Baranashi

বিখ্যাত সেই রুম নম্বর তিন

যাওয়ার আগে ভন্টুটা চা-টোস্টের দোকানটার কথা বলেছিল, “ঘাটের আগে ডানদিকে দোকানটা খোলে সকালের আলো ফোটার আগে চা-টা দারুন আর টোস্টে মাখন লাগাতে কার্পণ্য করে না ওইটে মিস করিস না রাবড়িটা সাবধান, তোদের পেটে সহ্য হবে না, পেট ছাড়তে পারে” 

পুরোপুরি আলো ফোটার আগে সাইকেল রিকশা ধরে পৌছে গেলাম ঠিক মোকামে শীতের সকাল, চায়ের বিকল্প নেই, গোটা দশেক লোক ঘিরে আছে উনানের উত্তাপ নিতে ও গলা ভেজাতে কাচের গেলাসে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে দিতে এদিক ওদিক তাকাতেই নজর পড়ল বাড়িটার দিকে হ্যাঁ, ঠিক এটাই, পেয়েছি ঠিক এমনটাই দেখেছিলাম সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে পাক্কা মিল, এ যে না চাইতেই জল

Baranashi
সত্যজিৎ রায়ের জয়বাবা ফেলুনাথ সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যাওয়া হোটেলের প্রবেশপথ

কী ভাবছেন কোন সিনেমা? ঠাহর করার জন্য একটু স্থানমাহাত্ম্য কপচানো যাক।….যে জায়গাটা পৌরাণিক তী্র্থ হলেও, যেখানকার সঙ্গে সমাজব্যবস্থা, ধ্রুপদী সংস্কৃতি এবং হালআমলে তো ভোট রাজনীতিও একেবারে মিলেমিশে একাক্কার। তবে এর মধ্যে কিন্তু রহস্যও মিশে গিয়েছে এক মহান বাঙালি পরিচালকের দৌলতে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। কাশী বা বারাণসীর কথাই বলছিলাম।   

বারাণসী বা কাশী বাঙালির বহুপ্রাচীন তীর্থ ভ্রমণকেন্দ্র দীঘা-পুরী-দার্জিলিং সার্কিটের জনপ্রিয়তার আগে থেকে কাশী ছিল বাঙালির দ্বিতীয় প্রাণের শহর কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট, সংকটমোচন মন্দির, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, মণিকর্নিকা সহ শ’খানেক গঙ্গার ঘাট, কয়েক হাজার মন্দির নিয়ে ধর্মক্ষেত্র কাশীপীঠ 

baranashi Ghta
ঘিঞ্জি রাস্তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া দশাশ্বমেধ ঘাট

সেসব ছাড়াও আমাদের মত জয়বাবা ফেলুনাথের ভক্তদের কাছে আরও গুটিকয়েক ধম্মস্থান আছে বারাণসীতে তার মধ্যে মানমন্দির ঘাট, জ্ঞানবাপী, বাঙালিটোলা, দশাশ্বমেধ ঘাট, কেদার ঘাট এবং অবশ্যই ‘ক্যালকাটা লজ’ শেষোক্ত পূণ্যস্থানটি নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল ওইটের হদিশ পেতে কাঠখড় পোড়াতে লাগেনি অবশ্য ইউটিউবে গাইজরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল বারাণসীতে ক্যালকাটা লজের হদিশ আমার মত বেঘুরে ট্যুরিস্ট কেবল হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে 

baranashi-road
দশাশ্বমেধ ঘাটের পথ

গোধুলিয়া মোড় থেকে যে রাস্তাটা সোজা দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে গিয়েছে, সে পথে ঘাটের ঠিক আগে বাঁ’দিকে খেয়াল করল দেখা যাবে দোতলায় টানা বারান্দাসহ প্রাচীন হোটেল বাইরে প্রায় মুছে যাওয়া বোর্ডে বাংলায় লেখা দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস প্রায় দু’শো বছরের পুরনো বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হোটেল শোনা যায়, এক সময় এটা ছিল বেনারসের বাইজিদের বাসস্থান ১৯৩০ সালে এটি রুপান্তরিত হয় দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউসেপুরানো আমলের সরু খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই হোটেলের অফিস ঘর 

dasaswamedh-boarding
দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস- এর টানা বারান্দা কাম ডাইনিং

না, নিরঞ্জন চক্রবর্তী নামে কোনও ম্যানেজার এখানে কাজ করেননি এখনকার যে ম্যানেজার আছেন তাঁর নাম জয় বন্দ্যোপাধ্যায়,বাঙালি দোতলার একদিকে সার দেওয়া রুম আর সামনে বড় রাস্তার দিকে পুরনো দিনের নকশা করা সবুজ রংয়ের ঢালাই লোহার বাহারি গ্রিল দিয়ে ঘেরা একটা চওড়া টানা বারান্দা। এটাই আবার দুপুর ও রাতে ডাইনিং একধারে সার দিয়ে টেবিল চেয়ার পাতা সামনের টানা বারান্দায় দাঁড়ালে দেখতে পাওয়া যায় নিচে রাস্তায় মানুষ চলেছে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। বারান্দার ডান দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় বাবা বিশ্বনাথের গলির মুখটা আর বাঁদিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় দশাশ্বমেধ ঘাটের খানিকটা লোকেশন হিসাবে দারুন  

যদিও এখানে থাকার কোনও পরিকল্পনা নেই কিন্তু হোটেলের রুম দেখার ছলে ভিতরটা দেখার জন্য রুম খালি আছে কিনা জানতে চাইলাম না, এখন হোটেল আবাসিকে পূর্ণ ম্যানেজার জানালেন, দিন দুয়েক পর ঘর পাওয়া যাবে তিনতলা অবধি ঘর অনেকগুলো আছে। ঘরগুলোর কিছু এটাচ টয়লেট, কিছু কমনখুব বেশি ভাড়া নয়। লোকেশন অনুযায়ী বেশ কমই আসবাবপত্রগুলো পুরনো দিনের। এখানে একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, হোটেলেই দুবেলা খেতে হবে, বাইরে খাওয়া যাবে না। 

baranashi-hotel-room-3
দরজা ঠেললেই কি সেই বিখ্যাত জয়বাবা ফেলুনাথ –এর রুম নম্বর তিন!

আমার দ্রষ্টব্য ছিল তিন নম্বর রুমটি এটাই এই হোটেলের সবচেয়ে বড় রুম। সবুজ রঙের কপাট দেওয়া রুমের ভিতরে চারটি খাট পাতা হোটেলের ম্যানেজার বাবুর মুখ থেকে জানতে পারলাম , এই হোটেলের, এই রুমে জয়বাবা ফেলুনাথ সিনেমার শুটিং হয়েছিল জয়বাবা ফেলুনাথ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালের ৫ ই জানুয়ারি আপাতত সেই বিখ্যাত রুমটিতে আবাসিক রয়েছে, তাই ভিতরের ছবি তোলা গেল না। সে যাগগে, ধম্মস্থান তো দেখা হল। 

জয়বাবা ফেলুনাথ উপন্যাস প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। ততদিনে ফেলুদা সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘সোনার কেল্লা’ মুক্তি পেয়েছে এবং তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জয়বাবা ফেলুনাথ চলচ্চিত্রটি এই সিরিজের দ্বিতীয়। 

মূল উপন্যাসে আমরা ‘ক্যালকাটা লজ’ -এর বর্ণনা পাই। “…দশাশ্বমেধ ঘাটের রাস্তার উপর পঞ্চাশ বছরের পুরনো বাঙালি হোটেল ক্যালকাটা লজ। দোতলায় গিয়ে দেখি ঘরে চারটে খাট। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। যে-রাস্তার উপর বারান্দা, সেটার পুব দিক চলে গেছে সোজা দশাশ্বমেধ ঘাটে। নিরঞ্জনবাবু বললেন, গুণময় বাগচী থেকে গেছেন আপনাদের তিন নম্বর রুমে।…”

Dashashwamedh Ghat
দেখা যাচ্ছে ফলক চিহ্নিত দশাশ্বমেধ ঘাট

ক্যালকাটা লজের বর্ণনার সঙ্গে দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউসের ভীষণ মিল। সেই দোতলার তিন নম্বর রুম, রাস্তার উপর বারান্দা। চলচ্চিত্রেও তেমনটা দেখানো হয়। ফলে সন্দেহের কিছু থাকে না যে দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউসেই শুটিং হয়েছিল জয়বাবা ফেলুনাথের। হোটেলের কর্মীরাও সেই দাবি করেন। 

কিন্তু খটকা! কীসের জানি হিসাব মিলছে না। সিনেমায় দেখেছিলাম ঘরে দেওয়াল আলমারি আছে। বাস্তবে দেওয়ালে তাক আছে কিন্তু দেওয়াল আলমারির কোনও চিহ্ন নেই। কোনকালে ছিল বলেও মনে হয়না। ৫০ বছর আগের ঘরের রূপ এখনকার সঙ্গে মিলবে না জানি, কিন্তু এরকম সাধারণ মানের হোটেলে সত্যজিৎ রায় সদলবলে উঠেছিলেন, বিশ্বাস করা কঠিন। “একেই বলে শুটিং”-এ ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় লিখছেন, “…ঘাটের পর গলি নিয়ে পড়তে হল। ফেলুদারা এসে উঠেছে দশাশ্বমেধ রোডের উপর ক্যালকাটা লজ হোটেলে।” ব্যাস, এইটুকুই। হোটেলের আর কোনও বিবরণ নেই। এমনকী এ বিষয়ে আর কোনও কথাও লেখেননি। ক্যালকাটা লজে শুটিং নিয়ে একটা শব্দও নেই। 

baranashi-calcutta-lodge
দশাশ্বমেধ রোডে সিনেমার ক্যালকাটা লজ –এর বর্ণনার সাদৃশ্যে দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস

তাতে অবশ্য এটা বোঝায় না যে সেখানে শুটিং হয়নি। কিন্তু সে সন্দেহ যে অমূলক নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল জয়বাবা ফেলুনাথের ৫০ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত লেখাতে। সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় সিনেমা তৈরির কাহিনি বলতে গিয়ে জানাচ্ছেন, “…শুধু একটা জায়গা বাবা খুঁজে পাননি। সেটা হল ক্যালকাটা লজ। যেখানে ফেলুদারা গিয়ে উঠেছিল। তাই ওই লজের সেট স্টুডিয়োয় তৈরি করতে হয়েছিল।”

এক কথাতেই যাবতীয় বিতর্কের অবসান। দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউসের রুম নম্বর তিনের মিথ চুরমার। সেখানে সত্যজিৎ রায় সদলবলে মোটেও ওঠেননি, এমনকী জয়বাবা ফেলুনাথের কোনও শুটিং হয়নি সেখানে। বোর্ডিং হাউসের কর্মীরা কিংবা ট্রাভেল ভ্লগাররা যতই দাবি করুক, সেসব নেহাতই বানানো গপ্প। 

ভন্টুদাকে বিশ্বাস করা উচিত ছিল। সেরকম কিছু সত্যি থাকলে, চা দোকানের সঙ্গে দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউসের কথাটাও বলত। বেনারসের নাড়ি নক্ষত্র যার নখদর্পণে, এত বড় প্রচারিত মিথ্যাটাও সে জানাতে পারত! কেন জানালো না? বারাণসীতে ঘুরতে যাওয়া ফেলুদার ভক্তদের জন্য তা তদন্ত করে বার করার জন্য রাখা ছিল?

ছবি—লেখক