Gangasagar Mela

মন্ত্রের সাধন আর ভোগের অঙ্গ পাতনেই মুক্তি নাগা সন্ন্যাসীদের

প্রতিবছর গঙ্গাসাগর মেলার প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই ওঁরা আসেন এই শহরে। সারা অঙ্গ সাদা ছাই, মাথায় জটাজুটো, গলায় মাদুলি, সম্পূর্ণ দিগম্বর সন্ন্যাসীরা আশ্রয় নেন বাবুঘাট এলাকার ত্রিপলে আর পলিথিনে ঢাকা অস্থায়ী তাঁবুগুলিতে। যেখানে মাটিতে বিছানো রঙ-জ্বলা কম্বল, তার ওপরে কোথাও মযুরের পুচ্ছ দেওয়া ঝাড়ন, কোথাও কমন্ডলু। একপাশে রাখা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো শিবের ফোটো, তাতে মালা পরানো। সামান্য কিছু রান্নার সরঞ্জাম, কোথাও জ্বলছে ধুনি। দিগম্বর সন্ন্যাসীদের কেউ সেখানে আগুনতাত নিচ্ছেন, কেউ আবার কল্কেতে দিচ্ছেন লম্বাটান। ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খাচ্ছে শীতের বাতাসে, চারপাশে তীব্র গন্ধ। সব মিলিয়ে ফি-বছর গঙ্গাসাগর মেলার আগে শহর কলকাতার নাগরিক সভ্যতার পরিবেশকে বদলে দিয়ে বাবুঘাট অঞ্চলটা যেন হয়ে ওঠে আদিম সভ্যতার এক ধর্মীয় পীঠস্থান। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর সভ্যতার রক্ষণশীলতাকে ভেঙে ফেলে দেওয়া দিগম্বর সন্ন্যাসীরা যাঁদের আমরা ‘নাগা সন্ন্যাসী’ বলে থাকি, তাঁরা আশ্রয় নেন সেখানে। এবছর অবশ্য পূর্ণ কুম্ভস্নানের জন্য অনেকেই গিয়েছেন প্রয়াগরাজে। তাই এবার বাবুঘাটে নাগা সন্ন্যাসীরা সংখ্যা কিছুটা হলেও কম।

আসলে প্রতি বছর রাজ্য সরকারের আনুকূল্যে গঙ্গাসাগরের পুণ্যার্থীদের জন্য অস্থাযী আস্তানার আয়োজন রাখা হয় বাবুঘাট অঞ্চলে।মকর স্নানের আগে বাবুঘাট এলাকায় তৈরি হয় অস্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্প। মকর স্নানের আগে গঙ্গাসাগর মেলার উদ্বোধন হয়ে গেলে এখান থেকেই পরিবহণ়যানে পুণ্যার্থীরা রওনা হন গঙ্গাসাগর অভিমুখে। সেই উপলক্ষেই বাবুঘাট অঞ্চলে চলে আসেন সন্ন্যাসীরা। অঘোরী থেকে নাগা, শাক্ত থেকে বৈষ্ণব, সব মতের সাধুর সন্ধান মেলে এখানে। গঙ্গা সাগর যাওয়ার পথে ক্ষনিকের জন্য আশ্রয় নেন তাঁরা এই অস্থায়ী সাধু স্থলে। তাঁদের নিয়েই হালে কল্লোলিনী কলকাতার আগ্রহের অন্ত নেই। সাধুদের এই সমাগমে ভক্তদেরও জোর ভিড়।সব কিছুর মধ্যে অবশ্য সবার নজর কারেছেন নাগা সাধুরা। তাদের ঘিরেই ভক্তদের বাড়তি আকর্ষণ।

ইতিহাস বলে, হরপ্পা মহেঞ্জোদরোর মুদ্রায় নাগা সন্ন্যাসীদের চিত্র দেখতে পাওয়া গিয়েছে। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারও নাকি নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সনাতন ধর্মের মন্দিরগুলি যখন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, তখন আদিগুরু শঙ্করাচার্য চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শঙ্করাচার্য অনুভব করেছিলেন, সনাতন ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য অস্ত্রেরও প্রয়োজন। সেই কারণেই স্থাপিত হয আখড়া। নাগা সন্ন্যাসীরা ছিলেন সেইসব আখড়ার রক্ষক। তাদের যোদ্ধা সন্ন্যাসীও বলা হত। ধর্মের রক্ষায় তারা অস্ত্র শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হতেন।

আর ধর্মের রক্ষায় বারবার নাগা সন্ন্যাসীরা যে যুদ্ধ করেছেন তার প্রমাণ রযেছে ইতিহাসে। সোমনাথ মন্দির যখন আক্রান্ত হয়েছিল তখন ত্রিশূল ও তরবারি হাতে নাগা সাধুরা সামিল হয়েছিলেন প্রতিরোধে। তাতে আত্ম বিসর্জন করেছিলেন অধিকাংশ নাগা সাধুই। ষোড়শ শতাব্দীতে আওরঙ্গজেব যখন হরিদ্বার আক্রমণ করেছিলেন তখন নাগা সন্ন্যাসীরা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সতেরো সাতান্ন সালে আফগান ডাকাত আহমেদ শাহ আবদালি মথুরা বৃন্দাবনের মতো আধ্যাত্মিক শহরে নৃশংসতা চালালে হিমালয়ের গুহা থেকে আসা নাগারা তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। গুজরাতে নিজামের সৈন্যদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও যে নাগা সন্ন্যাসীরা যুদ্ধ করেছিলেন, তার উল্লেখ রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। অবশ্য স্বাধীনতার পরে নাগা সন্ন্যাসীরা অস্ত্র পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ, ততদিনে দেশ রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীদের হাতে ন্যস্ত হয়েছিল।

এমন সব নাগা সন্ন্যাসীদের অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা উল্টে ক’জনই বা মনে রেখেছে? তাই বলছিলাম, সাধু সঙ্গ করতে চান? পূর্ণ কুম্ভ দূর অস্ত! ঘরের কাছে গঙ্গাসাগরও অধরা? তাহলে সেই চির পরিচিত বাবুঘাটই ছাপোষা গৃহস্থের ভরসা। সেখানেই অনেকে আসেন নানা অতৃপ্ত কামনা মেটাতে, নানা আবদার নিয়ে নাগা সাধুদের কাছে। যেমন, বিহারের ছেলে কানাইয়া। কানাইহার জীবনটা বড়ই দুঃখের! যদিও তার বয়স এখনও ত্রিশের কোঠা পেরোয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে তার জীবনে ঘটে গিয়েছে বড় মাপের ‘ট্র্যাজেডি’। একবার নয়, একাধিকবার। দু’ দু’বার ‘শাদি’ হয়েছিল তার। আর দু’টি বউই তাকে জীর্ণ বস্ত্রের মত ত্যাগ করে সরে পড়েছে। বিরহের জ্বালায় শূন্য শয্যায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে সে। শেষ পর্যন্ত নাচার হয়ে এবার কানাইয়া শরণাপন্ন হয়েছে নাগা সাধু যশোয়ান্ত বাবার কাছে। গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নানে যাওয়ার পথে ‘বাবা’ অস্থায়ীভাবে ডেরাডান্ডা ফেলেছেন কলকাতার বাবুঘাটে।

ছলছল চোখে কানাইয়া জানাল, ‘বাবা ম্যায় পহেলা বার শাদি কিয়া। ওয়াইফ ভাগ গায়ী। দোসরা বার ফির শাদি কিয়া। ও ভী ভাগ গায়ী। বাবা হাম কেয়া করে গা?’ এতো বড় দুঃখের আখ্যান শুনে বাবার মুখে মুচকি হাসি। বরং তাঁর পাল্টা প্রশ্ন কেন এতবার বউ পালাচ্ছে কানাইহার । কানাইহার রাধা জোটে না কেন! তার সমস্যাটা কোথায়? শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাবার মন গলল। তিনি বাবুঘাটে তাঁর এক চিলতে আস্তানার সামনের হোমকুন্ড থেকে মন্ত্রপুত একটি ছোট্ট পাথর তুলে নিয়ে কানাইহার হাতে দিলেন। আশ্বাস দিলেন, তিন নম্বর শাদীর পর আর তার বউ পালাবে না এই পাথর ধারণ করলে। বউ তাকে খুব ‘প্যার করবে’।কানাইহা নাগাবাবার হাতে প্রণামী হিসাবে দিল একটি দশ টাকার নোট। তাতেই তুষ্ট সাধু।

স্ত্রী পরিত্যক্ত কানহাইয়াকে মন্ত্রপূত পাথর দিলেন নাগসাধু 
স্ত্রী পরিত্যক্ত কানহাইয়াকে মন্ত্রপূত পাথর দিলেন নাগসাধু

ভক্তের ডাকে সাড়া দিলেও যশোয়ান্ত বাবার নিজের জীবনে অবশ্য কোনও টানাপোড়েন নেই। না আছে কোন চাঞ্চল্য, না আছে কোনও অস্থিরতার রেশ। তিনি নিজেই জানালেন যে, তাঁর সুখ নেই, শোকও নেই। আনন্দ নেই, দুঃখ নেই। এ জীবনে আকাশ নেই, পাতালও নেই। আর কামিনী কাঞ্চনের মোহ? হাসতে হাসতে এই নাগা সন্ন্যাসীর ব্যাখ্যা, ‘আরে আমার তো প্রয়াগরাজের কুম্ভে সেই কবে “সংস্কার” হয়ে গিয়েছে। কামিনী আমাকে টানে না। কোনও নারী যদি আমার আসেও বা, তাতে তো আমার কোনও অনুভূতিই জাগে না। যা গড়পড়তা আর সব পুরুষের হয়।’

মানুষের অন্যতম জৈবিক প্রবৃত্তি কামবাসনা থেকে মুক্ত হওয়া, এ কোন কঠিন সাধনার ফল? নাগা সন্ন্যাসী অকপটে জানালেন, তাঁর সন্ন্যাস জীবনের আদি পর্বের গুহ্য তত্ত্বের কথা। সাধুরা সাধারণত নিজেদের পূর্ব জীবনের কথা বলতে চান না। তবে যশোয়ান্ত বাবা যে আদতে মহারাষ্ট্রের ভূমিপুত্র, তা তিনি গোপন করেননি। বালক বয়সেই নাগা সাধুদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সংসারের মোহ কখনই গ্রাস করতে পারেনি তাঁকে। জেনে রাখা ভালো, নাগা সাধু হওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রথম ধাপ হল ব্রহ্মচর্যের। এতে সফল হওয়ার পর মহাপুরুষ দীক্ষা দেওয়া হয়। তারপর যজ্ঞোপবীত করা হয়।

এরপরে,তাদের পরিবার এমনকী নিজের জন্য নিজস্ব পিন্ডদান করতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বিজওয়ান’। নাগা সাধুদের কাছে পার্থিব কোনও বিষয় বা পরিবার গুরুত্বপূর্ণ নয়, গোটা সম্প্রদায়কেই পরিবার বলে মনে করেন তারা। এই সাধুদের অধিকাংশই জুনা আখড়ায়। নাগা সাধুদের আখড়ায় থাকার প্রথা আদিগুরু শঙ্করাচার্য শুরু করেছিলেন।

খাড়ে বাবা দিবস রজনী দাঁড়িয়ে থাকাই যাঁর সাধনা  
খাড়ে বাবা দিবস রজনী দাঁড়িয়ে থাকাই যাঁর সাধনা

যশোয়ান্ত বাবা জানালেন যে, মোহ মাৎসর্য এর মূল উৎপাটনে সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা তাদের জননাঙ্গ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন। তাঁর মন্তব্য, ‘জব লন্ড (পুরুষাঙ্গ) টুট গিয়া তো কাম কামিনী, কুছ নেহি হ্যায়।’একই বক্তব্য নাগা সাধু ‘খাড়ে বাবা’র। তাঁর দাবি, মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবা মার সঙ্গে প্রয়াগরাজে (তখন এলাহাবাদ) কুম্ভে এসে নাগা সাধুদের দেখে তার মনের মধ্যে এক বিচিত্র পরিবর্তন হয়। তিনি নাগা সাধুদের হাত ধরে পাড়ি দেন বৈরাগ্যের পথে। সন্ন্যাস নেওয়ার পর তিনি নাকি একদিনও উপবেশন করেননি বা ভূমিতেও শয়ন করেননি। দুই প্রান্তে দড়ি বেঁধে মাঝে কম্বল পেতে তাতে ভর দিয়ে দিবস রজনী দাড়িয়েই তার সন্ন্যাস জীবনের সাধনা।

যদিও বয়সের নিরিখে এই সাধু নিতান্তই যুবক। যৌবনের ধর্ম কি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে না? তিনি এর উত্তরে যা বললেন, তা চলতি ভোগবাদী সমাজের প্রতিষ্পর্ধী এক বিপরীতধর্মী বিস্ফোরক ন্যারেটিভ এর সন্ধান দেয়। খাড়েবাবার কথায়, ‘আমি তো সংস্কারের পথে হেঁটেছি। ভোগের অস্ত্র তো আমি ধ্বংস করেছি। হাতের তর্জনী যদি কেউ চিরতরে ভেঙে ফেলে তবে সে কি কাউকে আঙুল তুলে শাসাতে পারে?’

মিডিয়ার প্রচারের ছোঁয়াচ থেকেও নিরাসক্ত থাকতে চান পুনম গিরি
মিডিয়ার প্রচারের ছোঁয়াচ থেকেও নিরাসক্ত থাকতে চান পুনম গিরি

নাগা সাধু পুনম গিরি প্রথমে তো কথা বলতেই নারাজ। তার পরম ভক্ত পেশায় ব্যবসায়ী সুধাময় সাধু জানালেন, বাবা ‘মিডিয়ার’ সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন না। ‘ছিলিমে’ কয়েকবার টান দেওয়ার পরে অবশ্য তার মন বদলাল। তিনি জানালেন, আজ থেকে ৩৫ বছর আগে সংসার ধর্ম ছেড়ে তিনি সেবা ধর্ম নিয়ে ছিলেন। সংস্কার প্রক্রিয়া নাগা সাধুদের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করে, সেটা বোঝার জন্য কুম্ভে আসতে হবে। সুধাময় বললেন, ‘ভাগ্য ভালো বাবা এইটুকু কথা বলেছেন!’

নিজের সুপ্রসন্ন ভাগ্য নিয়ে খুশি হয়ে ভাবছিলাম, সত্যি কী বিচিত্র জীবন এঁদের। এই পৃথিবী যখন ভোগবাদের মধ্যে ডুবে থাকতে চাইছে তখন ‘মন্ত্রের সাধন আর ভোগের অঙ্গের পাতন’ এই মধ্যেই মুক্তির সন্ধান করছেন তাঁরা। সাধারণ মানুষ যখন নিজের অস্তিত্ব প্রচারে উত্সাহী, তখন এই নাগা সন্ন্যাসী নিজের দেহদান আর পিণ্ডদান করে সকলের কাছ থেকে এমনকী নিজের কাছ থেকেও সব বন্ধন ছিন্ন করে ফেলেছেন।

এইসব ভাবনার মধ্যেই বাবুঘাটের গঙ্গা সাগরযাত্রার ট্রানজিট পয়েন্টে একটু গরম খিঁচুড়ির স্বাদ পেতে চরম হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। রাজস্থানের জয়পুর থেকে যাত্রা করে গঙ্গা সাগরের পথে প্রবীণা ভগবতী দেবীর রাতের আহার ওই সামান্য আগুন গরম খিঁচুড়ি। সাধুরাও কেউ কেউ লাইনে দাঁড়িয়েছেন সেই গরম খিচুড়ির জন্য। আসলে কামিনী কাঞ্চনের মোহ জয় করলেও নশ্বর অস্তিত্বের রক্ষার তাগিদে ক্ষুধাকে জয় করা তো দুঃসাধ্য। তা কিবা সাধু কিবা সংসারী, সবার পক্ষেই।

শীতের রাতে গরম খিঁচুড়ির স্বাদ পেতে বাবুঘাটের সাধুস্থলে হুড়োহু়ড়ি
শীতের রাতে গরম খিঁচুড়ির স্বাদ পেতে বাবুঘাটে হুড়োহু়ড়ি

 

ছবি: লেখক পার্থসারথী সেনগুপ্ত