেলে। ১৯৩৬ সালের বিশ অগাষ্ট তিনি দিনলিপিতে লিখেছেন, “… কয়েক বৎসর পূর্ব হইতে প্রতি শ্বাস প্রশ্বাসে শ্রী শ্রী লোকনাথ বাবার নাম করিতে চেষ্টা করিতাম। কখনও কখনও ভুল হইয়া যাইত। কিন্তু দীক্ষা গ্রহণের সময় নামে মন্ত্র যোগ হওয়াতে আরও সুবিধা হইল। অল্প দিনের মধ্যেই বিনা বাধায় নাম ও জপ চলিতে লাগিল… এক বছরের মধ্যে অনাহ্ত নাদ শ্রুতি গোচর হইল। একদিন বারদিতে ভ্রু মধ্যে উজ্জ্বল ওঁ কার খুব স্পষ্ট, যেন বৈদ্যুতিক তার দিয়া প্রজ্বলিত দেখিলাম।…”
এমনকী জীবনের কোনও কোনও মুহূর্তে কোনও বিপদ বা জটিলতার সম্মুখীন হলেও তিনি তৎগতগতচিত্তে বাবা লোকনাথের শরণাপন্ন হতেন। তিনি গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন ‘বাবা’ তাঁকে বিপদের ঝড় ঝাপটা থেকে রক্ষা করবেন। এরকম অজস্র উদাহরণ রয়েছে তাঁর দিনলিপিতে।
১৯৪২ সালের একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন তিনি। তখন তিনি কলকাতার বাইরে। তিনি লিখেছেন, “…আমার দুই বেলা আশ্রমে (বারদি) যাইয়া ও বিকেলবেলা ধর্ম্মালোচনা করিয়া খুব আনন্দে কাটিতে লাগিল। এমন সময় আমার ছোট পুত্র (জ্যোতি) চিঠি লিখল যে কোনও একটি মোকদ্দমায় আমাকে সাক্ষী মানিয়েছে এবং অনেকবার আমার নামে আমার বালিগঞ্জের বাড়িতে সমন আসিয়াছে। কিন্তু আমি উপস্থিত হই নাই বলিয়া আমার বাড়ি attach ( বাজেয়াপ্ত) করিবার জন্য নোটিস বাহির করিয়াছে। তখন আমার বড় দুঃখ হইল যে ধর্মকর্ম ছাড়িয়া চলিয়া যাই। শ্রী শ্রী লোকনাথ বাবাকে জানাইলাম.. যেন এই বিপদ হইতে অব্যাহতি পাই। পুত্রকে চিঠি লিখিলাম, … অমনি তার টেলিগ্রাম (১৪ জুলাই, ১৯৪২) আসিল, ‘Stay’ ‘থাক’ (আসিতে হইবে না)। মনে হইল শ্রী শ্রী লোকনাথ বাবা ভয়ানক বিপদ হইতে উদ্ধার করিলেন… তাঁর অপার স্নেহ অনুভব করিলাম।…”
তবে এই ঘটনার জট ছাড়িয়ে পিতৃদেবকে রক্ষা করতে জ্যোতিবাবু কিন্তু এক বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আসলে নিশিকান্তবাবুর এক অত্যন্ত স্নেহভাজন ভাইপো এক জনের কাছে টাকা ধার করার জন্য ডাক্তারবাবুর অনুপস্থিতিতে তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে থেকে সেই বাড়ি বন্ধক দেয়। এমনকী কোর্টে এফিডেবিট করে সে জানায় ডা. এন কে বসু তাঁর পিতার নাম। এমনকী ডা. বসু মারা গিয়েছেন, এই মর্মে একটি জাল ডেথ সার্টিফিকেটও সে আদালতে দাখিল করে। পরে অবশ্য দেনাদার কোনো পয়সা আদায় করতে না পারার নিশিকান্তবাবুর সাক্ষ্যের জন্য তাঁর নামে সমন বের করে।
নিশিকান্তবাবু তাঁর দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন, “…কয়েকদিন পরে আমার ছোট পুত্র জ্যোতি ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় কৃষক সম্প্রদায়ের নিকট বক্তৃতা দিয়া বারদি আসিল। তাহাকে নিকটে পাইয়া আমার, তাহার দিদিমার খুব আনন্দ হইল। সে বলিল, আলিপুরে যে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট এই মামলা তাহার সঙ্গে দেখা করিয়া সত্য ঘটনা বুঝাইয়া দিতে তিনি হুকুম দিলেন ডা. এন কে বসুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল তা ফিরাইয়া লওয়া হইল এবং ঐ মোকদ্দমা অনিশ্চিত কালের জন্য স্থগিত রইল। বাবার অসীম দয়ার পরিচয় পাইলাম।…”

উল্লেখ্য, নিশিকান্তবাবু সাধন মার্গের একটি বিশেষ স্তরে এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যে অনেকেই তাঁকে ‘অন্তর্যামী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর দিনলিপিতে আছে, “… কাহারও কোনো বিষয়ে সন্দেহ হইলে আমার কাছে আসিয়া মীমাংসা করিয়া যাইতেন। কেহ কোনো প্রশ্ন লইয়া আসিলে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বেই কথা প্রসঙ্গে তাহার উত্তর পাইতে লাগিলেন। …এই প্রকারে যাহারা প্রতিদিন আসিতেন তাহাদের মনে কোনো প্রশ্ন উদয় হইলে তাহার উত্তর হইয়া যাইত। ইহাতে তাহারা আমাকে অন্তর্যামী বলিতেন। … আমার নিজের কোনো ক্ষমতা হয় নাই। … ইহা লোকনাথ বাবার দয়ায় হয়।…”
তাঁর আক্ষেপ, “…এক্ষণে কেবলই মনে হয় সকলে ভগবানের নাম করেন না কেন? অধিকাংশ মানুষই দুঃখী, রোগে শোকে দরিদ্রতায় জর্জরিত… ঠিক প্রণালী মত নামজপে জীবন যে সুখময় হয় মনুষ্য জীবন যে সার্থক হয় সকলেই বুঝিতে চেষ্টা করে না কেন? …” এর উত্তর ও সমাধানও তিনি খুঁজেছেন। ডায়েরিতে তাঁর সংযোজন, … শ্রী শ্রী লোকনাথ বাবার দয়ার পরিচয় অনেকেই পাইয়াছে তথাপি বিশ্বাস নাই, তথাপি অন্য পথে চলে। তিনি স্বহস্তে লিখিয়া জানাইয়াছেন, “…রণে বনে জলে জঙ্গলে আমাকে স্মরণ করিও কোন বিঘ্ন হইবেক না।…”
যদিও একেবারই অন্য পথে চলেছিলেন নিশিকান্তবাবুর ছোট ছেলে ‘কমিউনিষ্ট পার্টির লিডার’ জ্যোতি বসু। পিতা যে ঈশ্বরের নাম জপে ‘মজে’ থাকার আকুতি প্রকাশ করেছিলেন, তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিন নির্দেশিত শ্রেণী সংগ্রামের পথেই ‘দুঃখ দারিদ্র্যের’ অবসানের ফর্মুলা খুঁজেছিলেন পুত্র। যে পথের পথিকদের কাছে ঈশ্বর কিন্তু অপাংক্তেয়, নেহাতই কষ্ট কল্পিত।
কৃতজ্ঞতা: এই লেখার সূত্র হরিপদ ভৌমিক সম্পাদিত ‘ডা নিশিকান্ত বসুর দিনলিপি ও আত্মকথন লোকনাথ প্রভাবে আমার জীবন’। ছবিগুলিও হরিপদবাবুর অনুমোদনক্রমে ওই বই থেকেই সংগৃহীত।