অন্য জমিদারদের প্রতি দ্বারকানাথের পরোপকার
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত জমিদারের স্ত্রী ও মেয়েকে দ্বারকানাথের সাহায্যের কথা প্রসঙ্গে তাঁর কর্তাদাদামশায়ের রাখালচন্দ্র হালদারকে বলা গল্পের সূত্র হিসাবে উল্লেখ করেছেন। গল্পটা এরকম- কোনও এক স্থানের এক জমিদার অনেক ঋণ-ধার করে মারা যান। তিনি মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উইলে সবকিছু বিক্রি করে ধার পরিশোধ করবার কথা লিখে যান। একদিন এক পাওনাদার নিজের টাকার জন্য সেই জমিদারের বসতবাড়ি আটক করে দ্বারকানাথকে বিক্রির জন্য প্রস্তাব দিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক হল, দ্বারকানাথ সেই বসতবাড়ি কিনতে প্রস্তুত হলে, মৃত জমিদারের স্ত্রী “কাঁদিয়া উঠিয়া মেয়েকে বলিলেন ‘চল – এই দেখছিস; ইনি দ্বারিকানাথ ঠাকুর; ইনি আমাদের বাড়ী টাড়ী কিনে নিয়ে এখনই আমাদের তাড়িয়ে দেবেন- তা’ আগে থাকতেই চল।”
দ্বারকানাথ ঠাকুর সেই পাওনাদারকে মৃত জমিদারের অন্যান্য জমির কথা জিজ্ঞাসা করে সেই জমির মূল্য, বর্তমান মালিক প্রভৃতি সমস্ত তাঁর ডায়েরিতে লিখে নিয়ে তাদেরকে ডেকে বললেন-“তোমরা বিক্রী কর আমাকে, আমি তোমাদের খরিদের দ্বিগুণ দাম দিব।” এভাবে দ্বারকানাথ সবকিছু কিনে নিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর “বিধবাকে বল্লেন যে তোমার জমীটাও কিনলুম তখনই মুখ শুষ্ক হয়ে গেল। সব কিনেটিনে সেই বিধবাকে বলিলেন যে, “এই সমস্ত জমী তোমাকে দিলুম।” এই হচ্ছে দ্বারকানাথ। দরিদ্র, আর্ত, অসহায়দের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণায় যার হৃদয় গলে যায়, তিনি কেবলমাত্র বৈভবের জন্যই প্রিন্স নন, পরোপকারের দিক থেকেও তিনি রাজপুত্রের মতো উদার হৃদয়ের অধিকারী।
ব্রাহ্মণ ও দ্বারকানাথ
ঠাকুরবাড়িতে দ্বারকানাথ বিষয়ে সবচাইতে বেশি আগ্রহী ছিলেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ক্ষিতীন্দ্রনাথই বাংলা ভাষায় দ্বারকানাথের প্রথম জীবনীগ্রন্থ লেখেন।ক্ষিতীন্দ্রনাথ তাঁর নোটবুকে তাঁর জগদীশ দাদামশায়ের কাছে শোনা একটি গল্পের উল্লেখ করেছেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ফরাসি ডাঙ্গায় এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের কথা লিখেছেন যিনি অনেক পরিবার পোষণ করিতেন, স্বভাবতই তার কিছুতেই চলত না। একদিন দরিদ্র ব্রাহ্মণের এক বন্ধু ব্রাহ্মণকে পরামর্শ দেন যে, ভারতবর্ষে একমাত্র দয়াবান পুণ্যবান কেবল দ্বারকানাথ ঠাকুর আছেন, যদি তাঁকে একবার স্পর্শ করতে পার, তবেই তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। প্রিন্সকে স্পর্শ করা- এতো স্বপ্নাতীত। দরিদ্র ব্রাহ্মণ জিজ্ঞেস করলেন কীভাবে তা সম্ভব? ব্রাহ্মণের বন্ধুটি বলল, দ্বারকানাথ সকাল ১০টার সময় অফিসে বার হন এবং বিকেল ৫টার সময় বেড়াতে বেরোন।এই দুই সময়ের মধ্যে একবার ব্রাহ্মণকে যেনতেন উপায়ে দ্বারকানাথকে স্পর্শ করতে হবে।
একদিন দ্বারকানাথ অফিসে যাবার জন্য গাড়িতে উঠবেন, এমন সময় দরিদ্র ব্রাহ্মণ পিছন থেকে দ্বারকানাথকে স্পর্শ করে দক্ষিণ দিকে দৌঁড় দেন। দ্বারকানাথ কিন্তু তাঁর দারোয়ানকে ব্রাহ্মণকে কোনরূপ অত্যাচার করতে নিষেধ করে তাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে বলেন। দ্বারকানাথের সামনে এসে ব্রাহ্মণ কাঁপতে শুরু করল। দ্বারকানাথ জিজ্ঞেস করেন- ‘তুমি ব্রাহ্মণ?’ ব্রাহ্মণ উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ দ্বারকানাথ নমস্কার জানিয়ে জানতে চাইলেন সে কেন একাজ করলেন? ব্রাহ্মণ সব ঘটনা দ্বারকানাথকে জানালে দ্বারকানাথ তৎক্ষনাৎ ১০/১৫ টাকা দিলেন এবং পরের দিন সকালে আবার তাকে আসতে বললেন। এদিকে দ্বারকানাথ খাজাঞ্চীকে বলে দিলেন যে কাল আসলে তাকে এক জোড়া জামা, ধুতি, চাদর ও জুতা কিনে দিতে। পরের দিন সকালে ব্রাহ্মণ অফিসের সময় এসে দ্বারকানাথের দেওয়া সমস্ত জিনিস গ্রহণ করে এবং দ্বারকানাথ ব্রাহ্মণকে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে গিয়ে মথুরা ঠাকুরের ভাই ব্রজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি অফিসের accountant ছিলেন তাকে বলেন-“এই ব্যক্তিকে ২৫ টাকা বেতন দিবে এবং যে জিনিস ওজন হবে, সেখানে ইহাকে লইয়া গিয়া, এ যাহা যত চাহিবে, তৎক্ষনাৎ দিবে।”
এরকম বন্দোবস্ত করে ছয়মাস পর দ্বারকানাথ একদিন ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন-“কত টাকা জমিল?” ব্রাহ্মণ উত্তর দিলেন, “আজ্ঞে প্রায় ৪০০০ টাকা।” পরে পূজার সময় আবার জিজ্ঞেস করলেন কত টাকা জমল? ব্রাহ্মণ বললেন প্রায় ৮০০০ টাকা। দ্বারকানাথ ব্রাহ্মণকে বললেন-“তুমি ভারি বোকা দেখছি, এবার হাতে বেশি করে নেবে।” এইভাবে ব্রাহ্মণ চার বছরের মধ্যে ফরাসিডাঙ্গায় কোঠা বাড়িটাড়ি করে হাজার হাজার টাকা জমিয়ে ফেলে। দ্বারকানাথকে স্পর্শ করে এভাবে ব্রাহ্মণের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১ এবং পর্ব ২ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৩ এবং পর্ব ৪ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৫ এবং পর্ব ৬ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৭ এবং পর্ব ৮ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৯ এবং পর্ব ১0 পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১১ এবং পর্ব ১২ পড়তে হলে ক্লিক করুন।