প্রতিবছর শীতে কুয়াশার ওড়না গায়ে জড়িয়ে বিশ্ব সিনেমার সপ্তপদী গমন হয় এই শহরের পথে|
“ওঁ ইশে একপদী ভব, সা মামনুব্রতা” অর্থাত প্রথম চরণ ফেলে তুমি আমার অনুগামিনী হও|এই মন্ত্রসূত্র মেনে সাত সাতটা দিন ধরে আন্তর্জাতিক সিনেমার অনুগামী হয়ে শহরে পথে পথে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে এসে ভিড় জমায় সিনেপ্রমীরা| অপার মুগ্ধতা, কৌতূহল আর মনোযোগ নিয়ে অনুবর্তী হয় আন্তর্জাতিক সিনেমার| শহরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের ছুটে যায় পছন্দের সিনেমার জন্য| ডেলিগেট কার্ড কিংবা ফ্রি পাসের জন্য লাইন দেয় টিকিট ঘরের সামনে| টিকিটের অপেক্ষায় অনিশ্চয়তার প্রহর গোণে| একই দিনে নুন-ম্যাটিনি-নাইট শো’তে সিনেমা দেখার হারিয়ে যাওয়া অভ্যেসকে আবার নতুন করে ফিরে পায়| সাত দিন ধরে অন্যদের পাল্লা দিয়ে সিনেমা দেখে| সিনেমা দেখার কাঁচা বয়সের উৎসাহে মাতে যে কোন বয়সের দর্শক| কিংবা সাবটাইটেল দেখে বিদেশী সিনেমার পর্দায় চোখ রেখে ভাবে— ‘কিছু তার বুঝি আবার, কিছু ভাই অনুভবে, কিছু তার বুঝি না বা|’ আসলে বোঝা না বোঝার মিস্টিসিজমে এই যে আচ্ছন্ন হওয়া, এটাই সিনেমা দেখার মৌতাত| শীতকালের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব এই মৌতাতেই উষ্ণতা ছড়ায়|
এরপরেও চলচ্চিত্র উৎসবে থাকে বুদ্ধিতে শান দেওয়ার জন্য সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, স্মারক বক্তৃতা, সাংবাদিক সম্মেলন| দেশ বিদেশের সিনেমার কুশীলব, পরিচালকদের সঙ্গে মত বিনিময়ের সুযোগ ঘটে| ছবি দেখার সঙ্গে চলে সিনে আড্ডায় মেতে ওঠা| সেলফির হুজুগ, পেট পুজোর হ্যাংলামি, সিনেমাকে সাক্ষী রেখে প্রেমে পড়ার ছুত খোঁজা| এই সব মিলিয়েই কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উত্সব (কিফ)| এবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৩০ বছর পূর্ণ হল| এই তিরিশ বছরে বেড়েছে দায়িত্ব, তৈরি হয়েছে নিজস্ব রুচিবোধ| পরিণত হয়েছে সমালোচনার উত্তর দেওয়ার অস্মিতা সেই সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়ার কর্তব্যপরায়ণতা| প্রতিবছরের মতো এবছরও| সিনেমা বাছাই এর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রাখতে হয়েছে|
২৯ টি দেশের ১৭৫টি সিনেমাকে ভাগ করা হয়েছিল বিভিন্ন বিভাগে| ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন, ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ, বেঙ্গলি প্যানোরামা, এশিয়ান নেটপ্যাক, সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল, স্পেশাল স্ক্রিনিং, ফোকাস কান্ট্রি (ফ্রান্স), স্পেশাল ট্রিবিউট, সেন্টেনারি ট্রিবিউট, ইন্ডিয়ান শর্ট ফিল্ম, ইন্ডিয়ান ডকুমেন্টারি, শর্ট অ্যান্ড ডকুমেন্টারি, গেম অন, এনভাযরনমেন্ট, ইন্ডিযান ক্ল্যাসিক্স এইসব বিভাগে দেশ বিদেশের সিনেমাগুলি দেখার সুযোগ হযেছিল|
উত্সবের আসর সাজাতে কিফ কতৃর্পক্ষ বিশেষভাবে সাজিয়েছিল নন্দন চত্বর| গাছে গাছে লাগামো এ এলইডি আলোর প্রতিপ্রভা, ফোয়ারা জলে এসে পড়া তার রঙিন বর্ণাভা, আশেপাশে সিনেমার প্রোজেক্টার, পুরনো রিল ক্যামেরা, সৃজনশীল কাটআউটে মধ্যে কী এক মায়াবী আবহ তৈরি হয়েছিল|
মায়াবন বিহারিণী
একটা মায়াময় পরিবেশে মায়াবন বিহারিনীরা তো থাকবেনই। ছিলেনও। উৎসবের একদম প্রথম
দিনটিতেই দেখা মিলেছিল গহন স্বপন সঞ্চারিনীদের। তাঁদের মধ্যে প্রথম যাঁর নাম করতে হয়, তিনি অপর্ণা সেন| সেই স্বপ্ন নারী যার সৌন্দর্যকে ছাড়িয়ে যায় মেধা, গ্ল্যামারকে ছাপিয়ে যায় ব্যক্তিত্ব| উৎসবের প্রথম দিনে নন্দন চত্বরে যখন তিনি গাড়ি থেকে নামলেন–মেরুদণ্ডকে সোজা রেখে মাটিতে পা রাখতে খানিক সময় নিলেন| ক্যামেরা শিকারিদের সামনে একটু থমকালেন| তারপর মোহিনী হাসি হেসে চলে গেলেন তাঁর গন্তব্যের দিকে|
তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের তথ্যচিত্র বিভাগে সুমন ঘোষের তথ্যচিত্র ‘পরমা আ জার্নি উইথ অপর্ণা সেন’ দেখার সুযোগ হয়েছিল| নামে তথ্যচিত্র হলেও এটি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমাই| আর তাই বোধহয় এটি তিন জানুয়ারি থেকে মুক্তি পেযেছে কলকাতার বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে| এই তথ্যচিত্রে সুমন ঘোষ জানাতে চেয়েছেন অপর্ণা সেনের ক্রমবিকশিত হওয়ার ধাপগুলিকে| ‘তিন কন্যা’র মৃন্ময়ী থেকে অপর্ণার ‘ইতি মৃণালিণী’র হওয়ার বিরাট জার্নির বিভিন্ন চরণ| মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অপর্ণা সেন তার প্রথম ছবি ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’-এ মিস স্টোনহ্যামের মতো একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চরিত্রে জেনিফার লোপেজকে ব্যবহার করেছিলেন| মিস স্টোনহ্যামের মধ্যেকার নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বের যন্ত্রণাকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন অপর্ণা সেন, ওই বয়সেই| এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি মধ্যবিত্তের রক্ষণশীলতার দুয়ারে ঘা দিয়েছিল অপর্ণার ‘পরমা’| অসমবয়সী সদ্যযুবক রাহুলের সঙ্গে ভরপুর সংসারের গৃহিণী পরমা শারীরিক সঙ্গ করার পরও যখন বলে সে ওঠে – আমার তো কোন অপরাধবোধ নেই| সেই সময়কার সমাজ চমকে উঠেছিল পরমার এই স্বীকারোক্তিতে| আসলে এই সংলাপ নিছক নারীবাদের নয় বরং নারীর আত্মঅবগাহনের, পুরুষতন্ত্রের সমান্তরাল এক স্পর্ধিত পদক্ষেপের|
নিজের অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং অপর্ণা সেন নিজেই। কিন্তু মহাপৃথিবী (মৃণাল সেন), মেমসাহেব, কড়ি দিয়ে কিনলাম, পারমিতার একদিন দেখলে বোঝা যায় তাঁর এই ধারণা হয় ভ্রান্ত নয়তো অযাচিত বিনয়| আর এবার শর্ট অ্যান্ড ডকুমেন্টারি বিভাগে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালিত এই রাত তোমার আমার সিনেমায় অঞ্জন দত্তের সঙ্গে অপর্ণা সেনের অভিনয় দেখে মালুম হয় অপর্ণা সেনের সম্বন্ধে উত্পল দত্তের কথাটাই একশো ভাগ সত্যি- সি ইজ আ বর্ন অ্যাকেট্রস|
সময়ের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে অপর্ণা সেন যেভাবে খ্যাতির চুড়োয় পোঁছেছিলেন সেই সিঁড়িকেই প্রতীকীভাবে সুমন ঘোষ ব্যবহার করেছেন তাঁর তথ্যচিত্রে|শুধু অপর্ণা সেনের সেলুলয়েডের জীবনই নয়, কমলিনী-কঙ্কনার মা, শান্তিনিকেতনে স্মৃতি আগলানো কন্যে, বালিগঞ্জের অ্যাপার্টমেন্টের গৃহিণী, ফ্যাশন স্টেটমেন্টের আইকন—অপর্ণা সেনের সবরকম ইমেজ তুলে ধরেছেন|এবং সবত্রই ধরা পড়েছে তাঁর মেধা-প্রতিভার ঝলক, যা ঝলক দেয় তাঁর কার্বন ফ্রেমের চশমায়, মুক্তোঝরা হাসিতে|
এবারের উতসবে আমন্ত্রিত আরেক মায়াবন বিহারিণী বলিউড অভিনেত্রী বিদ্যা বালান| যিনি দক্ষিণী হলেও নিজেকে অর্ধেক বাঙালি বলে দাবি করেন|একুশ বছর আগে এই শহরেরই পরিচালক গৌতম হালদারের ‘ভালো থেকো’ সিনেমা দিয়ে বিদ্যার অভিনয় কেরিয়ার শুরু হয়| তারপর বলিউডের ব্যস্ত অভিনেত্রী হলেও বিভিন্ন সময়ে শুটিংয়ে এসেছেন এই শহরে| এদিনও এসেছিলেন ভালো থেকো সিনেমার প্রিমিয়ারে পরা শাড়িটি অঙ্গে চড়িয়ে| মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে স্মৃতিচারণায় বললেন গৌতম হালদার, সুজয় ঘোষ, প্রদীপ সরকার প্রমুখ বাঙালি পরিচালকদের সঙ্গে তাঁর কাজের দিনের কথা| ঝরঝরে বাংলায়, রীতিমতো রেওয়াজি গলায় গেয়ে দিলেন- তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল|হলুদ ট্যাক্সির বিদায় নেওযার খবর শুনে তাঁর মনখারাপের কথা| সত্যি এই শহরের প্রতি বিদ্যার মায়া উত্সবের দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেল| এঁরা ছাড়াও টলিউড, বলিউড এমনকী হলিউেডর সিনে জগতের বহু অভিনেত্রীদের হাট বসেছিল পূর্ণ চাঁদের মায়া ছড়িয়ে|
ফোকাসে ফ্রান্স
এবারের উৎসবে ফোকাস কান্ট্রি ফ্রান্স। ফ্রান্সের সিনেমা মানেই নিউ ওয়েভ।নারী-পুরুষের পারস্পারিক সম্পর্ক, মানুষের অবচেতন এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে ত্রিমুখী যোগসূত্রের শৈল্পিক উপস্থাপনা যা আমরা ফরাসি চলচ্চিত্রে পাই, তা 1950 সাল থেকেই এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে বললে অত্যুক্তি হয় না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে, ফরাসি চলচ্চিত্র যেদিকে বাঁক নিয়েছে তার উত্তর মেধার কিছু নিদর্শন দেখা যাচ্ছে এবার চলচ্চিত্র উৎসবের ফরাসি সিনেমাগুলির মধ্যে।
জা লুক গোদার, ক্রুফোর মতো চলচ্চিত্র পরিচালকরা যে নিরীক্ষা করেছিলেন সিনেমার গল্প বলায় তা পরবর্তীকালে সারা বিশ্বেই কমবেশি অনুসরণ করা হয়েছে পৃথিবীর চলচ্চিত্রে।এভরি ম্যান ফর হিমসেলফ কিংবা 1990 সালের ডান্সিং, মিসিং দ্য লিটল, গ্যাংস্টার এর মতো ছবিগুলি যেসব বিষয় সন্ধান দেয়, তা অনবদ্য| উত্সবে দেখা গেল ফরাসি সেইসব ছবি সেই যার ঐতিহ্য এখনও বিশ্বকে আলোড়িত করে| এবারের উৎসবে ফ্রান্সের মহিলা পরিচালকদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল| কল অফ ওয়াটার ডগ এন্ড দ্যা কোয়াইট সন ইটস ট্রেনিং মেন ফর নাইট ওয়েলকাম ইত্যাদি ছবিগুলি যেমন দেখানো হয়েছে তেমনি ফরাসি ক্লাসিকো দেখানো হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে আই সুইটআউট এফেক্ট দ্যা ওয়েজেস অফ ফেয়ার দ্যা স্লিপিং কার মার্ডারস প্রভৃতি ছবিগুলি।
দেড় ঘন্টার কল অফ ওয়াটার ছবিতে জলের সঙ্গে সাইমানের মানসিক সংযোগ যেন জাদু বাস্তবতার মোড়কে মুড়ে দেয়। ড্রাগন ট্রায়াল কমেডিতে তিনজনকে কামড়ানো দারিউছের এক পোষ্য সারমেয়কে বাঁচাতে তার উকিল কীভাবে এগোন তা নিয়েই ছবি। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও ছবিটি প্রশংসিত। ডেলফাইন কাউলিন এবং মুখ্রিয়েল কাউলিন পরিচালিত দ্যা কোয়াইট সন ৮১ তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল প্রিমিয়ার হিসেবে রাজনৈতিক মতবাদ পিতা পুত্রের সম্পর্ককে কীভাবে প্রভাবিত করে তার এক অসাধারণ চিত্রনাট্য এই ছবিটি|
দেশান্তরে ‘পরিক্রমা’
ভারত এবং ইতালির যৌথ উদ্যোগে তৈরি গৌতম ঘোষ পরিচালিত সিনেমা পরিক্রমা এবারের চলচ্চিত্র উত্সবের এক কাল পরিক্রমাও বটে| নর্মদা পরিক্রমায় বাস্তুবোচিত সমস্যাকে সিনেমার পর্দায় সামনে নিয়ে এলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। ভারতের পবিত্র নদী নর্মদামাইকে পরিক্রমা করার প্রাচীন ঐতিহ্য আজও ভূখণ্ডের মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। প্রতিবছর হাজার হাজার পূণ্যার্থী সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের এই নর্মদার গতিপথ পরিক্রমা করে ৬ মাস ধরে। এই নর্মদা পরিক্রমা নিয়ে ছবি বানাতে চেয়েছিলেন ইতালির আলিসান্দ্রো। ভারতীয় লেখিকা রূপার বই পড়ে। সেই কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠেছে পরিচালক গৌতম ঘোষের ছবি পরিক্রমা। যার এশিয়ান প্রিমিয়ার হয়ে গেল তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সিনেমাতে অভিনয় করেছেন মার্কো লিওনার্দো, চিত্রাঙ্গদা সিং, আরিয়ান বরকুল, গৌতম সরকার, অরিজিৎ দত্ত প্রমুখ।
ছবির মূল লেখক এবং উদ্যোক্তা সের্জিও স্ক্যাপাজিনি কুড়ি বছর আগে নর্মদা পরীক্রমা একটি ছোট উপন্যাস লেখেন| সেই বইয়ের সমস্ত ছবি এঁকেছিলেন সের্জিওর তিন কন্যা। সেই বই থেকে একটি সিনেমা তৈরি হোক এমন ইচ্ছে প্রকাশ করেই গৌতম ঘোষকে তিনি বইটি উপহার দিয়ে দিয়েছিলেন।তারপর কেটে গিয়েছে বহু বছর| অবশেষে সেই ছবির কাজ শুরু হয় ২০১৯-২০ সালে। কোভিড শুরু হওয়ার আগে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ইতালির কাজ শেষ করে দেশে ফিরেছেন সস্ত্রীক গৌতম। ইতালি ছাড়াও মুম্বাই এবং মধ্যপ্রদেশে সিনেমার শুটিং হয়েছে। ২০১৯ সালের ছবির কাজ শুরুর দিকে যে অল্প বয়সী কয়েকজনকে ছবির জন্য অডিশন নেওয়া হয়েছিল, কোভিড শেষ হওয়ার পর কাজ করতে গৌতম ঘোষ দেখেন তারা ততদিনে বড় হয়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত লালা বা আরিয়ানকে তাকে খুঁজে পান ইন্দোরে।আরিয়ান এই ছবিতে একটি ভারতীয় হকারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
‘পরিক্রমা’র সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এই সিনেমার কুশীলবরা। সের্জেই বলেন ৪০ বছর ধরে ভারতে আসছেন| এখানকার মানুষের হৃদয়ের কথা অনুভব করতে পারেন। তাঁর কথায় পরিক্রমা আমার কাছে ভারতের প্রতি বিনম্র নিবেদন। ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মেক্সিকো’, ‘মারাদোনা’ ইত্যাদি ছবির অভিনেতা মার্কো এই ছবিটি আলেসান্দ্রোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি গুগলের মাধ্যমে নর্মল আর গতিপথ দেখেছিলেন। কী অসাধারণ সুন্দর এই নদী| তার ধারের মার্বেল রক, নদীর স্বচ্ছ পরিশ্রুত জল, তার শব্দ-রং দেখে বোঝা যায়, নদীটি কত জীবন্ত। তারপর শুটিং করতে এসে মার্কো যখন একটা বাঁধের সামনে চলে এলেন, তখন দেখলেন নদী সেখানে মরে গিয়েছে| সেই বাদামী শ্যাওলা রঙের জলের সঙ্গে প্রাণবন্ত বাস্তবের নর্মদার কোনও মিল নেই।
পরিচালক গৌতম ঘোষ জানালেন, এই সিনেমা দুটি ছেলের কথা বলি একজন ফ্রান্সিসকো যে সদ্যই তার মাকে হারিয়েছে| আরেকজন লালা যে তার মাতৃভূমিকে হারিয়ে সর্বশ্রান্ত হয়েছে। এই সিনেমার জার্নি দুটি ছেলেকে কোথাও একটা মিলিয়ে দেয়। গৌতম ঘোষ বলেন আমি গল্প বলতে চাইনি কারণ আমি স্টোরি স্টোরি টেলার নই। আমার কাজ গল্পকে সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরা সেটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ছবিটির সম্পাদনা করেছেন নীলাদ্রি রায়। গৌতম ঘোষ নিজে আবহ সংগীত দিয়েছেন। গৌতম ঘোষ ছাড়াও চিত্রগ্রহণ করেছেন তার পুত্র ঈশান ঘোষ। জানুয়ারি মাসে কলকাতায় ‘পরিক্রমা’ মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে নির্মাতাদের।
সত্যজিৎ স্মারক
তিরিশতম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা দিলেন বলিউড সিনেমার খ্যাতনামা পরিচালক আর বালাকৃষ্ণান বা বালকি। গৌতম ঘোষ সেদিন তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শ্রোতাদের সঙ্গে।
‘সিনেমার মৃত্যু হওয়ার আগে যেন তাঁর প্রয়াণ ঘটে।’ বালকির বক্তৃতার মূল নির্যাস ছিল এটাই। তিনি একসময় বিজ্ঞাপন জগতের মানুষ ছিলেন। লোকে তাকে সংযোগ মানব বলত। পরবর্তীকালে তিনি হয়ে উঠলেন পরিচালক চিনি কম, পা, প্যাডম্যান, রিভেঞ্জ অফ অ্যান আর্টিস্ট, ঘুমর ইত্যাদি জনপ্রিয় ছবির নির্মাতা এই বালকি। তবে এইসব সাফল্যের মধ্যেও বালকির মনে হচ্ছে সিনেমা এখন ঘোর সংকটে, মুমূর্ষু রোগীর মতো। কিন্তু এখানেই যে পরিচালকের স্বপ্ন কল্পনার বিচরণ।যদি সেই বিচরণ কখনও কখনও অর্থনৈতিক সংকটে থমকে যায়।
সত্যজিৎ স্মারক বক্তৃতায় আর বালকির মুখে শোনা গেল ‘পুষ্পা টু’ সিনেমার কথা। বালকির কথায়, ব্লকবাস্টার ছবি তৈরি শুরু হয়েছিল ‘বাহুবলী’ দিয়ে। আর এখন চারিদিকে শুধু কনটেন্ট আর কনটেন্ট নির্মাতারা। আসলে সিনেমা এখন হয়ে উঠেছে অবিশ্রান্ত মোবাইল ঘেঁটে চলার একটা অভ্যাস মাত্র। কিন্তু ভালো বিষয় কি দর্শক পাচ্ছে? আসলে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে সিনেমাকে হতে হবে ইস্যু। একথা ঠিক, চেনা মুখ বা স্টারদের মানুষ দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু এসবের কথা ‘বাহুবলী’র পরে ওই ধরনের যে সমস্ত সিনেমা হচ্ছে, বালকির কথায় সেগুলি ইমোশনাল প্রোপাগান্ডা, প্রযুক্তির জঞ্জাল।
বালকি প্রশ্ন তোলেন, সিনেমা ভালোবেসে কজন মানুষ আর ভিড় জমান আজকের মাল্টিপ্লেক্সে? কমবেশি সকলেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা প্রভাবিত। বালকি বলেন, আগে জানতাম মানুষ তৈরি করে সিনেমা, এখন দেখছি সিনেমা তৈরি করে যন্ত্র। এরকম চলতে থাকলে বছর চার-পাঁচের মধ্যে দেখা যাবে সিনেমা হয়ে উঠেছে শুধুই মনোরঞ্জন। অন্যদিকে সিনেমার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা বহু লোক কর্মচ্যূত হচ্ছেন।
তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উত্সবে এসে বালকি বলেন, সত্যজিত রায়, ঋত্বিক ঘটকরা জাদু জানতেন। এই মুহুর্তে সিনেমাকে বাঁচাতে, তাকে স্পর্শ করতে হবে সেই জাদুদন্ড দিয়ে। তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বালকি যে সূত্র আমাদের কাছে রেখে গেলেন, সত্যজিৎ স্মারক বক্তৃতার মাধ্যমে, তা সত্যিই সিনেপ্রেমী হিসেবে আমাদের নিজেদের চিনতে শেখালো নতুন করে।
সেমিনারে সেরিব্রাল
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন জায়গা হল সিনেমাকে নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম। যাকে সিনেমা চর্চার চতুষ্পাঠী বলা যায়। যেখানে সিনেমা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মগজাস্ত্রের শান দেওয়া দর্শক এবং সিনেমা নির্মাতাদের মধ্যে বৌদ্ধিক সেতুবন্ধন হয়।
তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আলোচনার বিষয়বস্তু চয়নে ছিল বৈচিত্র। প্রযুক্তির বদল সিনেমার ভাবনায় কতখানি বদল ঘটিয়েছে? অসহিষ্ণুতা বিশ্ববিচার ব্যবস্থা এবং সংবাদপত্র। জাতীয় সিনেমার সংজ্ঞা কী? ডিজিটাল যুগে স্বল্পদৈর্ঘ্যের এবং তথ্যচিত্রের বাড়বাড়ন্ত। এইসব আলোচনার শিরোনামের ওপর বক্তব্য রেখেছিলেন বিশিষ্ট সিনেমাবোদ্ধারা। সমাপ্তির আগের দিন সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল চলচ্চিত্র চলচ্চিত্র উৎসবের সেকাল ও একাল। এই সেমিনারে ভি কে চেরিয়ান স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র উৎসবের কথা। সে সময় প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু আশা প্রকাশ করেছিলেন, এই চলচিত্র উৎসবের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে রুচিবোধের উদ্ভব ঘটবে। সেই উতসবে একদিকে দেখানো হয়েছে দা সিকার ‘বাইসাইকেল থিফ’ আরেকদিকে রাজ কাপুরের ‘আওয়ারা’। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরাট ডেলিগেশন এসেছিল সেই উৎসবে। এসেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক কাপ্রার মতো তারকা দিল্লিতে একটি প্যারেড আয়োজিত হয়েছিল বর্তমানে ইসির দুরাবস্থা নিয়ে চিন্তিত চেরিয়াম তিনি বলেন থেকে অনেক বেশি। ব্যাঙ্গালোর চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা এম বিদ্যাশঙ্করের মন্তব্য, চলচ্চিত্র উৎসবে সমসাময়িক সিনেমার উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। স্মৃতির পাতা উল্টে বিদ্যারশঙ্কর বলেন ১৯৮২ তে আমি কলকাতায় চলচ্চিত্র উৎসবে দেখেছি, গোদার বা ইলমাস গুণের ছবি দেখতে মানুষ ভিড় করেছে। তখন আমরা ফিল্ম উৎসবের জন্য মুখিয়ে থাকতাম এর অ্যাকা়ডেমিক মূল্যের জন্য। ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার মুখ্যসচিব সক্রাণ সেন বলেন, সত্যজিৎ রায় একবার উৎসবে আমন্ত্রিত বিদেশিদের বলেছিলেন, কলকাতায় আপনারা দেখবেন কোথাও রাস্তা খারাপ, লোডশেডিং, কোথাও টেলিফোন কাজ করছে না।কিন্তু এই শহরেই আপনি দেখবেন ভালো সিনেমা দেখার জন্য মানুষের ভিড় ভেঙে ফেলেছে। তিরিশতম চলচ্চিত্র উৎসবে এসেও মনে হয় সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
তিরিশতম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের এই সেমিনারগুলিই চলচ্চিত্রের থিওরেটিক্যাল ক্লাস। অন্যদিকে প্রদর্শনীগুলি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। তিরিশতম চলচ্চিত্র উৎসবে উৎসবের আপনজন তপন সিনহার শতবর্ষের উপলক্ষে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল এই বছর শতবর্ষে পা রাখা বেশ কয়েকজনের প্রতি শ্রদ্ধাস্মরণে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। এইসব প্রদর্শনী চলচ্চিত্র উত্সবে প্র্যাকটিক্যাল কর্নার।
সাংবাদিক সম্মেলন
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের মিডিয়া সেন্টার আসলে দেশ বিদেশের সিনেমা নিয়ে মনের কথা খুলে বলার একটা জায়গা। ছোট-বড় দেশীয়-বিদেশি যেমনই হোক, সেলুলয়েডের চোখ ধাঁধানো আলোপ পিছনে অন্ধকারের কাহিনি, সলতে পাকানোর কথা এখানে শোনা যায়। গালর্স অফ দ্য সী সিনেমার ইরানি পরিচালক মহম্মদ সিনা ঘাসেমি যেমন জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র মুক্তি পেলেও এই সিনেমা তাঁদের দেশে মুক্তি পাবে কিনা সন্দেহ। ‘পুতুলনামা’র পরিচালক, প্রযোজক, সিনেমাটোগ্রাফার, এডিটর রণজিত রায় জানালেন, তাঁরাই পাপেটরির শেষ প্রজন্ম।শোনালেন তাঁদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার লড়াই কত কঠিন। মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের মুখোমুখি বসিবার জায়গাটি যেন একসঙ্গে মন ও মগজকে পূর্ণ করার একটা ফিউশন প্লেস।
একতারার আড্ডাখানা
চলচ্চিত্র উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ সিনে আড্ডা। তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আসরের সামিয়ানা পড়েছিল একতারা মুক্তমঞ্চে। রোজই সেখানে বসেছিল চাঁদের হাট। কমেডি চরিত্রে অভিনেতাদের নিয়ে একদিন আড্ডা জমিয়েছিলেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। বিষয় ছিল ‘এমনও হাসি আছে বেদনা মনে হয়’। আড্ডায় ছিলেন রজতাভ দত্ত, বিশ্বনাথ বসু, কাঞ্চন মল্লিক প্রমুখ। ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্ট গোপনে রেখে কীভাবে দর্শকদের আনন্দদান করেন অভিনেতারা, সেকথাই বললেন তাঁরা। সিনেমার সাফল্যের পেছনে জুটি না গল্প কিসের অবদান? সে কথা জানা গেল অন্য এক আড্ডার আসরে। শাস্ত্রীয় সংগীতের দুই প্রখ্যাত শিল্পী পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং পন্ডিত তন্ময় বসু। তাঁদের যুগলবন্দিতে অনেক তথ্য পাওয়া গেল ‘চলচ্চিত্রে রাগের চালচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে। আরেকদিনের সিনে আড্ডায় ছিলেন অনুপম রায়, রাঘব চট্টোপাধ্যায়, রূপঙ্কর, জোজো, তৃষ্ণা প্রমুখ। কথায়-গানে একতারা মুক্তমঞ্চে তাঁরা আসর জমিয়ে তোলেন। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি এবং তথ্যচিত্রের রমরমা নিয়েও আড্ডা বসেছিল একদিন। বিভিন্ন দিনের আড্ডার আসরে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী অরূপ মন্ত্রী, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। ব্যবস্থাপনায় স্বরূপ বিশ্বাস।আড্ডার আগে কুইজ ঘিরে দেখা গিয়েছিল দর্শকদের উৎসাহ।
উৎসবের আপনজন
তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আপনজন’ ছিলেন তপন সিনহা। উৎসবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি রয়ে গেলেন দর্শকদের সামনে। এবারে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী ছবিটি ছিল তার পরিচালিত ‘গল্প হলেও সত্যি’। ঠিক তার পরের দিনই নন্দন ফয়ারে তপন সিনহাকে নিয়ে প্রদর্শনী শুভ সূচনা হল রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের পক্ষ থেকে।এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো, তখন সিনহা পরিচালিত ‘আদমি আওর আওরত’ এবং অরুন্ধতী দেবী পরিচালিত ‘ছুটি’ সিনেমা দুটি রি প্রিন্ট করিয়েছে উৎসব কর্তৃপক্ষ উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে। এবারেj চলচ্চিত্র উৎসবের সেগুলি দেখানো না হলেও আগামী কোনও চলচ্চিত্র উৎসবে সেই সিনেমা দেখার আশা রইল। এবার উৎসবের শেষ দিনেও আলোকিত হয়ে রইল তপন জ্যোতি। তপন সিনহাকে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাধবী মুখার্জি, দীপঙ্কর দে, অর্জুন চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, রাজতভ দত্ত, মুনমুন সেন, দেবিকা মুখোপাধ্যায়, সোনালি গুপ্ত, মন্দিরা চৌধুরী, শকুন্তলা বরুতা, লাবনী সরকার। ছিলেন তপন সিনহার পুত্র অনিন্দ্য সিনহা। তপন সিনহার অধিকাংশ সিনেমার হিসেবে পরিচালক পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সনৎ মহান্ত, শিল্প নির্দেশক রূপচাঁদ কুন্ডু, আলোকচিত্রী সৌমিক হালদার। প্রত্যেকেই এদিন তপন সিনহার সঙ্গে তাঁদের সিনেমার স্মৃতির কথা্ শোনালেন। তপন সিনহার পুত্র অনিন্দ্য সিনহা জানালেন, কতটা সংবেদনশীলতা নিয়ে তিনি সিনেমা বানাতেন। সিনেমার প্রতি কতটা সত্ ছিলেন তিনি।অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন গৌতম ভট্টাচার্য।
তপন সিনহা আদতে ছিলেন বিজ্ঞান শাখার ছাত্র। ভাগলপুর থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করেন। তারপর রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তরে পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে সিনেমায় সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিষয়টি নিয়ে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ২২ বছর বয়সে নিউ থিয়েটার্সে সাউন্ড রেকরডিস্ট বাণী দাসের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। বিমল রায়ের পরিচালনার কাজও গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করতেন। সাউন্ড ব্যবস্থাপনায় নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে একসময় চলে যান লন্ডনে। সেখানকার পাইনউড স্টুডিওর কর্তাদের হাত ধরে চার্লস ত্রাইটনের ইউনিটে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করে দেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ইউরোপ থেকে ফিরে আসেন কলকাতায়। এরপর ১৯৫৩ সালে বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ -এর শুটিংয়ে যোগদান। বিমল রায় অভিভাবকত্বেই পরবর্তী জীবনে পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সমাজ জীবনে দুঃখ যন্ত্রণা ছবিকে তিনি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতেন রবীন্দ্রনাথকেও গান এবং গল্পকেও সেলুলয়েডে তার মতো করে খুব কম জনই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। আট থেকে আশি- সকলের মনের কথা পড়তে পারতেন। সেই কারণেই তপন সিনহা ছোটদের জন্য যেমন ছবি তৈরি করেছেন তেমনি বড়দের মন নিয়েও নাড়াছাড়া করেছেন। তার পরিচালনার একটি বিশেষ গুণ ছিল তার সৃজনশীলতা ছবির মাধ্যমে তিনি একটি বার্তা দিতেন যার দেখার পর মানুষ ভাবনা চিন্তা করে এগোতে পারে। তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের আপনজন হয়ে শতবর্ষের তপন সিনহা রয়ে গেলেন সর্বজনের মনের মাঝে।
সেরার সম্মান
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে প্রতিবছর উপহারের ঝুলি পূরণ করে বিভিন্ন বিভাগে সেরার স্বীকৃতি দিয়ে।এবারও ছিল তার এলাহি আয়োজন। ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজেস বিভাগে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার –এর জন্য সেরা ছবি হিসেবে জুরিদের বিচারে নির্বাচিত হল বুলগেরিয়ার পরিচালক মিলকো ল্যাজারভের ‘তারিকা’। ছবিটি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম ক্রিটিক –এরও সেরা ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একই বিভাগে সেরা পরিচালক হিসেবে গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল ট্রফি পুরস্কার পেলেন পানামার ‘বিলাভেড ট্রপিক’ ছবির পরিচালক অ্যানা এনদরা।এই বিভাগে স্পেশাল জুরি মেনশনে মেক্সিকোর ছবি ‘ডেড ম্যানস সুইচ’ পুরস্কৃত হল। সেরা ভারতীয় ভাষা বিভাগে হীরালাল সেন মেমোরিয়াল পুরস্কার ট্রফি পেল কন্নড় পরিচালক কৃষ্ণ গোয়াদার ছবি ‘লাচ্চি’।ভারতীয় ভাষা বিভাগে সেরা পরিচালক হলেন আরিয়েন চন্দ্র প্রকাশ, তাঁর বজ্জিকা ভাষার ‘অজর’ ছবিটির জন্য।বিশেষ জুরি সম্মান ‘নুক্কড় নাটক’ ছবির পরিচালক তন্ময় শেখর। সেরা তথ্যচিত্র নির্বাচিত হল বাংলার দীপাঞ্জন চৌধুরীর ‘ভবতোষের কাণ্ডকারখানা’, শিল্পী ভবতোষ সুতারকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র। বেঙ্গলি প্যানোরাম বিভাগে সেরা ছবি অভিজিত চৌধুরীর ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’।এশিয়ান সিলেক্ট বিভাগে সেরা ছবি ভারতের ‘পুতুলনামা’।
উদ্বোধনী দিনের পর থেকে সাত সাতটা দিন ধরে যে মানুষগুলো সাত পাকে বাঁধা পড়েছিলেন বিশ্ব সিনেমার সঙ্গে, তাদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন ভাষা, বয়স, সামাজিক অবস্থানের মানুষ। তাঁদের মধ্যে ওই যে অল্পবয়সীরা সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীকে নিয়ে ঘন হলেন অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে, যে মধ্যবয়সীরা সিনেমার পর তার্কিক বিশ্লেষণে চায়ের পেয়ালায় (পড়ুন ভাঁড়ে) তুফান তুললেন, যে অশক্ত মানুষটি অন্যের হাতে ভর দিয়ে নন্দনের দোতলায় অন্ধকারে সিঁড়ি ঠাহর করে সিটে বসলেন পছন্দের সিনেমা দেখতে—তাঁরা সকলেই কিন্তু এলেন সিনেমাকে ভালোবেসে। অন্তত এই সাতটা দিন তাঁরা যাবতীয় ক্ষোভ, দ্রোহ, বিমর্ষতাকে ভুলে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার এই বিশ্ব সিনেমায়, বাঁধা পড়েছিলেন দেশ বিদেশের সিনেমার সঙ্গে সাতপাকের বাঁধনে।
ছবি : সৌরভ দত্ত